সাংবাদিকতায় বিপ্লবী ধারার সূচনা করেন কবি নজরুল
সাম্য-মৈত্রীর কবি, প্রেম ও দ্রোহের-অগ্রসেনানী কবি, জাগরণ-মানবতার কবি কাজী নজরুল। তবে শুধু কবিতা কিংবা গানই নয়, সাংবাদিকতার মাধ্যমেও কাজী নজরুল ইসলাম বিপ্লবী ধারার সূচনা করেন। অগ্নীবীণা হাতে তার প্রবেশ, ধূমকেতুর মতো তার প্রকাশ। কবি সাংবাদিক হিসেবে জীবনের গুরুত্বপূর্ণ একটা সময় ব্যয় করেছিলেন। বিংশ শতাব্দীতে তিনি একাধারে কবি, সাহিত্যিক, সংগীতজ্ঞ, সাংবাদিক, সম্পাদক, রাজনীতবিদ এবং সৈনিক হিসেবে অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে র্সবদাই ছিলেন সোচ্চার। তার কবিতা ও গানে এই মনোভাবই প্রতফিলতি হয়েছে। যা বাদ পড়েনি সাংবাদিকতায়ও।
নানান গুণে গুণান্বিত ছিলেন কবি কাজী নজরুল। শৈশবে অভাবের তাড়নায় পড়া ছেড়ে রুটির দোকানে কাজ করছেন। সৈনিক হিসেবে কাজ করেছেন ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে। বাদ দেননি সাংবাদিকতাও। অত্যাচারী বিদেশি শাসক, দেশীয় তোষামোদকারী ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে শক্তিশালী ও শাণিত সম্পাদকীয় লিখে শাসকদের ভিত কাঁপিয়ে তোলেন। ইংরেজ শাসকশ্রেণীর বিরুদ্ধে ভারতজুড়ে যে গণবিপ্লব হয়, তা শাণিত ও বেগবান করতে কাজী নজরুল ইসলাম ‘নবযুগ’ পত্রিকার মাধ্যমে সাংবাদিকতার জগতে আবির্ভূত হন।
১৯২০ সালের গোড়ার দিকে যুদ্ধ শেষে ব্রিটিশ সেনার ৪৯ নম্বর বেঙ্গলি রেজিমেন্ট ভেঙে গেলে নজরুল কলকাতায় চলে আসেন। প্রথমে শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়ের রমাকান্ত স্ট্রিটের বোর্ডিং হাউসে উঠেছিলেন। কিছুদিন পরই তার মুসলমান পরিচয় জেনে ওই বোর্ডিংয়ের পরিচারিকা তার বাসন ধুতে অস্বীকার করেন। এরপর ৩২ নং কলেজ স্ট্রিটে বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতির অফিসে বসবাস শুরু করেন। এটি ছিল এই সমিতির অন্যতম কর্মকর্তা মুজফ্ফর আহমেদের আস্তানায়।
মুজফ্ফরের কাছেই কবির সাংবাদিকতায় হাতে খড়ি। তাদের যৌথ উদ্যোগে ও সম্পাদনায় ১৯২০ সালের ১২ জুলাই সান্ধ্য দৈনিক নবযুগ প্রকাশিত হয়। সব মিলিয়ে নবযুগে পাঁচ মাস কাজ করেন নজরুল। কাগজের প্রধান পরিচালক হিসেবে ফজলুল হকের নাম ছাপা হতো। তবে সব কাজই আসলে করতেন নজরুল ও মুজফ্ফর দুজনে। এই কয়েকমাসে অসংখ্য সম্পাদকীয় লিখেছিলেন তিনি। যার সঙ্কলন যুগবাণী নামক বইয়ের আকারে প্রকাশিত হয়েছিল ১৯২২ সালে। যুগবাণীতে নজরুলের লেখা মোট ২১টি সম্পাদকীয় নিবন্ধ পাওয়া যায়। তবে বইটি প্রকাশের পরই ব্রিটিশ সরকার বইটি বাজেয়াপ্ত করে। ১৯৪৮ সালে বইটি আবার প্রকাশিত হয়।
