ভিডিও EN
  1. Home/
  2. ফিচার

যে কারণে বাল্যবিবাহ বাড়ছে

ফিচার ডেস্ক | প্রকাশিত: ০৪:১৩ পিএম, ০৮ জুলাই ২০২৩

মামুন রাফী

বিশ্ব সমাজব্যবস্থায় বিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। যার মাধ্যমে নারী-পুরুষের সুখ-শান্তি, প্রেম-প্রীতির মধুরতম বন্ধন সৃষ্টি হয়। এর মাধ্যমে মানব বংশের স্থায়িত্ব ও সভ্যতার বিকাশ ঘটে। তবে বাল্যবিবাহ দেশ ও জাতির জন্য অভিশাপ। পৃথিবীর যে কয়টি দেশে বাল্যবিবাহের প্রবণতা বেশি, বাংলাদেশ তার মধ্যে অন্যতম। আমাদের দেশে বেশিরভাগ মেয়ের বিয়ে হয় ১২-১৮ বছরের মধ্যে। বিয়ের ১৩ মাসের মধ্যেই ৬৫% নারী সন্তান ধারণ করেন। গ্রামের নারীদের বেশিরভাগই বিয়ের এক বছরের মধ্যে সন্তান জন্ম দেন।

এসব বাল্যবিবাহের অধিকাংশ কারণ হচ্ছে- দরিদ্রতা, সচেতনতার অভাব, প্রচলিত প্রথা ও কুসংস্কার, সামাজিক অস্থিরতা, মেয়েশিশুর প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি, নিরাপত্তার অভাব, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, যৌতুক প্রথা এবং বাল্যবিবাহ রোধ-সংক্রান্ত আইনের যথাযথ প্রয়োগ না হওয়া। বাল্যবিবাহের কারণে অপরিণত বয়সে সন্তান ধারণ, মাতৃমৃত্যুর হার বৃদ্ধি, স্বাস্থ্যহানী, তালাক, পতিতাবৃত্তি, অপরিপক্ব সন্তান প্রসবসহ নানাবিধ জটিলতার শিকার হচ্ছে।

আরও পড়ুন: সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের পাশে মানবিক পাঠশালা

১৯২৯ সালে বাল্যবিবাহ আইন প্রণয়ন করা হলেও এখনো গ্রাম-গঞ্জ-মফস্বল এলাকাসহ সারাদেশে বাল্যবিবাহ হচ্ছে অহরহ। এ আইনে বাল্যবিবাহের সংজ্ঞায় ছেলেমেয়ের বিয়ের বয়স নির্ধারণ করা হয়েছে। নির্ধারিত বয়সের নিচে পক্ষদ্বয়ের যে কোনো একজন হলেই সেটি বাল্যবিবাহ হিসেবে গণ্য। দেশে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ কল্পে আইন বিদ্যমান। সরকার এবং বেসরকারি সংস্থাগুলো বিভিন্ন রকম কর্মসূচিও পরিচালনা করছে। তবুও বাল্যবিবাহ অব্যাহত আছে। বেশিরভাগ বিয়ে আইনের পশ্চাতে এবং গোপনে হচ্ছে বলে এর সঠিক পরিসংখ্যানও নেই। এর মধ্যে ঢাকার বস্তিতে থাকা ৮০ ভাগ কন্যাশিশু বাল্যবিবাহের শিকার হচ্ছে। বালকদের মধ্যে এই হার কিছুটা কম। এই বাল্যবিবাহের মূলে আছে সুপাত্র প্রাপ্তি, দরিদ্রতা এবং যৌন হয়রানির ভয়। নানা ধরনের প্রতিরোধ-প্রতিবাদ সত্ত্বেও বাল্যবিবাহ রোধ করা যাচ্ছে না।

