গারোদের ৭ রকমের বিয়ে
রফিকুল ইসলাম জসিম
মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার একমাত্র গারো পল্লী গারোটিলা। মাধবপুর ইউনিয়নের পাত্রখোলা চা বাগানের হাজারীবাগ মৌজায় গারোটিলায় ক্ষুদ্র এই জাতিগোষ্ঠী নিজেদের স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে জীবনযাপন করছে।
গারোটিলার পূর্ব বসতিস্থল নেত্রকোনা। সুরেশ্বরী নদীর ভাঙনের ফলে ভিটে-মাটি চ্যুত হন গারোরা। এরপর গারোদের পুরোহিতগণ ১৯৬২ সালে চা বাগানে কর্মসংস্থান করে জীবিকা নির্বাহের জন্য এ অঞ্চলে সবাইকে নিয়ে চলে আসেন। বর্তমানে গারো ৬৬ পরিবার খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করে খ্রিস্টান হয়েছে। এদের মধ্যে রোমান ক্যাথলিক ৪৫টি ও ব্যাপ্টিস্ট ২১ টি রয়েছে। পূর্বে তাদের ধর্ম ছিল সাংসারিক ধর্ম। এখানকার গারোরা দৈনিক মজুরি ভিত্তিতে চা বাগানে কাজ করেন।
গারোটিলায় স্থানীয়দের কাছ থেকে জানা যায়, কীভাবে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণের ফলে গারোদের আদি বিয়ের আচারগুলো বদলে গেল সে কাহিনি। গারোটিলার গারোদের সঙ্গে কথা হয় গারোদের আদি বিয়েরীতি ও লোকাচার নিয়ে। তাদের মুখে শোনা আদি বিয়ের নানা তথ্যগুলোই আমাদের সমৃদ্ধ করে। শুনতে অবাক লাগলেও, গারোটিলায় গারো সমাজের সম্পত্তি উত্তরাধিকারী হওয়ার নিয়মটা এমনই। যেখানে মেয়েরাই পরিবারের প্রধান, সম্পত্তির মালিক এবং বিয়ের পর পুরুষরা এসে ওই নারীর ঘর সংসার করবেন।
গারো সমাজে বর্তমানে খ্রিস্টিয়ান রীতিতে বিবাহ বহুল প্রচলিত হলেও পূর্বে বিভিন্ন ধরনের বিবাহ রীতি বেশিরভাগ গারোর মধ্যে এখনো রয়েছে তাদের প্রাচীন গোষ্ঠীপ্রথায় প্রচলিত বেশ কয়েকটি বিবাহরীতি।
গারোরা বিয়েতে অলংকার হিসেবে দাংগা সরা, রেপ্পা সরা, কক্কা শীল, সিক্কী সরা, সাংগোং, নাকেন্টা, ডোমি প্রভৃতি ব্যবহার করে থাকে। এরা সব সামাজিক উৎসব, ধর্মীয় আচার ও অতিথি আপ্যায়নে ধেনো পচুই মদ বা চু প্রিয় পানীয় হিসেবে ব্যবহার করে। গারো নারীরা বিশেষ পদ্ধতির মাধ্যমে এই মদ তৈরি করেন। এছাড়া বিয়ের উৎসবে ভাত ও শূকরের মাংস খাওয়ানো হয়।
চলুন জেনে নেওয়া যাক গারোদের বিয়ের ধরন সম্পর্কে-
দোন্দকা বা দোবুক নিয়া
