ভিডিও EN
  1. Home/
  2. ফিচার

মণিপুরী ভাষাচর্চায় পিছিয়ে নতুন প্রজন্ম!

ফিচার ডেস্ক | প্রকাশিত: ০১:৩১ পিএম, ১৯ আগস্ট ২০২৩

রফিকুল ইসলাম জসিম

বাংলাদেশে যে বিভিন্ন ক্ষুদ্র জাতিসত্তা বাস করে তাদের অন্যতম হলো মণিপুরী জাতি। তাদের আদি উৎসভূমি বর্তমান ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় ক্ষুদ্র রাজ্য মণিপুর; ভারতীয় সংবিধানেও মণিপুরী ভাষা অন্যতম ভাষা হিসেবে স্বীকৃত। তবে যেখানে বায়ান্নর মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠায় প্রাণ বিসর্জন দেওয়া হয়েছিল, সেখানেই নেই মণিপুরী ভাষার স্বীকৃতি। বাংলাদেশের সংবিধানে বাংলা ছাড়া আর কোনো ভাষার সাংবিধানিক স্বীকৃতি নেই।

১৯৯২ সালের ২০ আগস্ট ভারতের পার্লামেন্টে ৭১ তম সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে মণিপুরী ভাষাকে সংবিধানের ৮ম তপশিলে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তাই মণিপুরসহ মণিপুরি অধ্যুষিত বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ও বাংলাদেশ অভিবাসিত মণিপুরী জনগোষ্ঠীরা ২০ আগস্ট দিনটিকে মণিপুরী ভাষা দিবস হিসেবে পালন করে।

মাতৃভাষার নাম ‘মণিপুরি ভাষা’
মণিপুরী জাতির মাতৃভাষার নাম ‘মণিপুরী ভাষা’। তিব্বত-ব্রহ্ম ভাষাপরিবারের অন্তর্গত এই ভাষা খুবই প্রাচীন এবং উৎকর্ষের মানদণ্ডেও যথেষ্ট সমাদৃত। অন্তত খ্রিষ্টীয় তৃতীয় শতাব্দী থেকেই মণিপুরী লিখিত সাহিত্যের সূচনা হয়েছে বলে পণ্ডিতরা মনে করেন। মণিপুরীদের আদি ও মূলভূমি এককালের স্বাধীন রাজ্য, বর্তমান ভারতের অন্যতম রাজ্য, মণিপুর। মণিপুর ছাড়াও ভারতের আসাম, ত্রিপুরা, মেঘালয়, নাগাল্যাণ্ডসহ বিভিন্ন রাজ্য এবং মায়ানমার ও বাংলাদেশে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মণিপুরী বসতি আছে। মণিপুরী ভাষাভাষীর সংখ্যা প্রায় ৩০ লাখ।

আরও পড়ুন: বিলুপ্তির পথে মণিপুরীদের ঐতিহ্যবাহী কোমর তাঁত

ভাষাচর্চায় পিছিয়ে তরুণ প্রজন্ম
মণিপুরী ভাষার প্রাতিষ্ঠানিক চর্চা ও শিক্ষালাভের সুযোগের অভাবে দেশের মণিপুরী ভাষাভাষীরা শুদ্ধভাবে মণিপুরী ভাষা বলতে ও লিখতে পারছেন না। বিশেষ করে বর্তমান প্রজন্ম অনেকটা পিছিয়ে রয়েছে। অথচ এই ভাষার রয়েছে নিজস্ব লিপি। আছে সুপ্রাচীন ইতিহাস ঐতিহ্য।

মণিপুরী ভাষা বলতে পারলেও লিখতে পারে না রফিকুল হাসান। পটুয়াখালী মেডিকেল কলেজের ১ম বর্ষে শিক্ষার্থী রফিকুল হাসানের সঙ্গে আলাপ হয়। পড়াশোনায় ভালো বলে মণিপুরী সম্প্রদায়ের মেধাবী এই শিক্ষার্থী মেডিকেলে ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন। নিজের ভাষার বর্ণমালা জানা নেই বলে একটু লজ্জিত হলেন তিনি। কিন্তু খানিক পর পাল্টা প্রশ্নে জানতে চাইলেন, মণিপুরী ভাষা তার জীবনে কোন প্রয়োজনে লাগবে? মাতৃভাষা খোদার সেরা দান। মাতৃভাষায় আমরা কথা বলব, হাসব, কাঁদব; এটা আমার ব্যক্তি জীবনের সবচেয়ে বড় চাওয়া। পৃথিবী থেকে বহু ভাষা আজ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। হারিয়ে যাওয়ার পথে রয়েছে অনেক ভাষা। আমাদের মাতৃভাষা মণিপুরী ভাষা প্রাতিষ্ঠানিক চর্চা ও শিক্ষালাভের সুযোগের অভাবে শুদ্ধভাবে মণিপুরী ভাষায় বলা ও লেখার বর্তমান প্রজন্মও রয়েছে পিছিয়ে।

নতুন প্রজন্মের মধ্যে মাতৃভাষা মণিপুরীর প্রতি যথাযথ অনুরাগ সৃষ্টি করা যেমন সম্ভব হয়নি, তেমনি তাদেরকে এর পঠন ও লিখনচর্চায় আগ্রহী করে তোলা সম্ভব হয়নি। সেই প্রেক্ষাপটে মণিপুরী ভাষা ও বর্ণমালা সংরক্ষণের জন্য সিলেটের দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে যাচ্ছে ‘বাংলাদেশ মণিপুরী সাহিত্য সংসদসহ বেশ কয়েকটি সংগঠন।

মণিপুরী ভাষাচর্চায় পিছিয়ে নতুন প্রজন্ম!

