পৃথিবীতে সবচেয়ে নিরাপদ স্থান মায়ের কোল
সন্তানের সবচেয়ে আপনজন ‘মা’। সন্তানের জন্য মায়েরা সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করতে দ্বিধাবোধ করেন না। মাকে ভালোবাসা কিংবা শ্রদ্ধা জানাতে কোনো উপলক্ষ লাগে না। তবুও অতি আপনজন মায়ের স্মরণে প্রতি বছর মে মাসের দ্বিতীয় রোববার ‘বিশ্ব মা দিবস’ হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। বিশেষভাবে স্মরণ করার এই দিনটি ঘিরে মা, মাতৃত্ব, মাতৃস্নেহ নিয়ে কয়েকজনের অভিব্যক্তি জানাচ্ছেন তানজিদ শুভ্র…
“মা মানে তো দুটো আঙ্গুল, হাঁটতে শেখার গান/জন্ম, জগৎ-জীবন জুড়ে দুঃখ জয়ের তান/মা সকলের মাথার উপর সুশীতল এক ছায়া/মা হলো ঠিক, একাই তিনি এক সমুদ্র মায়া।”
মা ছোট্ট একটি শব্দ, এমন একটি ডাক যার পরশ সুশীতল এক ছায়া, অষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকা অসাধারণ মায়া। কিছুদিন আগে একটা লেখা পড়েছিলাম (লেখকের নাম মনে নেই) যেখানে একজন জাপানি বৃদ্ধ সৈনিক ট্রেনে বসা তার সহযাত্রীকে প্রসঙ্গক্রমে স্মৃতিচারণে বলছেন, ‘আমি যুদ্ধ ক্ষেত্রে কত মানুষকে মারা যেতে দেখেছি। তাদের মধ্যে যারা বয়স্ক অর্থাৎ সন্তানাদি আছে তারা মৃত্যুর পূর্বে সন্তানের কথা স্মরণ করছেন আর যাদের সন্তান নেই অর্থাৎ অল্প বয়সের তারা চিৎকার করে তার মাকে ডাকছেন। এটাই বাস্তবতা। আমি কেন মৃত্যুমুখ থেকে বেঁচে ফিরেছি জানো? কারণ, আমার মা আমার বাধ্যতামূলক যুদ্ধযাত্রার সময় বলেছিলেন, তুমি কথা দাও বাবা, যুদ্ধের পর আমাদের আবার দেখা হবে।’
পবিত্র ইসলাম ধর্মে মাকে সুমহান মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করা হয়েছে। যেখানে আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সঃ) পিতামাতার প্রতি সন্তানের কর্তব্য বুঝাতে গিয়ে প্রথম তিনবারই বলেছেন মায়ের কথা, চতুর্থবার বলেছেন বাবার কথা।
মাতৃত্ব আসলে কেমন?
হামিদা আনজুমান,ছড়াকার, কবি,সহযোগী অধ্যাপক, নরসিংদী সরকারি কলেজ
একবার ডিগ্রি তৃতীয় বর্ষ চূড়ান্ত পরীক্ষার প্রত্যবেক্ষক ছিলাম। দুইজন বয়স্ক নারী যারা নিজেরা দুইটি ফুটফুটে বাচ্চার নানু, বারান্দায় হাঁটাহাটি করছেন তাদেরকে কোলে নিয়ে। এ দৃশ্য আমাদের কাছে অতি পরিচিত যখন থেকে চাকরিতে আছি। কারণ অনেক ছাত্রীদের পড়াশুনা করা অবস্থায় বিয়ে হয়ে যায়। এক থেকে ছয় মাস বয়সী শিশুরা মায়ের বুকের দুধ ব্যতীত বাইরের খাবারে অভ্যস্ত হয় না। তাছাড়া পরীক্ষার চার ঘণ্টা এবং আসা যাওয়ায় আরও অনেকটা সময় লেগে যায়, এত দীর্ঘ সময় শিশু না খেয়ে থাকতে পারে না। তাই শিশুকে কেন্দ্রে নিয়ে আসে এবং পরীক্ষার মাঝখানে মা বাইরে এসে সন্তানকে খাইয়ে দিয়ে যায় ২/৩ বার। একটি শিশু পাঁচ মাস বয়স, খুব কাঁদছিলো। শিশুটির নানু কিছুতেই থামাতে পারছেন না। আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন। মা এসে একবার দুধ খাইয়ে গেছেন। তবু থামছে না। কারণ মায়ের কাছে সবসময় থেকে অভ্যস্ত শিশুটি বাইরের পরিবেশে আরাম পাচ্ছে না। মা, শিশু, শিশুটির নানি/দাদির এই লড়াই, মাতৃত্বের লড়াই।
একবার আমার বিভাগে রসায়ন এর একটা বিষয়ের ইনকোর্স পরীক্ষা নিচ্ছি। আমার এক ছাত্রী বাচ্চাকে নিয়ে এসেছে। কারণ বাড়িতে কেউ নেই তাকে রাখার মতো। একটা ছোট্ট বৈদ্যুতিক পাখা নিয়ে এসেছে সঙ্গে করে যেন গরম না লাগে কারণ শিশুটি গরম সহ্য করতে পারে না। হাঁটতে শিখেনি তখনও। বয়স এক বছরের কম হবে। মেয়েকে কোলে নিয়েই ছাত্রী আমার পরীক্ষা শুরু করলো। কিন্তু চঞ্চল মেয়ে বাবুটা একটু পরপর কলম টেনে নিচ্ছে না হয় খাতা ধরে টানছে। লিখতে দিচ্ছে না কিছুতেই, হয়তো ও মনে করছে মা মনোযোগ দিচ্ছে না তার দিকে। আমি আমার কোলে নিতে চাইলাম তাও আসলো না। শেষ পর্যন্ত এভাবে পরীক্ষা শেষ করলো ছাত্রীটি।