দোন্দকা বা দোবুক নিয়া মূলত আনুষ্ঠানিক বিবাহরীতি। এটিই গারোদের প্রথম স্থানীয় বিবাহ অনুষ্ঠান। আদি গারো উপগোষ্ঠীর সবাই দোন্দকা রীতি পালন করে থাকে। এই বিয়েতে প্রয়োজন হয় চু, দোরাসং বা একটা বড় মোরগ এবং মুরগি। বড় মোরগটি কেবল পাত্রপাত্রীর অনাত্মীয়রাই খেতে পারে। তবে অন্যান্য মোরগ ও মুরগি আগুনে পুড়িয়ে দেবতার জন্য উৎসর্গ করে, তারপর সবাই খায়। নবদম্পতির ভবিষ্যৎ শুভ কি অশুভ তা জানার জন্য কর্মকারী পুরোহিত মোরগ-মুরগির অন্ত্র পরীক্ষা করেন। অন্ত্রগুলোর বড়শি আকৃতির অংশের আকার ও আয়তন সমান হলে ধরে নেওয়া হয় নব-দম্পতির ভবিষ্যত শুভ। অতঃপর পুরোহিত বর ও কনের পিঠে বন্ধ মুষ্টির তিন আঘাত করে বিয়ের কাজ সম্পন্ন করেন।
আরও পড়ুন: ঘুমন্ত নারীর পা ঘষা তার নেশা
টু-নাপা
টু-নাপা হলো বাসর বিয়ে। এই রীতিটি আদি গারো সম্প্রদায় এবং খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী গারোদের মধ্যে এখনো প্রচলিত রয়েছে। বিয়ের উপযুক্ত পাত্র-পাত্রী তাদের নিজ ইচ্ছায় একই বিছানায় শয়ন করে। সাধারণত অভিভাবকদের অনুমতিতেই তা হয়ে থাকে, কিন্তু কখনো কখনো অভিভাবকদের অজান্তে প্রেমের সম্পর্ক হলে পাত্র-পাত্রী এই রীতিতে নিজেরা বিয়ে করে এবং অবশ্যই উভয়ের মধ্যে যৌন সংসর্গ হয়ে থাকে। যৌন সংসর্গ না হলে প্রণয় নিবেদন অগ্রাহ্য বলে বিবেচিত হয়। ছেলে অথবা মেয়ে কেউ যদি জোর করে টু-নাপা করে তাহলে তাকে জরিমানা দিতে হয়।
দক-চাপা বা অনচাপা বা অননা-চাপা
দক-চাপা বা অনচাপা বা অননা-চাপা হলো সপত্নী গ্রহণ। এই প্রথা অনুযায়ী একজন পুরুষ একজন বৃদ্ধা ও একজন যুবতীকে একত্রে বিয়ে করতে পারে। প্রায় ক্ষেত্রে বৃদ্ধাটি যুবতীর মাতা হয়। কিন্তু যৌন সংসর্গে মাতা ও কন্যা উভয়েরই সমান অধিকার থাকে। পরিবারের মধ্যে অবশ্য বৃদ্ধা পত্নীরই কর্তৃত্ব থাকে এবং সেই সম্পত্তির অধিকারিণী হয়। তার মৃত্যুর পর উক্ত সম্পত্তি কন্যা সপত্নীর অধিকারগত হয়।
আরও পড়ুন: মীতৈ মণিপুরীদের বৈচিত্র্যময় বিয়ের রীতিনীতি
আর একটি সপত্নী গ্রহণ প্রথা আছে। সেটিকে ‘নকমা-রা’ বলা হয়। এই প্রথায় বৃদ্ধা পত্নী নিঃসন্তান হলে স্বামী একজন যুবতী পত্নী গ্রহণ করে। বৃদ্ধার মৃত্যুর পর যুবতী পত্নী সম্পত্তির উত্তরাধিকারিণী হয়। কিন্তু বৃদ্ধার মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত যুবতী পত্নী রান্নাবান্না ও জমির কাজকর্মাদি করে থাকে যা বৃদ্ধা আর করতে পারে না। যদি উভয় পত্নীরই মৃত্যু হয়, তবে তাদের সগোত্র আত্মীয়বর্গ বিপত্নীককে আর একটি পত্নী দিতে বাধ্য থাকে।
শেক্কা
শেক্কা বিয়ে বলতে বোঝায় নারী-পুরুষ স্বামী-স্ত্রী হিসেবে একে অপরকে নিজ ইচ্ছায় গ্রহণ করে বসবাসের জন্য অন্য কোথাও চলে যাওয়া। যদি অবিবাহিতদের মধ্যে শেক্কা বিয়ে ঘটে তবে আ’খিম বা মিমাংসার বাধ্যবাধ্যকতা থাকে না। তখন সাধারণত কোনো জরিমানা করা হয় না এবং তাদেরকে স্বামী-স্ত্রী হিসেবে বাস করতে দেওয়া হয়। কিন্তু কখনো কখনো নারী-পুরুষ উভয়কে জোরপূর্বক পৃথক করা হয় এবং তাদেরকে প্রহার করা হয়। যদি একপক্ষ বিবাহিত ও অন্যপক্ষ অবিবাহিত হয়, বিবাহিত পক্ষের আত্মীয়বর্গ অবিবাহিত পক্ষের আত্মীয়বর্গের কাছ থেকে জরিমানা আদায় ও ভোগ করে। যদি উভয় পক্ষ বিবাহিত হয়, তবে উভয় পক্ষেরই আত্মীয়বর্গ জরিমানা দিতে বাধ্য।