মণিপুরীদের রয়েছে নিজস্ব লিপি
মণিপুরী ভাষার নিজস্ব লিপিপদ্ধতি আছে। খ্রিস্টীয় প্রথম শতকে মণিপুর রাজ্য পাখাংবায় এই লিপির উদ্ভাবন বলে ইতিহাস থেকে জানা যায়। তখন এর সংখ্যা ছিল ১৮। পরবর্তীকালে, সপ্তদশ শতাব্দীতে মহারাজ খাগেম্বা উচ্চারণকে অধিকতর প্রমিত করার লক্ষ্যে গুরু উচ্চারণে আরও নয়টি বর্ণ সংযোজন করেন। এছাড়া রয়েছে আটটি হসন্ত বর্ণ এবং আটটি অক্ষর বা কার চিহ্ন। মণিপুরী লিপির প্রতিটি বর্ণমালার নামকরণ করা হয়েছে দেহের এক একটি অঙ্গ প্রত্যঙ্গের নামে। যেমন- বাংলা ‘ক’ এর মণিপুরী প্রতিবর্ণের নাম ‘কোক’- যার বাংলা অর্থ মাথা। বাংলা ‘স’-এর মণিপুরি প্রতিবর্ণ ‘সম’- যার বাংলা অর্থ চুল। ম-এর প্রতিবর্ণ ‘মিৎ’- যার বাংলা প্রতিশব্দ চোখ। সব বর্ণই এ রকম। শরীরের নানা অঙ্গের নামে।

মণিপুরী লিপির মূল বর্ণগুলো নিম্নরুপ:
k (কোক- ক), s (সম- স), l (লাই- ল), m (মিৎ- ম), p (পা- প), n (না- ন), c (চীল- চ), k (খৌ- খ), XZ (ঙৌ- ঙ), t (থৌ- থ), w (ওয়াই- ওয়া), y (য়াঙ- য়), h (হুক- হ), U (ঊন- উ/ঊ), I (ঈ- ই/ঈ), f (ফম - ফ), A (অতিয়া- অ)।

পরবর্তীতে সংযোজিত গুরু উচ্চারণের ৯টি বর্ণ:
g (গোক- গ), j (ঝম- ঝ), r (রাই- র), b (বা- ব), j (জিল- জ), d (দিল- দ), G (ঘৌ- ঘ), D (ধৌ- ধ), B (ভম- ভ)।

মণিপুরী ভাষাচর্চায় পিছিয়ে নতুন প্রজন্ম!

মণিপুরী বর্ণমালার স্কুল
ভারতের মণিপুর রাজ্যে মণিপুরী বর্ণমালা মিল রেখে বাংলাদেশেও এর চর্চা ও শিক্ষা শুরুর লক্ষ্যে ‘মণিপুরী ভাষা গবেষণা ও উন্নয়ন সংস্থা’ ২০১২ সাল থেকে সাপ্তাহিক ছুটির দিনে অনিয়মিত স্কুল পরিচালনার মাধ্যমে প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে মণিপুরী লিপি ও ভাষা শিক্ষা কার্যক্রম চালু করেছে। শুরুতে মণিপুরী অধ্যুষিত বিভিন্ন অঞ্চলে সংস্থাটি এরকম সাতটি স্কুল পরিচালনার নিজেদের উদ্যোগে তারা কাজ করছেন। সরকারের সহযোগিতা ছাড়াই বর্তমানে ১০টি স্কুল রয়েছে। সেগুলোতে অল্পসংখ্যক মণিপুরী শিশুরা তাদের নিজস্ব বর্ণমালায় পড়তে ও লিখতে পারায়, মণিপুরী শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতির মূল স্রোতোধারায় নিজেদের সম্পৃক্ত রাখার চেষ্টায় মণিপুরী ভাষাচর্চায় নতুন প্রাণ ফিরেছে।

আরও পড়ুন: জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি চায় মণিপুরী তাঁত

মণিপুরী বর্ণমালা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের প্রশিক্ষক বৃন্দা রানী সিনহা বলেন, ‘মণিপুরী ভাষা ও বর্ণমালা রক্ষায় সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। প্রকৃত মণিপুরী শব্দগুলো ব্যবহার ও প্রয়োগ করতে হবে। মণিপুরীদের লিপি বা বর্ণমালা শিক্ষার সুযোগ তৈরির না হাওয়াতে অনেকে প্রকৃতভাবে মণিপুরী বর্ণমালা কয়টি তাও জানেন না।’

