‘বয়কট’ শব্দটি কীভাবে, কোথা থেকে এলো?
‘বয়কট’ শব্দটির সঙ্গে কমবেশি সবাই পরিচিত। এই যেমন ধরুন, কোনো পণ্যের দাম বেড়ে গেলে সেটা বয়কটের কথা আসে। কিংবা ধরুন, এই রাশিয়ান-ইউক্রেন যুদ্ধ, বা বর্তমানে ইসরাইলদের গাজায় নির্মম হত্যাজজ্ঞের কারণে তাদের পণ্য বয়কটের জোয়ার শুরু হয় পুরোবিশ্বে।
বয়কট শব্দের উৎপত্তি কোনো কিছুর বিরুদ্ধে বা কারও বিরুদ্ধে প্রতিবাদের অংশ হিসেবে আমরা অনেক কিছুই বর্জন করি। কিংবা ঘৃণা প্রকাশের জন্যও আমরা সংশ্লিষ্ট বিষয়কে বর্জন করি। এভাবে কোনো কিছু বর্জন করার কথায় প্রথমেই ‘বয়কট’ শব্দটি চলে আসে।
এই যে কিছু হলেই ফেসবুকে পোস্ট দিচ্ছেন এটা বয়কট, সেটা বয়কট। কখনো কোনো পণ্য, কখনোবা কোনো ব্যক্তি। কিন্তু জানেন কি, এই বয়কট শব্দটি কোথা থেকে এলো। এর আসল অর্থ কি ছিল। কীভাবে এটি যুক্ত হলো আমাদের অভিধানে। এই শব্দের আবির্ভাব হয়েছিল চার্লস কানিংহাম বয়কট নামের এক ব্যক্তির থেকে।
আরও পড়ুন
চার্লস কানিংহাম বয়কটের জন্ম ১৮৩২ সালে ইংল্যান্ডে। প্রথমে তার নাম ‘বয়কাট’ রাখা হলেও ৯ বছর বয়সে পরিবার থেকে নাম বদল করে রাখা হয় ‘বয়কট’। বালক চার্লসের প্রথম ইচ্ছা ছিল সেনাবাহিনীতে যুক্ত হওয়ার। কিন্তু পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়ায় সেটা আর হয়নি। এরপর তিনি যুক্ত হন জমি কেনাবেচার কাজে। পরিবারের আর্থিক অবস্থা ভালো না হওয়ায় কম বয়সেই তিনি কাজে যুক্ত হয়েছিলেন।
দুরন্ত ও মেধাবী ছিলেন চার্লস। কিছুদিনের মধ্যে মায়ো কাউন্টির অন্তর্গত আঁচিল দ্বীপের বেশ খানিকটা জমি কিনে ফেললেন। পাশাপাশি কাজ করতে লাগলেন আয়ারল্যান্ডের আর্ল অব আর্নের জমি কেনাবেচার মধ্যস্থতাকারী হিসেবে। আর্নের অধীনে তখন প্রায় ৪০ হাজার একর জমি।
বয়কটের দায়িত্ব ছিল এই বিশাল পরিমাণ জমি দেখভাল ও সেখানকার কৃষকদের থেকে খাজনা আদায় করা এবং অনাদায়ে তাদের উচ্ছেদ করা। অনেকটা জমিদারের নায়েবের মতো। আর এই কাজে প্রচণ্ড নৃশংস ছিলেন বয়কট। তিনি বিশ্বাস করতেন, জমি ও চাষির জীবনের সব স্বত্ব মালিকের। ফলে যেভাবেই হোক প্রাপ্য আদায় করতে হবে। তাতে কিছু মানুষের ক্ষতি হলেও, সে দায় তার নয়। এমনকি কাজে আসতে সামান্য দেরি হলে, চাষিদের বেতন কেটে নিতেন বয়কট।