আবার এমনও দেখেছি, ব্যবহারিক পরীক্ষা চলছে, ছাত্রীর দশ ঘণ্টা আগে অপারেশন করে বাচ্চা হয়েছে, অ্যাম্বুলেন্সে করে কলেজে এসেছে শুধু স্বাক্ষর করার জন্য, অনুপস্থিত যেনো না হতে হয়। তাহলে পরেরবার এই পরীক্ষাটা দিলেই হবে।
আমি নিজে একজন চাকরিজীবী মা, তাই এমন পরিস্থিতি আমাকেও প্রতিনিয়ত সামাল দিতে হয়েছে। বাসা থেকে বের হতে গেলে শিশুদের কান্নায় নিজের চোখ ভিজে যেতো। আমার সেই লড়াইয়ের পুরোভাগে নেতৃত্ব দিয়েছেন, আমার সন্তানদের সারাদিন আগলে রেখেছেন আমার মা। আমিও বলি, মায়ের মূল্য তাই, গাঁয়ের চামড়া দিয়ে মাকে পাপোস বানিয়ে দিলেও শোধ হয় না, হতে পারে না। এটাই সত্যিই।
আগে তেমন বুঝিনি। মা কি বুঝেছি নিজের সন্তান হওয়ার পর। যখন নিজে মা হয়েছি। সন্তানকে বুকে জড়িয়ে ধরা, এ এক অসাধারণ অনুভূতি! মা ডাকে প্রাণটা জুড়িয়ে যায়। সন্তানের অসুস্থতা মায়ের পৃথিবীটা অন্ধকার করে দেয়। সন্তানের সান্নিধ্যে ভালো থাকুন পৃথিবীর সব মায়েরা, মা দিবসে এই শুভ কামনা। রাব্বির হামহুমা কামা রাব্বা ইয়ানিস সাগিরা।
আম্মা তোমাকে ভালোবাসি
আহমেদ শিমু, কথাসাহিত্যিক
মাকে প্রত্যেকটা সন্তানই ভালোবাসে। কিন্তু একেক জনের প্রকাশ একেক রকম। আমি কখনো সামনা সামনি “আম্মা তোমাকে ভালোবাসি” কথাটা বলতে পারিনি। বড় হয়ে গেছি এখনো জ্বালাই। পৃথিবীতে এই মানুষটার সঙ্গে আমার কোনো অভিনয়ের সম্পর্ক নেই। মানুষটার পাশে থাকলেই কেমন নিশ্চিন্ত লাগে নিজেকে। এই মা নামের মানুষটার অনেক ক্ষমতা মুখ দেখেই কেমন মন পড়ে ফেলতে পারে।
মানুষটার কোনো কিছু হলে কেমন দম বন্ধ বন্ধ লাগে। মায়ের পাশে এক দন্ড বসে থাকলে ভেতরের জমে থাকা কষ্ট গুলো কীভাবে কীভাবে যেন ভ্যানিস হয়ে যায়। কিন্তু কখনোই বলতে পারিনি “আম্মা তোমাকে অনেক ভালোবাসি।” আমার চরিত্রটা একটু অদ্ভুত ধরনের তাই হয়তো কারও উপর রাগ হলেও মায়ের সঙ্গে ভালোভাবে কথা বলতে ইচ্ছা করেনা। নিজের অদ্ভূত চরিত্র নিজেকেই ভাবায়। কিন্তু ভাবা পর্যন্তই শেষ। এতদিনেও নিজেকে পরিবর্তন করতে পারিনি আর হয়তো হবেও না।
সব সময় পৃথিবীর সব মা, বাবা, সুস্থ থাকুক ভালো থাকুক। প্রত্যেকটা সন্তান তার নিরাপদ আশ্রয়কে ঘিরে বেড়ে উঠুক। সন্তানের মাথার উপর ছুঁয়ে থাক বটবৃক্ষগুলোর শীতল হাত।
পৃথিবীতে সবচেয়ে নিরাপদ স্থান মায়ের কোল
শ্রাবণী সায়ন্তনী, সংগীতশিল্পী ও শিক্ষার্থী, বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়
ছোট্ট একটি শব্দ ‘মা’। কিন্তু ছোট্ট শব্দটির পরিধি ব্যাপক। অতুলনীয় স্নেহ দিয়ে মা জন্ম থেকে সন্তান লালন পালন করে বড় করে তোলেন। আমি মনে করি অল্প কয়েক শব্দে মাকে কোনোভাবেই ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। পৃথিবীতে সবচেয়ে নিরাপদ স্থান এবং ভরসার জায়গা মায়ের কোল। মায়ের বুকে মাথা রেখে পৃথিবীর সর্বোচ্চ সুখ ও শান্তি অনুভব করা যায়। মাকে ভালোবাসার জন্য কোনো আলাদা দিবস লাগে না, লাগে না কোনো উপলক্ষ। যার নিঃস্বার্থ ভালোবাসা আমাদের পাথেয় তার জন্য প্রত্যেকদিনই সমান সম্মানের। বছরে শুধু একদিন নয় বরং আমাদের উচিৎ প্রত্যেক দিন মায়ের সঙ্গে সময় কাটানো, প্রতিটি মুহূর্তকে এ দিনটির মতো উদযাপন করা। আমি আমার মাকে ভীষণ ভালোবাসি।
লেখক: শিক্ষার্থী ও ফিচার লেখক
কেএসকে/এমএস