তবে এরই মধ্যে নব্যযুগের পাশাপাশি মোসলেম ভারত, বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা, উপাসনা প্রভৃতি পত্রিকায় তার কিছু লেখা প্রকাশিত হয়। এর মধ্যে রয়েছে উপন্যাস বাঁধন হারা এবং কবিতা বোধন, শাত-ইল-আরব, বাদল প্রাতের শরাব, আগমনী, খেয়া-পারের তরণী, কোরবানি, মোহরর্ম, ফাতেহা-ই-দোয়াজ্দম্, এই লেখাগুলো সাহিত্য ক্ষেত্রে বিশেষভাবে প্রশংসিত হয়। এর প্রেক্ষিতে কবি ও সমালোচক মোহিতলাল মজুমদার মোসলেম ভারত পত্রিকায় তার খেয়া-পারের তরণী এবং বাদল প্রাতের শরাব কবিতা দুটির প্রশংসা করে একটি সমালোচনা প্রবন্ধ লিখেন। এ থেকেই দেশের বিশিষ্ট সাহিত্যিক ও সমালোচকদের সঙ্গে নজরুলের ঘনিষ্ঠ পরিচয় শুরু হয়।
তবে পত্রিকা হয়ে ওঠে নজরুলের বিপ্লবের আরেক অস্ত্র। ব্রাত্যজনের পক্ষ নিতে হবে, এই বোধ নজরুলের জীবনের অভিজ্ঞান ছিল। নবযুগে তাই শ্রমিকের, কৃষকের, সংখ্যালঘুর স্বর জোরালো হয়ে উঠেছিল প্রথম থেকেই। পত্রিকাকে সামনে রেখে নজরুল একটি ভেদাভেদমুক্ত অসাম্প্রদায়িক স্বর গড়ে তোলার চেষ্টা করেছেন এই স্বল্প সময়েই। নামপ্রবন্ধটিতেই নজরুল লেখেন, ‘এসো ভাই হিন্দু! এসো মুসলমান! এসো বৌদ্ধ! এসো ক্রিশ্চিয়ান! আজ আমরা সব গণ্ডি কাটাইয়া, সব সংকীর্ণতা, সব মিথ্যা, সব স্বার্থ চিরতরে পরিহার করিয়া প্রাণ ভরিয়া ভাইকে ভাই বলিয়া ডাকি।’ নবযুগে নজরুল একাধিক প্রবন্ধ লিখেছেন জালিয়ানওয়ালা বাগ হত্যাকাণ্ড নিয়ে। ব্রিটিশ শাসকের সাম্রাজ্যবাদী চরিত্র তুলে ধরতে গিয়ে ঘৃণার চরিত্রটিকে চিহ্নিত করেন নজরুল। ‘কালা আদমিকে গুলি মারা’ নামক সম্পাদকীয়টিতে নজরুল স্পষ্ট বলছেন, ব্রিটিশরা এ দেশের মানুষকে কুকুরেরও অধম মনে করে।
১৯২০ সালে ‘ধূমকেতু’ পত্রিকায় ‘মুহাজিরীন হত্যার জন্য দায়ী কে’ শিরোনামে একটি প্রবন্ধ লিখেন যার জন্য পত্রিকার জামানত বাজেয়াপ্ত করা হয় এবং নজরুলের উপর পুলিশের নজরদারি শুরু হয়। ধূমকেতু সম্পাদনার সময়কাল নজরুলের সাংবাদিক সত্তার সবচেয়ে উজ্জ্বল পর্ব। তিনি নবযুগ ছাড়ার দু’বছর পরে ১১ আগস্ট ১৯২২ থেকে পথচলা শুরু করে ধূমকেতু। সপ্তাহে দু’বার প্রকাশিত হত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, বিপ্লবী বারীন ঘোষ, উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, পরীসুন্দরী ঘোষ, বীরজাসুন্দরী সেনগুপ্ত, সরোজিনী নায়ডুর আশীর্বাদ নিয়ে শুরু হয়েছিল এই কাগজের পথ চলা।
নজরুলের ধূমকেতু সম্পর্কে জনতার আগ্রহের কথা উঠে আসে অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তর কল্লোলযুগ গ্রন্থে। তিনি লিখছেন ‘সপ্তাহান্তে বিকেলবেলা আরও অনেকের সঙ্গে জগুবাবুর বাজারের মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকি, হকার কতক্ষণে ধূমকেতুর বাণ্ডিল নিয়ে আসে। হুড়োহুড়ি কাড়াকাড়ি পড়ে যায় কাগজের জন্য। কালির বদলে রক্তে ডুবিয়ে লেখা সেই সব সম্পাদকীয় প্রবন্ধ। শুনেছি স্বদেশীযুগের সন্ধ্যাতেও এমনই ভাষাতে লিখতেন।’ সন্ধ্যার প্রকাশকালে নজরুল পাঁচ বছর বয়সী বালক। কিন্তু সত্যিই সম্পাদক ব্রহ্মবান্ধবের আপসহীন রাজনীতি ও ভাষার সঙ্গে নজরুলের মিল ছিল। ১৯০৫ সালের মার্চ মাসে সন্ধ্যা পত্রিকার পাতায় লেখা হয়, ‘আমরা কী চাই? আমরা চাই পূর্ণ স্বাধীনতা। আমরা দেখতে চাই আমরাই আমাদের দেশের মালিক হয়েছি।’ এর ১৭ বছর পরে ধূমকেতু-তে ‘ধূমকেতুর পথ’ নামক সম্পাদকীয় প্রবন্ধে নজরুল দাবি তুলবেন, ‘সর্ব্ব প্রথম ধূমকেতু ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা চায়।’
