জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব পড়ছে রাখাইন শিশুদের ওপর
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ঝড়, জলোচ্ছ্বাসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘটছে অনেক বেশি। যার প্রভাবে রাখাইনদের জীবন-জীবিকা, স্বাস্থ্য ও অভিবাসন ঘটছে ব্যাপক হারে। যা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রভাব পড়ছে রাখাইন শিশুদের উপর। উপকূলীয় জেলা পটুয়াখালীর বেশকিছু রাখাইন পাড়া ঘুরে এসে বিস্তারিত জানাচ্ছেন মেহেদী হাসান সজীব।
রাখাইনদের আদিনিবাস ছিল বর্তমান মিয়ানমারের আরাকান প্রদেশে। আজ থেকে দুইশো বছরের বেশি আগে এদেশে আসার ফলে রাখাইনদের বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ইতিহাস ও ঐতিহাসিক ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে দক্ষিণ অঞ্চলে। প্রথমে রাঙাবালী দ্বীপে এরপর ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে বড় বাইশদিয়া, মৌ ডুবি, কলাপাড়া, তালতলী এবং কুয়াকাটায়। এক সময় এই উপকূলীয় এলাকায় রাখাইনদের সম্রাজ্য থাকলেও বর্তমানে ঝড়, জলোচ্ছ্বাস, লবণাক্ততা ও আধুনিকায়নের ফলে বিলীন হয়ে যাচ্ছে এই সম্প্রদায়।
এমনকি এখন তাদের নিজস্ব মাতৃভাষায় কথা বলতে পারে না অনেক শিশু। কেউ কেউ পারলেও বর্ণমালা না জানায় নিজের ভাষায় লিখতে বা পড়তে পারছে না রাখাইন শিশুরা। অনেকের কথ্য ভাষায়ও তাই বাংলা ও ইংরেজি শব্দের মিশ্রণে হয়ে গেছে।
সাগরের কোল ঘেষা কুয়াকাটা রাখাইন পাড়ার ফুয়ে রাখাইন বলেন তাদের অসহায়ত্বের কথা। তিনি বলেন, ‘ঝড় জলোচ্ছ্বাসের কারণে বিভিন্ন রকমের সমস্যা হয় আমাদের। সন্তানদের নিয়ে নিরাপদে যাইতে হয়। আশ্রয়কেন্দ্র একটু দূরে, সেখানেই যেতে হয় কষ্ট করে। তারপর বন্যার কারণে বেশ কিছু সময় পানিবন্দি থাকতে হয়। তখন আমাদের চারপাশ নোংরা হয়ে থাকে। পানি নামতেও সমস্যা হয়। এ কারণে নানান অসুখ বিসুখ হয় শিশুদের।
আরও পড়ুন: বিউটি বোর্ডিং/ঘর আছে, আড্ডা নেই
আমাদের এই এলাকা তো লবণাক্ত। তাই এখানে তেমন কোনো ফসলও হয় না। এছাড়া বেশিরভাগ সময় শিশুরা ডায়রিয়া কলেরায় ভোগে, বৃদ্ধদেরও এই সমস্যা দেখা দেয়। যেখানে মিষ্টি পানি, সেখানে তো বিভিন্ন রকমের ফসল হয়। কিন্তু আমাদের এখানে একটাই ফসল, সেটা হচ্ছে ধান। এছাড়া বিভিন্ন রকমের ডাল, মরিচ এসব কিছুই আমাদের এখানে তেমন হয় না। যখন লোনাপানি ওঠে ,তখন ঘাসও তেমন থাকে না। তাই গাভীদের খাবার দিতে সমস্যা হয়। গরু ছাগলেরও অনেক রোগ বালাই হয়। আর আমাদের ভাষার কথা বললে তো কিছু বলার নাই, অনেকেই এই ভাষায় কথা বলতে পারে না। বিশেষ করে শিশুরা আমাদের ভাষা তেমন পারে না। কিছু বলতে পারলেও লিখতে পারে না। অনেকে ঠিক করে বর্ণমালাই চেনে না’।
