উত্তাল মার্চ, স্বাধীনতা ও মহানায়ক
ভাষা আন্দোলনের পর বিভিন্ন ধাপ পেরিয়ে এদেশের মানুষকে ধীরে ধীরে স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত করার মহানায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মার্চেই রোপণ করেছিলেন মুক্তির চূড়ান্ত রূপরেখা। সেটা ৭ মার্চ দিয়ে শুরু আর ২৬ মার্চ গ্রেপ্তারের আগে স্বাধীনতা ঘোষণা দেওয়ার মাধ্যমে। বাঙালির অস্তিত্ব ও অনুভূতির সাথে সরাসরি জড়িত শব্দ হলো এই মার্চ। মার্চের উত্তলতাই বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামের চূড়ান্ত সূচনার মাস।
এই স্বাধীনতা সংগ্রামের চূড়ান্ত বাস্তবতার সাথে জড়িত নামটি হলো সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান। লক্ষ জনতা যার ডাকে সাড়া দিয়েছিল স্বার্থহীনভাবে, তিনি বঙ্গবন্ধু। পরিস্থিতি বোধ আর আসন্ন সংকট নিরসনকল্পে জাতির পিতা বরাবরই রাজনৈতিক প্রজ্ঞার প্রমাণ দিয়েছেন। ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ পরবর্তীতে ২৫ মার্চের মহান স্বাধীনতার ঘোষণা জাতির পিতার রাজনৈতিক দূরদর্শিতা ও গণমানুষের প্রতি ভালোবাসাকেই নির্দেশ করে। তার কর্মকাণ্ডই তাকে সাধারণ থেকে অসাধারণ, নায়ক থেকে মহানায়ক কিংবা গণমানুষের অধিকারের চূড়ান্ত নিশ্চিত ঠিকানায় রূপান্তরিত করেছে। উত্তাল মার্চ যার ছোঁয়ায় চূড়ান্ত উত্তালতা অর্জন করেছে এবং বাংলাদেশের সংগ্রামের ক্যালেন্ডারে স্থান পেয়েছে অগ্নিঝরা মার্চ কিংবা সংগ্রামের প্রতীক হিসেবে।
১৯৭০ সালে বাঙালির প্রাণপ্রিয় সংগঠন আওয়ামী লীগ পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। কিন্তু পাকিস্তানের সামরিক শাসকগোষ্ঠী বিজয়ী আওয়ামী লীগ তথা বাঙালিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে নানামুখী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। প্রকৃতপক্ষে তাদের উদ্দেশ্য ছিল, যে কোনোভাবে পশ্চিম পাকিস্তানিদের হাতে পাকিস্তানের শাসন ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখা। এই পরিস্থিতিতে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান ৩ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করেন। কিন্তু ১ মার্চ এ অধিবেশন অপ্রত্যাশিতভাবে অনির্দিষ্টকালের জন্য মুলতবি ঘোষণা করা হয়। এ ঘটনার প্রতিবাদে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে এবং আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ২ ও ৩ মার্চ সারাদেশে হরতাল পালন করে।
এই পটভূমিতে ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে অসীম সাহসিকতায় তার বলিষ্ঠ কণ্ঠে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। বঙ্গবন্ধুর দেওয়া ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণটি বাঙালি জাতির জীবনে অত্যন্ত গুরুত্ব ও তাৎপর্য বহন করে এবং বাঙালি জাতির অনুপ্রেরণার অনির্বাণ শিখা হয়ে অফুরন্ত শক্তি ও সাহস জুগিয়ে আসছে।
বঙ্গবন্ধুর ভাষণে গর্জে ওঠে উত্তাল জনসমুদ্র। লাখ লাখ মানুষের গগন বিদারী স্লোগানের উদ্দামতায় বসন্তের মাতাল হাওয়ায় সেদিন পত্ পত্ করে ওড়ে বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত লাল-সবুজের পতাকা। শপথের লক্ষ বজ্রমুষ্টি উত্থিত হয় আকাশে। সেদিন বঙ্গবন্ধু মঞ্চে আরোহণ করেন বিকেল ৩টা ২০ মিনিটে। ফাগুনের সূর্য তখনো মাথার ওপর। মঞ্চে আসার পর তিনি জনতার উদ্দেশ্যে হাত নাড়েন। তখন পুরো সোহরাওয়ার্দী উদ্যান লাখ লাখ বাঙালির ‘তোমার দেশ আমার দেশ বাংলাদেশ বাংলাদেশ, তোমার নেতা আমার নেতা শেখ মুজিব, শেখ মুজিব’ স্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠে। তিনি দরাজ গলায় তার ভাষণ শুরু করেন, ‘ভাইয়েরা আমার, আজ দুঃখ-ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি…।’ এরপর জনসমুদ্রে দাঁড়িয়ে বাংলা ও বাঙালির স্বাধীনতার মহাকাব্যের কবি ঘোষণা করেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম…, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, জয়বাংলা।’
বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণ মুহূর্তের মধ্যেই ছড়িয়ে পড়ে দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। তার ঘোষণার পর বীর বাঙালি সেই যে ঘর থেকে বেরিয়েছিল, বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত, দেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত আর ঘরে ফেরেনি। মুক্তিযুদ্ধে অগণিত প্রাণ উৎসর্গ করতে হয়েছে, অগণিত মা-বোনকে হারাতে হয়েছে সম্ভ্রম। আহত ও পঙ্গু হতে হয়েছে এদেশের অগণিত মানুষকে। লাখো মানুষের অপরিসীম ত্যাগের বিনিময়ে স্বাধীন হয়েছে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ। মার্চ মাসেই বাঙালি জাতি তার চেতনাকে নতুন করে শাণিত করে। নতুন শপথে বলীয়ান হয়। অত্যাচার, নিপীড়ন আর নির্যাতনের বিরুদ্ধে স্মারক মাস হিসেবে মার্চ প্রতিবারই আমাদের নতুন করে পথ দেখায়।
একাত্তরের ১৫ মার্চ ইয়াহিয়া খান ঢাকায় এলেন। তার সফরসূচি নিয়ে ছিল কঠোর গোপনীয়তা। ১৬ মার্চ প্রেসিডেন্ট ভবনে বৈঠকে বসলেন ইয়াহিয়া-মুজিব। রুদ্ধদ্বার বৈঠক। বৈঠকে দুই শীর্ষ নেতা ছাড়া আর কেউ নেই। বৈঠক চললো প্রায় আড়াই ঘণ্টা। এভাবে আরও চারদিন ইয়াহিয়া-মুজিব শীর্ষ বৈঠক চলে। আলোচনা হয় সংবিধান নিয়েও। তবে কোনো সমাধান আসেনি। অবশ্য এ আলোচনায় সমাধান অসম্ভব ছিল বলেই মনে করেন ইতিহাসবিদ ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন। তিনি বলেন, ‘কী কী বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছিলো, সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোন দলিল কিন্তু আমরা কখনো পাইনি। পাকিস্তানিরা মূলতঃ আলোচনার একটা ভান করেছিলো। শাসনতন্ত্র নিয়েও কথা বলেছিলো। তবে বঙ্গবন্ধু শুরু থেকেই ৬-দফার ভিত্তিতে আলোচনা এগিয়ে নিতে চেয়েছিলেন।’
আরও পড়ুন
একদিকে যখন আলোচনা চলছে; তখন পশ্চিম পাকিস্তান থেকে শিপিং করপোরেশনের জাহাজে করে পূর্ব পাকিস্তানে অস্ত্র ও সৈন্য আনার খবর প্রকাশ হয়। রংপুর, সৈয়দপুর ও জয়দেবপুরে অসহযোগ আন্দোলনে থাকা সাধারণ মানুষের ওপর সেনাসদস্যদের গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটে। ২৪ মার্চ এক বিবৃতিতে আওয়ামী লীগ জানায়, তাদের পক্ষ থেকে সকল বক্তব্য উপস্থাপন শেষ। এখন প্রেসিডেন্টের ঘোষণার পালা। তবে প্রেসিডেন্টের সে ঘোষণা আর আসেনি। ইতিহাসবিদ ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেনের মতে, ‘বঙ্গবন্ধু আলোচনায় সংবিধান কেমন হবে সে বিষয়ে ছয় দফার উপরই গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন।’
শেখ মুজিব কেন এই সময়ক্ষেপণের আলোচনায় অংশ নিয়েছিলেন? এ নিয়ে অনেকের প্রশ্ন থাকতে পারে। তবে ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘শেখ মুজিবের লক্ষ্য ছিলো বিশ্ববাসীর কাছে এই বার্তাটি পৌঁছে দেয়া যে, তিনি বিচ্ছিন্নতাবাদী নন। তিনি গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা। এবং তিনি আলোচনার মধ্যেই সমস্যার সমাধান চান। কিন্তু বঙ্গবন্ধু জানতেন, পাকিস্তানি শাসকরা তার একটি শর্তও মানবে না। সেজন্য আগে থেকেই ৭ই মার্চের ভাষণেই তিনি বাঙ্গালিকে সশস্ত্র সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন।’