প্রাথমিকের মাতৃ-শিক্ষাব্যবস্থা নেই অগ্রগতি
১৯৯৯ সালে ২১ ফেব্রুয়ারিকে ইউনেস্কো আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণাকালে উল্লেখ করা হয়- সব ভাষাকে পৃষ্টপোষকতা, সংরক্ষণ ও সমানাধিকার প্রদানই এই দিবসের উদ্দেশ্য। বাংলাদেশ সরকার ২০১০ সালের শিক্ষানীতি; যেখানে ‘আদিবাসীসহ সব ক্ষুদ্র জাতিসত্তার জন্য মাতৃভাষায় শিক্ষার ব্যবস্থা করাকে সরকার প্রাথমিক শিক্ষার লক্ষ্য হিসেবে নিয়েছিল। তবে এক যুগে লক্ষ্য পূরণে অগ্রগতি হয়েছে সামান্যই। শিক্ষানীতি প্রণয়নের সাত বছর পর ২০১৭ সালে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, গারো ও সাদরি জাতিগোষ্ঠীর ভাষায় পাঠ্যবই পায় শিশুরা। পরের পাঁচ বছরে পাঠ্যক্রমে নতুন আর কোনো ভাষা যুক্ত করা যায়নি।

মণিপুরী ভাষাচর্চায় পিছিয়ে নতুন প্রজন্ম!

মণিপুরী ভাষার নিজস্ব লিপি থাকা সত্ত্বেও সিলেট অঞ্চলের এই ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর শিশুদের নিজের ভাষায় পড়ার সুযোগ হয়নি। এনসিটিবির তথ্য সূত্রে জানা যায়, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের মাতৃভাষায় পাঠ্যবই তৈরির প্রক্রিয়া স্থগিত হয়ে গেছে। এর কারণ হিসেবে তারা জানিয়েছেন “আমরা মণিপুরী ভাষায় পাঠ্যবইয়ের কাজটা যখন করতে গেলাম, তখন তাদের মধ্যে দুটি ভাগ তাদের ভাষায় করতে বললেন। অর্থাৎ একটি ভাষার মধ্যে দুটি শাখা। এক পক্ষ বলছে, তাদেরটা করতে হবে, তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ। সরকার অনেক দূর এগিয়ে কাজটি আর করতে পারল না।”

আরও পড়ুন: মীতৈ মণিপুরীদের বৈচিত্র্যময় বিয়ের রীতিনীতি

বাংলাদেশ মণিপুরী সাহিত্য সংসদের সভাপতি কবি ও গবেষক একে শেরাম বলেন, মণিপুরী ভাষার নিজস্ব লিপি আছে এবং এই লিপিতে লিখিত বই দিয়ে মণিপুর রাজ্যে স্কুল ও কলেজ পর্যায়ে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। আমরা চাই, বাংলাদেশেও যখন নতুনভাবে এই ভাষায় শিক্ষা কার্যক্রম শুরুর প্রক্রিয়া চলছে, সেখানেও নিজস্ব লিপিতেই মণিপুরী ভাষা লেখা হোক এবং শিশুদের মধ্যে সঠিকভাবে পাঠদান শুরু হোক। এই কার্যক্রম শুরু করা এবং পরিচালনার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সব ধরনের সহযোগিতা করতে আমরা প্রস্তুত।

২০ আগস্ট ‘মণিপুরী ভাষা দিবস’
মণিপুরী ভাষায় রচিত সাহিত্য মান ও সংখ্যার বিচারে খুবই উল্লেখযোগ্য। মণিপুরী ভাষায় রচিত হয়েছে ৩৪ হাজার পদ সম্বলিত মহাকাব্য ‘খম্বা-থোইবী শৈরেং’। মণিপুরী ভাষা সেই প্রাচীনকাল থেকেই মণিপুরের রাজ্যভাষা হিসেবে প্রচলিত হয়ে এসেছে। কিন্তু ভারতে মণিপুরী ভাষা নানা কারণে উপেক্ষিত থাকায় মণিপুরীভাষীরা এই ভাষাকে ভারতীয় সংবিধানের অষ্টম তপশীলে অন্তর্ভুক্ত করে ভারতের অন্যতম জাতীয় ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি জানায়। তারপর দীর্ঘ এক রক্তক্ষয়ী আন্দোলন-সংগ্রামের ফলশ্রুতিতে শেষ পর্যন্ত ভারত সরকার মণিপুরী ভাষাকে ১৯৯২ সালের ২০ আগস্ট তারিখে সংবিধানের অষ্টম তপশীলে অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে ভারতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। একারণেই মণিপুরী ভাষাভাষী জনগণ ২০ আগস্টকে ‘মণিপুরী ভাষা দিবস’ হিসেবে পালন করে থাকে।

আরও পড়ুন: ঘুমন্ত নারীর পা ঘষা তার নেশা

লেখক: ফিচার লেখক ও গণমাধ্যমকর্মী

কেএসকে/জেআইএম

আরও পড়ুন