ভিডিও EN
  1. Home/
  2. ফিচার

মণিপুরীদের রাস উৎসব যেভাবে এলো

ফিচার ডেস্ক | প্রকাশিত: ০৪:০৫ পিএম, ২৪ নভেম্বর ২০২৩

বৃহত্তর সিলেটের এক অনন্য ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক প্রান্তিক মণিপুরী জনগোষ্ঠীর সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বৃহত্তম ধর্মীয় উৎসব ‘মহারাস লীলা’ বা ‘রাস উৎসব’। প্রতি বছর অগ্রহায়ণ মাসের পূর্ণিমা তিথিতে পালিত হয় রাস উৎসব। এই উৎসব শুধু মৌলভীবাজারের মণিপুরীদের জন্যই রাস উৎসব নয় বরং এটি নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের অন্যতম বড় মেলা। দেশ-বিদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অসংখ্য পর্যটক এ উৎসবে শামিল হতে ছুটে আসেন। বিস্তারিত জানাচ্ছেন রফিকুল ইসলাম জসিম 

শত বছরের পুরোনো
মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার মাধবপুরের শিববাজারে জোড়ামণ্ডপে ১৮০ বছর এবং আদমপুরের তেতইগাঁওয়ে প্রায় ৪০ বছর ধরে মণিপুরীদের রাস উৎসব উদযাপিত হয়ে আসছে। আগামী ২৭ নভেম্বর তুমুল হইচই আর আনন্দ-উৎসাহ নিয়ে ঢাক-ঢোল, খোল-করতাল আর শঙ্খধ্বনির মধ্য দিয়ে হিন্দুধর্মের অবতার পুরুষ শ্রীকৃষ্ণ ও তার সখী রাধার লীলাকে ঘিরে জমে উঠবে রাস উৎসব।

রাস উৎসবে মণিপুরী সম্প্রদায়ের পাশাপাশি জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে অন্যরাও মেতে উঠবেন একদিনের এই আনন্দ ধামাকায়। মহারাত্রীর আনন্দের পরশ পেতে আসা হাজার হাজার নারী-পুরুষ, শিশু-কিশোর, কবি-সাহিত্যিক, সাংবাদিক, দেশি-বিদেশি পর্যটক, জ্ঞানী-গুণী লোকজনসহ প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের পদচারণায় মুখরিত হয়ে উঠবে মাধবপুর ও আদমপুরের মণ্ডপ প্রাঙ্গণ।

ছবি: রঞ্জন সিংহ

মণিপুরী রাসলীলার উৎপত্তি
১৭৫৯ খ্রিষ্টাব্দে মণিপুরের তৎকালীন মহারাজা ভাগ্যচন্দ্র অগ্রহায়ণ মাসের শুক্লা পূর্ণিমাতে মহারাস প্রথমবারের মতো লীলা উৎসব প্রবর্তন করেন। এরপর থেকে অগ্রহায়ণ পূর্ণিমা তিথিতে গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মাবলম্বী মণিপুরীদের প্রধান ধর্মীয় মহোৎসব শ্রী শ্রী কৃষ্ণের মহারাস লীলা পালিত হয়ে আসছে।

আরও পড়ুন: ব্যস্ত শহরে আদি গ্রাম ‘ভিলেজ মিউজিয়াম’

মণিপুরে রাসলীলা প্রবর্তনের একটি গল্প প্রচলিত আছে। মণিপুরের মহারাজা ভাগ্যচন্দ্র যখন কাঞ্চিপুর নামের এক অঞ্চলে বাস করতেন; তখন এক রাতে তিনি স্বপ্ন দেখলেন, শ্রীকৃষ্ণ নিকটবর্তী ভানুমুখ পাহাড়ে কাঁঠাল গাছ হয়ে রাজার জন্য অপেক্ষা করছেন। পরদিনই রাজা সেই পাহাড়ে গিয়ে কাঁঠাল গাছ খুঁজে পেলেন। গাছটি কেটে রাজধানীতে আনা হলো। রাজধানীর খ্যাতনামা শিল্পীকে রাজা তার স্বপ্নে দেখা কৃষ্ণমূর্তির অনুকরণে কাঠের মূর্তি গড়তে আদেশ দিলেন। এই মূর্তি প্রতিষ্ঠা উপলক্ষেই তিনি ওই বছর অগ্রহায়ণ মাসের শুক্লা পূর্ণিমাতে মহারাসলীলা উৎসব প্রবর্তন করেন। মেয়ে বিম্বাবতীও সেই রাসে অংশ নেন। তবে এই কাহিনির সঙ্গে কোনো ঐতিহাসিক প্রমাণ পাওয়া যায় না। রাজা ভাগ্যচন্দ্রই মহারাস, বসন্তরাস, কুঞ্জরাস ও ভঙ্গীপারেঙ প্রবর্তন করেন।

