জীবনের প্রথম ও শেষ চিঠি
একসময় মোবাইল ফোন আর ইন্টারনেটের সুবিধা না থাকায় চিঠিই ছিল দূর শহরে থাকা সন্তানদের জন্য বাবার কাছে টাকা চাওয়ার একমাত্র মাধ্যম। সেই চিঠিগুলোতে একটা সাধারণ কাঠামো থাকতো ‘প্রিয় বাবা, আশা করি ভালো আছেন। আমার পড়াশোনা ভালোই চলছে, তবে টাকার একটু সমস্যা হচ্ছে। তাই কিছু টাকা পাঠালে ভালো হয়।’
চিঠির সঙ্গে একাডেমিক সম্পর্কিত কথা যোগ করে বাবাকে বোঝানোর চেষ্টা চলতো, যেমন, ‘বাবা, এবার একটু বেশি টাকা পাঠান, নতুন বই কিনতে হবে।’ চিঠি পোস্ট করার পর দিন গোনা, কখন বাবা টাকা পাঠাবেন, সেই অপেক্ষার মধ্যেও ছিল একটা মিষ্টি অনুভূতি।
শুধু সন্তানের কাছে বাবা কিংবা বাবার কাছে সন্তানের নয়, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যেও চিঠির গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। দূর শহরে কর্মরত স্বামী তার স্ত্রীকে চিঠি পাঠাতেন, সেই চিঠির জন্য প্রতীক্ষা করতেন স্ত্রী। চিঠিতে থাকতো ভালোবাসার কথা, পরিবারের খোঁজখবর আর প্রতিদিনকার ছোট ছোট গল্প। এই চিঠিগুলো ছিল তাদের সম্পর্কের মজবুত ভিত্তি, যা প্রতিটি শব্দের মাধ্যমে আরও গভীর হতো।
আরও পড়ুন
প্রেমিক-প্রেমিকার মধ্যেও চিঠি বিনিময় ছিল প্রেমের বহিঃপ্রকাশ। একেকটি চিঠিতে লেখা থাকতো প্রেমের কাব্যিক শব্দমালা, যা সম্পর্ককে আরও মধুর করে তুলতো। এই চিঠিগুলোতে শুধু কথাই নয়, থাকতো ভবিষ্যতের স্বপ্নও। কখনোবা প্রেমিক যুগল চিঠি নিয়ে ধরা খেত পরিবারের হাতে। এমন ইতিহাস আছে সেসময়কার সব প্রেমিক-প্রেমিকাদের। এখন সেসব স্মৃতি মনে পড়লে তাদের ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি ফুটে ওঠে নিশ্চয়ই!
বর্তমানে প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে চিঠির সেই উন্মাদনা অনেকটাই হারিয়ে গেছে। এখন বাবা-মায়ের কাছে টাকা চাওয়া হয় মোবাইল ফোনের মাধ্যমে, মেসেজে বা ফোন কলে। টাকা লেনদেনের জন্য আর পোস্ট অফিস বা ব্যাংকের উপর নির্ভর করতে হয় না। মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে কয়েক সেকেন্ডেই টাকা লেনদেন করা যায়।
প্রেমিক-প্রেমিকারাও এখন আর চিঠি লেখেন না। তারা ফোনে, মেসেঞ্জারে বা ভিডিও কলে তাদের ভালোবাসা প্রকাশ করেন। স্বামী-স্ত্রীও দূরত্বে থেকেও প্রযুক্তির মাধ্যমে সারাক্ষণ একে অপরের সঙ্গে সংযুক্ত থাকতে পারেন। সেই প্রতীক্ষার দিনগুলো আর নেই, তবে তার বদলে এসেছে আরও দ্রুত যোগাযোগের সুবিধা।
চিঠি দিবসের এই দিনে, আমরা সেই পুরোনো দিনের মধুর স্মৃতিগুলোকে স্মরণ করতে পারি। বয়োজ্যেষ্ঠদের মুখে শুনতে পারি সেই দিনের গল্প, যখন চিঠির প্রতিটি মুহূর্ত ছিল ভালোবাসার প্রতিচ্ছবি। এখন প্রযুক্তি আমাদের জীবনকে সহজ করেছে, কিন্তু সেই মধুর চিঠির অনুভূতি এখনও বয়োজ্যেষ্ঠদের আবেগকে নাড়া দেয়।
আমি নিজেও একবার জীবনে চিঠি পেয়েছিলাম। তবে তা ছিল একাডেমিক চিঠি। আমার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে এক ভরদুপুরে এসেছিল। তবে রাত ১১টায় নিরাপত্তারক্ষী বাসায় চিঠিটি দিয়ে যান। নিজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে হঠাৎ চিঠি আসায় প্রথমে ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। এটাই আমার জীবনের প্রথম ও শেষবারের চিঠি।
চিঠি দিবসে সেই পুরোনো দিনের মধুর স্মৃতির সঙ্গে আমার নিজের এই অভিজ্ঞতা আমাকে আরও গভীরভাবে চিঠির গুরুত্বকে উপলব্ধি করতে শেখায়। চিঠি শুধু এক টুকরো কাগজ নয়, বরং তা আমাদের জীবনের একটি অধ্যায়।
আরও পড়ুন
কেএসকে/এমএস