বিশ্বে প্রতি ৭ সেকেন্ডে ১৫ বছরের কম বয়সী একটি কন্যাশিশুর বিয়ে হয়। বাংলাদেশে ১৮ বছরের আগে ৫৯ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হয়। ১৫ বছরের আগে বিয়ে হয় ২২ শতাংশ মেয়ের। ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সী মেয়েদের শতকরা ৩১ জন সন্তানসম্ভবা হয়। করোনা মহামারির মধ্যে সারাদেশে বাল্যবিবাহের হার অনেক বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের অনুসন্ধান অনুযায়ী, ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে অক্টোবর পর্যন্ত দেশের ২১টি জেলার ৮৪ উপজেলায় ১৩ হাজার ৮৮৬টি বাল্যবিবাহ হয়েছে। প্রতিদিন গড়ে ৬৫টি করে বাল্যবিবাহের ঘটনা ঘটেছে। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বাল্যবিয়ে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় হারের দিক থেকে সর্বোচ্চ এবং বিশ্বে চতুর্থ। ব্র্যাকের অনুসন্ধান অনুযায়ী, মহামারির কারণে ১৩ শতাংশ বাল্যবিবাহ আগের চেয়ে বেড়েছে এবং এটি গত ২৫ বছরে বাংলাদেশে বাল্যবিয়ের সর্বোচ্চ হার। ৬৮ শতাংশ বাল্যবিয়ে বন্ধ হয়েছে ২০২০ সালে প্রথম ১০ মাসে।

আরও পড়ুন: শিশুর বিকাশে গাছের ভূমিকা

জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফের তথ্য অনুযায়ী, বাল্যবিয়ের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ শীর্ষস্থানীয়দেশগুলোর অন্যতম। বাংলাদেশে ১৮ শতাংশ মেয়ের ১৫ বছর বয়সের মধ্যে বিয়ে হয়। ইউনিসেফের মতে, বর্তমানে বিশ্বে ৭০ কোটি মেয়ে বাল্যবিয়ের শিকার। এ ধারা চলতে থাকলে ২০৩০ সালের মধ্যে এ সংখ্যা বেড়ে ৯৫ কোটিতে পৌঁছাতে পারে। সেভ দ্য চিলড্রেনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ১৫ বছরের কম বয়সী বিবাহিত মেয়েদের ২০ শতাংশ ২৪ বছর বয়স হওয়ার আগেই দুই বা ততোধিক সন্তানের মা হচ্ছেন। ফলে প্রসূতির মৃত্যুর হার এবং অপুষ্টিজনিত সমস্যা প্রকট হচ্ছে। বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক হেলথ সার্ভের তথ্য অনুযায়ী, এক দশক ধরে বাংলাদেশে ৬৬ শতাংশ ক্ষেত্রে ১৯ বছর বয়সের আগেই বাল্যবিয়ের শিকার নারীরা অন্তঃসত্ত্বা হচ্ছে।

বাল্যবিবাহ রোধে প্রয়োজন সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি আইনের কঠোর প্রয়োগ। বাল্যবিবাহ বন্ধে যে পদক্ষেপগুলো নেওয়া জরুরি- শিশুর জন্ম নিবন্ধীকরণ আইন মেনে চলা, বিয়ের রেজিস্ট্রেশন নিশ্চিত করা, বহুবিবাহ রোধ করা। বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে সমন্বিত ও পূর্ণাঙ্গ একটি আইন তৈরি করা একান্ত জরুরি। এছাড়া মেয়েদের শিক্ষা ও সচেতনতা বৃদ্ধির দিকে নজর দিতে হবে।

আরও পড়ুন: হাওয়াই মিঠাইয়ের একাল-সেকাল

বাল্যবিয়ে বন্ধে সরকারের সব মন্ত্রণালয়-বিভাগের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে হবে। জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ের কমিটিকে আরও উদ্যোগী হতে হবে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, শিক্ষক, ইমাম, ধর্মীয় নেতা, এনজিও প্রতিনিধি ও কমিউনিটি নেতৃবৃন্দকে সঙ্গে নিয়ে বাল্যবিয়ে রোধ করতে হবে। বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে জোরদার সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। বাল্যবিবাহ রোধে সবাইকে যার যার অবস্থান থেকে সোচ্চার হতে হবে। জনসচেতনতা তৈরি করতে পারলে সমাজ থেকে বাল্যবিবাহ নিরোধ করা সম্ভব।

লেখক: কবি ও সাংবাদিক।

এসইউ/জেআইএম

আরও পড়ুন