একই পাড়ার মংশন রাখাইন বলেন, ‘আজ থেকে প্রায় দুইশো বছর আগে আমরা এখানে আসছি। প্রথমত দক্ষিণ অঞ্চল একসময় রাখাইনরাই রাজত্ব করতো। বাঘ ভাল্লুকের সঙ্গে যুদ্ধ করে এখানে বসতি গড়ে আমাদের পূর্বপুরুষরা। এখন বন্যা, জলোচ্ছ্বাসের কারণে বেশিভাগ চলে গেছে। প্রথমত আরাকানে ছিল, আরাকান থেকে বিতারিত হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় পেয়েছে। কিন্তু যখন বন্যা হয়, তখন আবার চলে গেছে অনেকে। জলবায়ু পরিবর্তনের যে প্রভাব এটা তো সারাবিশ্বে। কিন্তু আমরা যেহেতু নদীর কাছাকাছি থাকি এজন্য একটু বেশি হুমকির মুখে থাকি। ছোট বাচ্চা পোলাপাইনদের অসুখ বিসুখ তো লাইগাই থাকে। খুজলি, প্যাচরা, ডায়রিয়া, আমাশা নানান ধরনের রোগবালাই হয়’।
জলবায়ু পরিবর্তন ও লবণাক্ততা যেন রাখাইন পাড়ার অভিশাপ স্বরূপ। এমনটাই বলছিলেন নাচনাপাড়া গ্রামের ৫০ বছর বয়সী রাখাইন নাইসি। তিনি আরও বলেন, ‘এখানে নিচু জায়গা তো, লবণ পানির সমস্যার জন্য। নিচু জায়গা উঁচু করার জন্য মাটি লাগে, কিন্তু সেজন্য বেশকিছু টাকার প্রয়োজন হয়। আমরা জায়গাটা উঁচু করতে পারি না টাকা পয়সার জন্য।
যখন লবণ পানি সব ঠুইক্কা যায়, বেশিরভাগ সময় সব ফসল, ঘরবাড়ি নষ্ট হইয়া যায়। এবারগো তো ব্যামালা ক্ষতি হইছে। অসুখ বিসুখের কতা আর কইয়েন না। ঐতো কাশ হয়, সর্দি হয়, জ্বর হয় এই পানির জন্য। লবণ পানিতে অনেক ক্ষতি হয়, ডায়রিয়াও হয়। গর্ভবতী মায়েদের সমস্যা হয় পানির জন্য। ঠিকমতো গোসল করতে পারে না, খাইতে পারে না। আগে কুয়াটুয়া আছিলো, এহন কুয়া দিয়াও নুন পানি ওঠে। কুয়া আর খুড়তেও পারে না’।
আরও পড়ুন: মানসিক-শারীরিক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে শিক্ষাবঞ্চিত বেদে শিশুরা
একটি জাতি তো তখন বিলুপ্ত হয়-যখন তাদের ভাষা, সংস্কৃতি, লোকবল, বসতবাড়ি বিলুপ্তির পথে দাঁড়ায়। ফলে তারা বাধ্য হয় স্থানান্তরিত হতে। এমনটাই বলছিলেন রাখাইনরা।
ফুয়ে রাখাইন আরও বলেন, ‘একসময় এখানে অনেক পরিবার ছিল। ঝড় আর লবণাক্ততার জন্য তখনতো আমাদের এইখানে আবাদ ছিল না। বন্যা আসলে সব তলায় যাইত, ভাসাইয়া নিয়ে যাইত। তখন বন্যায় অনেক লোক মারাও গেছে। কিছু কিছু লোক বেঁচে ছিল। কিন্তু তাদের ফসল নষ্ট হয়ে যায় বন্যায়, সব খুয়াইয়া অনেকে আবার বার্মা চইল্লা গেছে। আর স্থায়ী হয়ে থাকতে পারবো কী?