স্বাভাবিকভাবেই বয়কটের জোর-জুলুমে ক্ষিপ্ত হতে থাকে চাষিরা। ১৮৭৯ নাগাদ মাইকেল ডেভিট নামের এক কৃষকের সন্তান মায়ো প্রদেশে গড়ে তোলেন ‘আইরিশ ন্যাশনাল ল্যান্ড লিগ’। খাজনা কমানো ও উচ্ছেদবিরোধী আন্দোলনে সরগরম হয়ে ওঠে সমগ্র আয়ারল্যান্ড। পরের বছর কৃষকরা দাবি জানায় ২৫ শতাংশ খাজনা কমানোর। শেষ পর্যন্ত রফা হয় দশ শতাংশে।
সেই অর্থ উদ্ধারে প্রবল অত্যাচার চালান বয়কট। উচ্ছেদও করা হয় বেশ কয়েকটি পরিবারকে। এই ঘটনার পৌঁছায় সংসদ পর্যন্ত। সেই সময়ে সংসদের সদস্য ও ল্যান্ড লিগের পক্ষপাতী চার্লস স্টুয়ার্ট পার্নেল ঘোষণা করেন, এরকম ব্যক্তিকে সব জায়গায় উপেক্ষা করা উচিত। ব্যস, যেন ঘি পড়ল আগুনে! বয়কটের বিরুদ্ধে শুরু হলো সামাজিক ধর্মঘট। কোনো অনুষ্ঠানে তাকে ডাকা হয় না, কেউ কথা বলে না তার সঙ্গে। জমি কেনা-বেচা বন্ধ। শুকিয়ে যেতে লাগলো জমির ফসল। এমনকি পিয়ন পর্যন্ত তার বাড়িতে চিঠি দিতে আসতে চায় না। এ যেন সম্পূর্ণ একঘরে অবস্থা। ‘দ্য টাইমস’-এর পাতায় নিজের অসহায় অবস্থার কথা জানিয়ে খোলা চিঠি লিখলেন বয়কট।
এগিয়ে এলেন বেলফাস্ট আর ডাবলিনের বন্ধুরা। ফসল কাটার জন্য ৫০ জন লোক পাঠানো হলো মায়োতে। আর তাদের নিরাপত্তার জন্য থাকল ৯০০ সশস্ত্র সৈন্য। তাতে অবশ্য লাভ কিছু হয়নি বয়কটের। ৩৫০ পাউন্ডের ফসলের বদলে সৈন্যবাহিনীর জন্য তার খরচ হয়েছিল ১০ হাজার পাউন্ড। আর এইসব ঘটনার ফলে শুধু আয়ারল্যান্ড নয়, ইংল্যান্ডসহ ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশে ছড়িয়ে পড়ে তার গল্প। খবরের কাগজে জন্ম হয় অসংখ্য কার্টুনের। উনিশ শতকের শেষ দিকে ল্যান্ড লিগ ও পার্নেলের জনপ্রিয়তার ফলে যেখানেই জমিদার শ্রেণিরা অত্যাচার করত, সেখানেই নেওয়া হতে থাকে বয়কটের পদ্ধতি।
তবে বয়কট ছাড়াও গার্লকট শব্দটি নারীদের অধিকার বা ক্রিয়াকলাপের উপর ফোকাস করার উদ্দেশ্যে ব্যবহার শুরু হয়। এই শব্দটি ১৯৬৮ সালে আমেরিকান লেসি ও'নিল তৈরি করেছিলেন। সে বছর গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিকের সময় পুরুষ আফ্রিকান আমেরিকান ক্রীড়াবিদদের প্রতিবাদের প্রেক্ষাপটে তৈরি করা হয়েছিল গার্লকট। পরে এই শব্দটি অবসরপ্রাপ্ত টেনিস খেলোয়াড় বিলি জিন কিং ১৯৯৯ সালে উইম্বলডন প্রসঙ্গে নারী খেলোয়াড়দের সমান বেতন নিয়ে আলোচনা করার সময় ব্যবহার করেছিলেন।
আরও পড়ুন
সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান
কেএসকে/জেআইএম