আব্বার জন্য আমার চোখ দুটি ঝরনাধারা
মুহম্মদ রাসেল হাসান
কবির ভাষায়, ‘ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা, সব শিশুরই অন্তরে’। বাবা সব সন্তানের অন্তরে বাস করে, আর একদিন সব খোকারাও একজন বাবা হয়ে ওঠে। বাবারা সিনেমার হিরোর মতো। এরা শুধু দিয়েই যায়, প্রকাশ করতে চায় না। পৃথিবীতে কোনো দুষ্টু পিতা আছে বলে আমার মনে হয়না। হুমায়ূন আহমেদ তাই হয়তো বলেছিলেন, ‘পৃথিবীতে অনেক খারাপ মানুষ আছে, কিন্তু একটিও খারাপ বাবা নেই’। আজ বাবা দিবসে আমি আমার বাবাকে নিয়ে লিখবো।
বাবা সব সন্তানের বেঁচে থাকার একটি অবলম্বনের নাম, বাবা একটি বটবৃক্ষের নাম। যে বটবৃক্ষ নিজে প্রখর সূর্যতাপে পুড়ে পরিবারকে তার সুশীতল ছায়ায় রাখে। আমার বাবাকে আমি আব্বা ডেকেই অভ্যস্ত। আশ্চর্যজনকভাবে তাকে আমি কতটা ভালোবাসি তা কখনো বুঝাতে পারিনা। বরং যতটা ভালোবাসি, আমার কথাবার্তায় বা কর্মকাণ্ডে ঠিক যেন তার বিপরীতটা প্রকাশ পেয়ে যায়। এতে বাবা খুব মর্মাহত হন, মাঝে মাঝে কাঁদেনও। এটা পরিবারের সবাই দেখে। কিন্তু আমার নির্জন বোবা কান্না কেউ দেখেনা। বাবাকে অনাকাঙ্ক্ষিত কষ্ট দেওয়ার পর সেই অনুশোচনায়, সেই ক্ষোভে, সেই ঘৃণায় আমি নিজেকে ধিক্কার দিতে দিতে আত্মাকে ক্লান্ত করে ফেলি। বলুন, শুধু বিষ খেয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেই আত্মহত্যা হয়? আমি যে একলা রোজ এভাবে আত্মাকে পুড়াই, এটা কি আত্মহত্যা না? আব্বা রোজ পাঁচবার করে আমাকে কল করেন। ঢাকায় আসার পর থেকে আরও বেশি করতেন। কিন্তু কোনো এক অভিমানে এখন টানা ২৪ দিন ধরে কথা হচ্ছেনা। এতে ২৪ দিনে ছয়বার করে কথা না হওয়ার যন্ত্রণা বেড়ে ১৪৪ গুণে দাঁড়িয়েছে। আব্বা নিশ্চয়ই রাত বিরাতে কাঁদছেন। কারণ যে পিতা বাড়ি থেকে নেত্রকোণা জেলা শহরে অর্থাৎ সাত-আট কিলোমিটার দূরে গেলে পথিমধ্যেই তিনবার কল করতেন। এখন রাজধানীর এপার-ওপার যে ঘুরে বেড়াচ্ছি তবুও তিনি কল করছেন না, অবশ্য এটা আমার দিক থেকেই ডিভাইসে একটা সিস্টেম সচল করে রেখেছি যাতে ওপার থেকে কল না করতে পারেন।
কিন্তু এই যন্ত্রণায় রাত দ্বিপ্রহরে আমিও ভেতরটা চুরমার করে কাঁদতে কাঁদতে শেষরাতে ক্লান্ত হয়ে ঘুমের রাজ্যে যাই। আর গোসলের জন্য যখন বাথরুমে যাই তখন আমার দুটি চোখও কৃত্রিম ঝর্ণার সমার্থক হয়ে ওঠে। এভাবেই কাটছে আব্বাকে মনে করা ‘আমার ভীষণ ভালো সময়’।
আরও পড়ুন: বাবা, আস্থা ও নির্ভরতার শেষ ঠিকানা
আমি উপলব্ধি করছি-পাহাড়কে দেখতে চাইলে একটু দূর থেকে দেখতে হয়। কাছ থেকে পাহাড়ের বিশালতা দেখা যায় না। আব্বার সঙ্গে অনেক অভিমান হয়েছে। কিন্তু কখনো দু'দিনের বেশি সে অভিমান থাকেনি। এবারই আমার জীবনে আব্বার সঙ্গে প্রথম অভিমান, যে অভিমানে টানা ২৪ দিন ধরে পরিবারের সঙ্গেই যোগাযোগ নেই। আম্মাসহ সবার জন্যই ভয়াবহ ধরনের কষ্ট হচ্ছে এবং সে কষ্টে একেকবার শ্বাসরুদ্ধ হয়ে যেতে চায়। তবে আজ যেহেতু বাবা দিবস তাই বাবাকে শুধু নিয়েই লেখা সমীচীন।