আগে তো আমাদের সম্প্রদায়ের অনেক ফসলি জমি ছিল। এখন তো আর সেই রকম নাই। আমাদের সম্প্রদায়ের লোকেরা তেমন লেখাপড়া জানতো না। মাঝেমধ্যে বিক্রি করতো, বিক্রি করার সময় কিছু টাকা নিতো। স্থানীয়রা যারা লেখাপড়া জানত তারা সহজসরল পাইয়া আমাগো থেইক্কা অনেক জমি লেইখা নিয়া যাইতো। কিন্তু যাদের জমি লেইখা নিলো তারা তো জানতে পারতো যখন দখলে নিয়া গেছে, কাগজপত্র নিয়া আসছে তখন তাদের কে ছাইড়া দিতে হইছে। এইভাবেও অনেকে সব হারাইয়া চইল্লা গেছে আমাদের সম্প্রদায়ের। যে সম্প্রদায় অর্থনৈতিক দিক দিয়ে সচ্ছল না, তাদের বিভিন্ন রকমই সমস্যা। যেমন সন্তানদের লেখাপড়ার খরচ, নিজেদের বাঁচার তাগিদ। এভাবেই আমাদের রাখাইন সম্প্রদায় লড়াই করে বাইচা আছে এখনো’।
মংশন রাখাইন আরও বলেন, ‘এইদিকে তো জোয়ার হইতো, যদি ধাবার বেশি হয়, বাড়িঘর ভাইঙ্গা পড়ে, গাছপালা ভাইঙ্গা পড়ে, কৃষি জমির সবকিছু নষ্ট হয়ে যায়। মানুষেরও তো অনেক ক্ষতি হয়। কেউ মারা যায়, কেউ হয়তো অসুস্থ হয়ে যায় বা হাত পা ভাইঙ্গা যায়। আবার অনেকের বিভিন্ন ধরনের সমস্যা হইয়া যায়। বড় মানুষের চেয়ে শিশুদের বেশি সমস্যার মধ্যে পড়তে হয়। আমাদের শিশুরা তো আমাদের মাতৃভাষাই তেমন জানে না। জানবে কেমনে? আমাদের জন্য তো আলাদা শিক্ষা ব্যবস্থা নাই’।
একসময়ে রাখাইনদের প্রধান জীবিকা ছিল তাঁতশিল্প। কিন্তু সময় বদলে যাওয়ায় তা-ও আজ বিলুপ্তির পথে। ইউটেন রাখাইন বলেন, ‘একসময় আমাদের জীবিকা নির্বাহের প্রধান উৎস ছিল তাঁত এবং কৃষি। তাঁত তো এখন নাই বললেই চলে। এখন সুতার দাম অনেক বেশি। তারপর একজন কারিগরের দৈনিক বেতন। একটা কাপড় তৈরি করতে এক সপ্তাহ লাগে। যেটার খরচের সঙ্গে বিক্রয়মূল্য খুবই নগন্য। আবার সমস্যা সুতা পাওয়া যায় না, তারপর তৈরি করে সেটা বাজারজাত করাও খুব কঠিন’।
লাইসু রাখাইন বলেন, ‘শুধু মানুষ বিলুপ্তি হয় না। সেই সঙ্গে যদি তাদের সাংস্কৃতি, ভাষা, ঐতিহ্য এগুলোও বিলুপ্ত হইয়া যায়। তাহলে একটা জাতি বিলুপ্তি হইয়া যাওয়ার মতোনই। বিলুপ্তির পথে শিক্ষা-সাংস্কৃতি। আমাদের একটা অনুষ্ঠান আছে বৌদ্ধ পূর্ণিমা। কিন্তু আমাদের এলাকায় তার আয়োজন কিন্তু এখন আর হয় না। এর কারণ আমাদের লোকবল নাই। একটা অনুষ্ঠান করতে গেলে অনেক খরচ হয়, যার জোগাড় করাও সম্ভব হয় না।
আরও পড়ুন: শখ থেকে মাছুমের মাসে আয় ৫০ হাজার টাকা