কাজী নজরুল বাঙালি নারীর স্বাধীনতা, অধিকার প্রকাশের হাতিয়ার বানিয়েছিলেন পত্রিকাকেই। নজরুল ধূমকেতু সম্পাদনার প্রথম দিন থেকেই এই ধরনের গোঁড়ামিমুক্ত হয়ে উঠতে পেরেছিলেন। ধূমকেতুর প্রথম সংখ্যাতে ‘নারীকল্যাণ’ বিভাগে ‘নারীর সত্য স্বাধীনতা কিসে?’ শীর্ষক একটি দীর্ঘ নিবন্ধ লেখেন বিরজাসুন্দরী দেবী। ধূমকেতুর দ্বিতীয় সংখ্যা থেকেই ‘সন্ধ্যাপ্রদীপ’ নামের একটি কলামে নারীর জাগরণ বিষয়ে তর্কে মাততে দেখা যায় নারীদের, সময়ে সময়ে মতামত দেন কয়েকজন পুরুষও।
নবযুগ, ধূমকেতু ছাড়াও দৈনিক, অর্ধসাপ্তাহিক, সাপ্তাহিক, মাসিক, ত্রৈমাসিক, ষান্মাসিক ও বাৎসরিক পত্রিকা মিলে নজরুল ইসলাম লাঙল, গণবাণী, নওরোজ, সেবক, সওগাত, বুলবুল, মোহাম্মদী, বসুমতী, ভারতী, বঙ্গবাণী, আত্মশক্তি, নকীব, অভিযান, সাম্যবাদী, মোয়াজ্জিন, দরদী, শান্তি, শিক্ষা, কবিতা, গুলিস্তা, দিলরুবা, উপাসনা, সহচর, প্রবর্তক, নারায়ণ, বিজলী, কল্লোল, কালি-কলম, প্রগতি, প্রবাসী, উত্তরা, ভারতবর্ষ, নূর, মানসী ও মর্মবাণী, অলকা, শক্তি, যুগের আলো, শিখা, নাচঘর, স্বদেশ, আজকাল, আজাদ, মাহে-নও, বৈতালিক, মোসলেম ভারত, বকুল, জয়তী, বাংলার কথা, বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা এরকম প্রায় শতাধিক পত্রিকার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। পত্রিকাগুলোর কোনোটির পরিচালক, সম্পাদক বা ফরমায়েসি লেখক হিসেবে তিনি যুক্ত ছিলেন।
সাংবাদিকতার মাধ্যমে তিনি তৎকালীন রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থা প্রত্যক্ষ করার সুযোগ পান। জনগণকে দেশপ্রেমের চেতনায় উদ্বুদ্ধ ও বিপ্লবী জাগরণ তৈরি এবং যে কোনো আন্দোলনে সাধারণ জনতাকে সম্পৃক্ত করতে সংবাদপত্রের রয়েছে সোনালি অতীত। কবিতা-গানে, নজরুল যেমন তার মনোভাবকে অকুণ্ঠভাবে প্রকাশ করতে ভয় পাননি, সাংবাদিকতার ক্ষেত্রেও তেমনি তিনি জনতার কাতারে থেকেছেন।
অধীনতার নাগপাশ ছিন্ন করে তিনি স্বাধীনতার বাণী প্রচার করেছেন। এর অবশ্যম্ভাবী ফলস্বরূপ ইংরেজি শাসকের কারাগারে তাকে কারাভোগ করতে হয়েছে। নজরুল কিন্তু কবি পরিচয়ের জন্যই শুধু কারাবরণ করেননি। সাংবাদিকতার জন্যও গ্রেফতার হয়েছিলেন। তার কবিতা ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ ধূমকেতুর দ্বাদশ সংখ্যার সম্পাদকীয় হিসেবে প্রকাশিত হয়েছিল। ১২৪ (ক) ও ১৫৩ (ক) ধারায় স্থিতাবস্থা নষ্টে ইন্ধনের অভিযোগে নজরুলকে গ্রেফতার করা হয়। এরপরও নজরুল ইসলাম শাসকশ্রেণীর সঙ্গে কোনোরূপ আপোস করেননি। তার কবিজীবন যেমন অখণ্ডিত, তেমনি সাংবাদিক জীবনও অবিচ্ছিন্ন, অনমনীয় ও আপোসহীন সংগ্রামের এক উজ্জ্বল ইতিহাস।
কেএসকে/জেআইএম