বাংলাদেশে রাস উৎসব
অষ্টাদশ শতকের প্রথম পাদে বাংলাদেশের সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ ও সুনামগঞ্জ জেলায় বসতি স্থাপনকারী মণিপুরীরা আজ থেকে প্রায় দেড় শতাধিক বছর পূর্বে প্রথম এ দেশে তাদের ধর্ম-সংস্কৃতির প্রধান উৎসব রাসলীলার সূচনা করে। বাংলা ১২৮৯ সন নাগাদ ১৮৪২ খ্রিষ্টাব্দের শারদীয় পূর্ণিমা তিথিতে তৎকালীন মৌলভীবাজার মহকুমার মাধবপুর জোড়ামণ্ডপে মণিপুরী বিষ্ণুপ্রিয়া সম্প্রদায়ের আয়োজনে এবং মণিপুরী মৈতৈ সম্প্রদায়ের সহযোগিতায় অনুষ্ঠিত হয় রাসলীলা।

প্রায় এক যুগ আগে মণিপুরীদের জাতিগত অন্তর্দ্বন্দ্বের কারণে ‘বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী’ ও ‘মৈতৈ মণিপুরী’ ধারায় বিভক্ত হয়ে পড়ে। ফলে মৈতৈ মণিপুরীরা আলাদাভাবে আদমপুরে সানা ঠাকুরের মণ্ডপে ১৯৮৬ সাল থেকে রাসলীলা উদযাপন শুরু করে। এবার মাধবপুর জোড়া মণ্ডপে ১৮১তম রাস উৎসব। মাধবপুরের রাসমেলার আয়োজক হচ্ছে মণিপুরী মহারাস লীলা সেবা সংঘ।

ছবি: রঞ্জন সিংহ

আরও পড়ুন: ইতিহাস ঐতিহ্যের ধারক আহসান মঞ্জিল

মণিপুরী বিষ্ণুপ্রিয়া সম্প্রদায়ের উদ্যোগে মাধবপুরের শিববাজার উন্মুক্ত মঞ্চ প্রাঙ্গণে হবে গোষ্ঠলীলা বা রাখাল নৃত্য। অন্যদিকে কমলগঞ্জের আদমপুরে মণিপুরী মৈতৈ সম্প্রদায় আয়োজন করছে পৃথক সানাঠাকুর মণ্ডপে। মণিপুরী বিষ্ণুপ্রিয়া ও মণিপুরী মৈতৈরা আলাদা স্থানে আয়োজন করলেও উৎসবের অন্তঃস্রোত, রসের কথা, আনন্দ-প্রার্থনা সবই এক। মণিপুরী এ উৎসবে দেশের বিভিন্ন স্থানসহ ভারত থেকেও মণিপুরী সম্প্রদায়ের লোকজনসহ জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে অনেকেই ছুটে আসেন মহারাস লীলা অনুষ্ঠান উপভোগের জন্য।

রাসলীলার পর্ব
রাস উৎসবের দুটি পর্ব। দিনের বেলায় রাখালরাস আর রাতে মহারাস। কৃষ্ণের বাল্যকালে মাঠে মাঠে বাঁশি বাজিয়ে ধেনু চড়াবার মুহূর্তগুলো অনুকরণ করা হয়। গোষ্ঠলীলাকে ‘রাখালনৃত্য’ বা ‘রাখালরাস’ বলা হয়ে থাকে। রাখালরাসের শুরুতে বালক কৃষ্ণ, বলরাম আর সখাদের গোচারণে যাবার অনুমতি দিতে গিয়ে মায়েদের অশ্রুমাখা বিলাপ গীত-মুদ্রায় রূপায়িত হয়।