এখনকার শিশুরা তাদের মাতৃভাষা শিখতে পারছে না। আমাদের প্রথম মাতৃভাষা হচ্ছে আমাদের মায়ের ভাষা, সেই মায়ের ভাষাই আমরা পাইনা। দ্বিতীয় মাতৃভাষা হলো বাংলা। আমাদের ক্ষেত্রে দ্বিতীয় বলতে হবে। যেহেতু আমাদের নিজেদের একটি ভাষা আছে। মাতৃভাষা শিক্ষা থেকেও আমাদের ছেলেমেয়েরা পিছিয়ে। কারণ এই ভাষা শেখানোর বা চর্চা করানোর তেমন কোনো সুযোগ নেই’।
অংশন রাখাইন বলেন, ‘আমাদের অনেকেই এখন মাছ ধরে, অনেকে কাঁকড়া ধরে। অনেকে যাদের কিছু জমি আছে তা চাষাবাদ করে এভাবেই চলছে আমাদের জীবিকা নির্বাহ। অনেকে আবার ব্যবসা করে সংসার চালায়। বলতে গেলে আমরা অল্প যে কয়েকটা পরিবার আছি, তারা অনেক কষ্টের মধ্যে আছি’।
কুয়াকাটা রাখাইন পল্লীর মাতব্বর খেইনখন রাখাইন বলছিলেন তাদের সম্প্রদায়ের কথা। তিনি বলেন, ‘অনেকে বার্মা চইল্লা গেছে বন্যার ভয়ে। আগে হইছে সাইক্লোন। এখন তো মাঝে মধ্যেই ঘূর্ণিঝড় হয়। ক্ষুদ্র দিয়ে তো আর বড় কিছু করা যায় না, করা যায়? আমাদের একটা অনুষ্ঠানে, বেশি হলেও দেড়শো থেকে দুইশো লোক হয় এখন, এর বেশি হয় না। যেখানে চারদিন পাঁচদিন ধরে একটি অনুষ্ঠান হওয়ার কথা, সেখানে দুই-তিন দিনেই শেষ করতে হয়। আমাদের সংখ্যা এই এলাকা, পটুয়াখালী, বরগুনা জেলা মিলাইয়া তিন হাজারের মতো আছি। সন্তানদের স্বাস্থ্য ঝুঁকি, পড়ালেখা সমস্যা সহ একটার পর একটা বিপদ লাইগাই থাকে’।
কলাপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, ‘রাখাইন সম্প্রদায়ের জন্য আলাদা শিক্ষা ব্যবস্থা এখনো গড়ে ওঠেনি। তবে তারা স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পাচ্ছে। আর ঝড় জলোচ্ছ্বাসসহ অন্যান্য সমস্যায় বর্তমান সরকার রাখাইন বান্ধব’।
রাখাইনদের এদেশে আসার মূল কারণ ছিল আরাকান যুদ্ধে পরাজিত হওয়া। এদেশে তারা স্থায়ী বসবাসের জন্য আসেনি। কিন্তু আরাকান বিজয় রাখাইনদের জন্য কখনোই সম্ভব হয়নি। তাই বাংলাদেশের মাটিতেই রাখাইনরা স্থায়ী হয়ে আছেন। তাদের শেকড় এখন এদেশের মানুষের সঙ্গে এক হয়ে গেছে। তবে জলবায়ু পরিবর্তন, লবণাক্ততা ও দিন দিন নগরায়নের ফলে আজ এ জাতি বিলুপ্তির পথে।
সর্বোপরি সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগের অভাব, উদ্যোগ থাকলেও যথাযথ ব্যবহার বা চর্চা না করা, মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা সংকট ও সংরক্ষণের অভাবে হারিয়ে যাচ্ছে পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলায় বসবাসকারী রাখাইনদের শিক্ষা, সংস্কৃতি, কৃষ্টি-কালচার এবং ভাষা। যা এই সম্প্রদায়ের মানুষের জন্য অভিশাপ স্বরূপ।
কেএসকে/এমএস