দোবিকদোকা
সাধারণত অবিভাবকরা যে বিবাহের আয়োজন করে তাকে বলা হয় দোবিকদোকা। এই প্রথায় সাধারণত মামাতো-পিসতুতো ভাইবোনদের মধ্যে হয়। বিবাহের দিন পাত্র আড়ালে থাকে। বিবাহের লগ্নে উৎসাহী যুবকরা পাত্রকে ধরে এনে একটি ঘরে আটকে রাখে। প্রথানুসারে পাত্ররা প্রথমে এই বিবাহে রাজী হয় না এবং পালিয়ে যায়। এরপর যুবকরা পাত্রকে পুনরায় ধরে পাত্রীর সঙ্গে একটি ঘরে আটকে রাখে। এবারও পাত্র পালিয়ে যায়। তৃতীয় দিন তাকে ধরে আনে। পাত্র যদি একেবারেই পাত্রীকে পছন্দ না করে, তবে বিবাহ বাতিল হয়ে যায়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত রাজি হলে, বিবাহ হয় এবং পাত্রীর সঙ্গে রাত্রিযাপন করে।
আরও পড়ুন: সমুদ্রে ভেসেই জীবন পার, নৌকাই তাদের ঘরবাড়ি
বিধবা বিবাহ
গারোদের ভেতরে বিধবা বিবাহ প্রচলিত আছে। এক্ষেত্রে মৃত স্বামীর আত্মীয়দের ভেতরে কাউকে বিবাহ করতে হয়। সাধারণত মৃত স্বামীর ছোট ভাইয়ের সঙ্গেই বিবাহ হয় বিধবা নারীর। বহুবিবাহ গারো সমাজে নেই। তবে কোনো কারণে কোনো পুরুষ দ্বিতীয় বিবাহ করতে চাইলে, তাকে প্রথম স্ত্রীর অনুমতি নিতে হয়। এক্ষেত্রে সংসারে প্রথম স্ত্রীর অধিকার সবচেয়ে বেশি থাকে।
ঠ্যাং ধরা বিয়ে
গারোদের মাঝে একসময় ঠ্যাং ধরা বিয়ে নামক এক ধরনের বিয়ের প্রচলন ছিল। কনে খুব ছোট থাকা অবস্থায় এ ধরনের বিয়ের অনুষ্ঠান করা হতো। বিয়ের দিন কনের মা কনেকে কোলে নিয়ে বিয়ের কুটিরে বসত। বর এসে গ্রাম্য মোড়ল ও আত্মীয়স্বজনের সামনে কনের মায়ের ঠ্যাং বা পা ধরে বিবাহের স্বীকৃতি দিত এবং শাশুড়িকে নববধূসহ নিজ গৃহে যেতে অনুরোধ করত। মেয়ে বড় না হওয়া পর্যন্ত তার মা-বাবা তার রক্ষণাবেক্ষণ করত। এমনকি মেয়েসহ মা জামাতার বাড়িতে অবস্থান করত। সহায়-সম্পত্তির মালিকানা নির্ণয় কিংবা সমাজের আত্মমর্যাদা লাভের জন্য আদিবাসী সমাজে একসময় এ ধরনের বাল্যবিবাহের প্রচলন ছিল। যদি কোনো বাবার একমাত্র মেয়ে থাকে এবং যদি তার শরিকদের সে সম্পত্তি ভোগদখল করার সম্ভাবনা থাকে; তবে সে ক্ষেত্রে মেয়েকে এ ধরনের বিয়ে দেওয়া হতো। যাতে করে সম্পত্তির মালিকানা একমাত্র মেয়ে ও জামাতাই হতে পারে। তবে বর্তমানে এ ধরনের বিয়ে তেমন দেখা যায় না।
লেখক: ফিচার লেখক ও গণমাধ্যমকর্মী
কেএসকে/জেআইএম