রাসলীলার বিভিন্ন আঙ্গিক ও মুদ্রা সমন্বয়ে নৃত্যে ব্যাপকতা ও সাবলীলতা থাকে। এ নৃত্যে পোশাকের মধ্যে তেমন কোনো বাহুল্য থাকে না। গোপীরাও শ্রীরাধার পোশাক, মাথায় চূড়ার ওপর ‘ককনাম’, মুখে পাতলা সাদা কাপড়ের ঢাকনা ‘মেইকুম’, গায়ে রেশমি ব্লাউজের ওপর জড়ানো সাদা লংকথ ‘থারেং’ ব্যবহার করে থাকেন। এছাড়া ছোটখাট বিভিন্ন সামগ্রীর ব্যবহার বিশেষ করে চন্দন, ধূতিসহ পায়ে নূপুর ব্যবহার নৃত্যকে কমনীয়, আকৃষ্ট ও মোহাবিষ্ট করে তোলে। তবে আধুনিকতার ছোঁয়ায় মাঝে মাঝে স্বর্ণালংকারও ব্যবহার করা হয়।

ছবি: রঞ্জন সিংহ

আরও পড়ুন: মৃতদের স্মরণে পালিত হয় হ্যালোইন

কোথায় কী অনুষ্ঠান
মাধবপুর ও আদমপুরে রাসমেলার আয়োজকরা জানান, মহারাস লীলার মূল উপস্থাপনা শুরু হবে সকাল ১১টা থেকে ‘গোষ্ঠলীলা বা রাখালনৃত্য’ দিয়ে। গোষ্ঠলীলায় রাখাল সাজে কৃষ্ণের বালকবেলাকে উপস্থাপন করা হবে। এতে থাকবে কৃষ্ণের সখ্য ও বাৎসল্য রসের বিবরণ। গোধূলি পর্যন্ত চলবে রাখালনৃত্য। রাত ১১টা থেকে পরিবেশিত হবে মধুর রসের নৃত্য বা শ্রীশ্রীকৃষ্ণের মহারাসলীলানুসরণ। রাসনৃত্য ভোর (ব্রাহ্ম মুহূর্ত) পর্যন্ত চলবে। রাসনৃত্যে গোপিনীদের সাথে কৃষ্ণের মধুরলীলার কথা, গানে ও সুরে ফুটিয়ে তুলবেন শিল্পীরা।

কীভাবে আসবেন
ঢাকা থেকে ট্রেনে অথবা বাসযোগে আসতে পারেন। কমলাপুর রেল স্টেশন থেকে পারাবত, জয়ন্তিকা, কালনি বা উপবন ট্রেনে কমলগঞ্জ বা শ্রীমঙ্গল এসে ভানুগাছ চৌমোহনা থেকে বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান সড়ক ধরে ৩ কিলোমিটার গেলেই মাধবপুর জোড়ামণ্ডপ। অন্যদিকে কমলগঞ্জ উপজেলা সদর থেকে কমলগঞ্জ-কুরমা সড়ক ধরে সোজা ৫ কিলোমিটার দক্ষিণে আদমপুরের সানা মণ্ডপ। এসব রাস্তায় নিয়মিত বাস, পিকআপ, অটোরিকশা ও রিকশা চলাচল করে।

ছবি: রঞ্জন সিংহ

কোথায় থাকবেন
ভোরে পৌঁছাতে পারলে থাকার জন্য হোটেল দরকার হবে না। অনুষ্ঠান চলে সকাল থেকে রাতভর। কাজেই পুরো দিনটা অনুষ্ঠানস্থলেই কাটিয়ে দেওয়া যাবে। থাকতে চাইলে শ্রীমঙ্গল এবং মৌলভীবাজার সদরেই থাকতে পারেন। মাঝারি এবং সস্তা মানের রেস্ট হাউজ ও আবাসিক হোটেল আছে। তবে মৌলভীবাজার থেকে ভানুগাছ বা কমলগঞ্জ আসতে দেড় থেকে দুই ঘণ্টা সময় লাগে। যেখানে শ্রীমঙ্গল থেকে আসতে লাগে মাত্র ২০-২৫ মিনিট। এছাড়া ভানুগাছ এবং শমশেরনগরেও কিছু ছোটখাটো আবাসিক হোটেল আছে। ভানুগাছ বাজার বা আদমপুর বাজারে খাবারের হোটেল আছে। রাসমেলাতেও কিছু সাময়িক রেস্টুরেন্ট থাকে, খাওয়ার কাজটা সেখানেও সারতে পারেন।

এসইউ/এএসএম

আরও পড়ুন