২৫ মার্চের রাত থেকে হামলা শুরু করলো পাকিস্তানি বাহিনী। ঢাকা তখন একরকম শেখ মুজিবের নির্দেশে চলছে। অসহযোগ আন্দোলন চূড়ান্ত পর্যায়ে। ক্ষোভে উত্তাল পুরো দেশ। ২৫ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। ওই রাতে অপারেশন সার্চলাইট নামে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী বাঙালিদের ওপর অতর্কিত হামলা চালিয়ে নির্বিচারে গণহত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগসহ বিভিন্ন মানবতাবিরোধী অপরাধ করতে থাকে। এমতাবস্থায় গ্রেপ্তারের আগে ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা দেন। এ ঘোষণা বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রচারমাধ্যমে প্রচারিত হয়। সেই সময় বাস্তবতা ও নিরাপত্তাজনিত কারণে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার এই ঘোষণা নথি সংরক্ষণ করা সম্ভব ছিল না। পরবর্তী সময়ে সংবিধানের ষষ্ঠ তফসিলে বঙ্গবন্ধুর ঘোষণাটি অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
১৯৮২ সালে বাংলাদেশ সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রকাশিত বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র তৃতীয় খণ্ডে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের এই ঘোষণা উল্লেখ করা হয়। এতে বলা হয়, ২৫ মার্চ মধ্য রাতের পর অর্থাৎ ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে এ ঘোষণা দেন তিনি যা তৎকালীন ইপিআরের ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। পরে চট্টগ্রামের স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে ২৬ ও ২৭ মার্চ বেশ কয়েকজন শেখ মুজিবের পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন।
বঙ্গবন্ধুর ঘোষণার মূল্যবান দলিলটি সেখানে লিপিবদ্ধ হয়েছে এভাবে, ‘ইহাই হয়তো আমাদের শেষ বার্তা, আজ হইতে বাংলাদেশ স্বাধীন। আমি বাংলাদেশের জনগণকে আহ্বান জানাইতেছি যে, যে যেখানে আছে, যাহার যাহা কিছু আছে, তাই নিয়ে রুখে দাঁড়াও, সর্বশক্তি দিয়ে হানাদার বাহিনীকে প্রতিরোধ করো। পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর শেষ সৈন্যটিকে বাংলার মাটি হইতে বিতাড়িত না করা পর্যন্ত এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জন না হওয়া পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাও। শেখ মুজিবুর রহমান। ২৬ মার্চ, ১৯৭১।’
একদিকে দীর্ঘ নয় মাস ধরে বাঙালিদের ওপর চলল পাকিস্তানি আগ্রাসন, বাঙালিদের রক্তাক্ত প্রতিরোধ আর অন্যদিকে পাকিস্তানের অন্ধকার কারাগারে প্রতিমুহূর্তে বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর হাতছানি। ৩০ লাখ শহীদের আত্মত্যাগ আর কয়েক লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে আসে কাঙ্ক্ষিত মুক্তি। যে পাকিস্তানি সৈন্যরা নিরীহ বাঙালিদের ওপর গণহত্যা চালিয়েছিল, তাদের খুবই দ্রুত ও লজ্জাকর পরাজয় ঘটল। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ পাকিস্তান আত্মসমর্পণ করল এবং ৯০,০০০ পাকিস্তানি সৈন্যকে যুদ্ধবন্দি হিসেবে নেওয়া হলো। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর এটাই হলো সবচেয়ে বড় ধরনের আত্মসমর্পণ।
স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পর বাংলাদেশ আর পাকিস্তানের তুলনা করলে দেখা যায়, প্রায় সব সূচকেই বাংলাদেশ এগিয়ে অনেক। জাতিসংঘের মানব উন্নয়ন সূচক, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ, সামাজিক উন্নয়ন, নারীর ক্ষমতায়ন, ক্ষুধা প্রতিরোধ, সুশাসন, জঙ্গিবাদ প্রতিরোধ ইত্যাদি খাতে পাকিস্তান পিছিয়ে পড়েছে। এমনকি নানা সামাজিক ও অর্থনৈতিক সূচকে ভারতকেও পেছনে ফেলেছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের উন্নয়ন এক বিস্ময়কর ঘটনা। বাংলাদেশের ৫২ বছরের ইতিহাস আমাদের আশাবাদী করে তোলে। আমাদের যথেষ্ট উন্নয়ন হয়েছে। কিন্তু এ উন্নয়নের পাশাপাশি সমাজে বৈষম্য বেড়েছে। এই বৈষম্য দূর করতে হবে। বাংলাদেশ এখন উন্নয়নশীল দেশের কাতারে। দুর্নীতি, বিভেদ, অনৈক্য, অর্থনৈতিক বৈষম্য, হানাহানি দূর করতে পারলে, নির্মূল করতে পারলে, বাংলাদেশ বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে, পরিণত হবে উন্নত দেশে। আর আমরা হবো গর্বিত জাতি।
এসইউ/জেআইএম