এবার আব্বার সঙ্গে সুখকর ঘটনার কথা বলি। আমাকে লেখালেখির দিকে আব্বা আনেননি ঠিক। কিন্তু শৈশবে বইপত্রের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন তিনিই। ঢাকা থেকে প্রতিবার বাড়িতে গেলেই দু'একটা ম্যাগাজিন এবং পুরাতন কয়েকটা পত্রিকা নিয়ে যেতেন। এগুলো কি আমার জন্য আনা হতো কি না এখনো জানিনা। কিন্তু আব্বা আসলে প্রথমেই আমি ব্যাগ খুলে ম্যাগাজিনগুলো নিয়ে পড়া শুরু করতাম। পত্রিকার সাহিত্য পাতাগুলো বেশি পড়তাম। আর ম্যাগাজিনের অনেক লেখা বুঝতাম না। তবে পড়তে ভালোই লাগতো। কারণ লেখাগুলো আমার অনুধাবনের ক্ষমতা না থাকলেও মনের গিটারে বাজানোর ক্ষমতা ছিল। এখনকার বইয়ের নেশার একটা কারণ হয়তো শৈশবে আব্বার পত্রিকা, ম্যাগাজিন ও মাঝে মাঝে বাড়িতে বই নেওয়ার ফলপ্রসূই। আমি এটাকে আমার জীবনের একটা উল্লেখযোগ্য ব্যাপার মনে করি।
আরেকটি ঘটনার কথা বলতে হয়। এই যে এখন ঢাকায় চলে আসছি। এটা আব্বা চাচ্ছিলেন না। কিন্তু ঢাকায় থাকার কারণও আবার তিনিই। কারণ ক্লাস সেভেনে পরীক্ষা দেওয়ার পর আমি যখন ঢাকা থেকে ঘুরে যেতে নাছোড়বান্দা তখন সব আবদার পূরণের মতো আব্বা আমার এই আবদারটিও পূরণ করেছিলেন। তার কমলাপুরের ভাড়া বাসায় ১২ দিন ছিলাম। একদিন রাতে এক হাতে জানালার শিক ধরে অন্য হাতে বাটন ফোনে রেডিওর চ্যানেল পাল্টাতে পাল্টাতে দেখছি ব্যস্থতম শহরে দ্রুততম চলমান লাল, নীল, হলুদ রঙের বাতি লাগানো বাহনগুলো। আব্বা বলছেন, ‘রাজ্জাক-অঞ্জনার ‘অশিক্ষিত’ নামে সিনেমা আছে। এটাতে একটা গান আছে’। সঙ্গে সঙ্গে রেডিওর একটি চ্যানেলেও বেজে উঠলো ‘ঢাকা শহর আইসা আমার আশা ফুরাইছে। আরে লাল লাল, নীল নীল বাতি দেইখা নয়ন জুড়াইছে’। আমি একটু হাসলাম। কী কাকতালীয় ব্যাপার! দু'জনেই নীরব হয়ে জানালার দিকে তাকিয়ে সরব গানটি শুনে নিলাম। প্রতিদিন বিকেলে তিনি আমাকে নিয়ে ঘুরতে বের হতেন। সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, শিখা চিরন্তন, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, জাতীয় জাদুঘর, টিএসসি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ উল্লেখযোগ্য জায়গাগুলোর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি জানেন না যে সুন্দরের প্রতি আমার আজন্ম দুর্বলতা। সুন্দরের প্রতি আমি অহর্নিশ যে হই নত, অবনত এবং বিনয়াবনত।
তখনই ‘পড়াশোনা করতে ঢাকায় চলে আসবো, এসে কলাভবনের আশপাশ চষে বেড়াবো, নীলাক্ষেতে বইয়ের রাজ্যে মাঝে মাঝে হারিয়ে যাবো, চায়ের কাপে চুমুকে চুমুকে কাটাবনের সাহিত্য আড্ডায় নিমজ্জিত হয়ে যাবো, ইচ্ছে হলেই নজরুলের সমাধির কাছে গিয়ে গলা ছেড়ে আবৃত্তি করবো’-সঙ্গোপনে এই স্বপ্নের বীজ বপন করে ফেলেছিলাম। আজ তা হচ্ছেই।
আমি মাঝে মাঝে ভাবি, প্রভাব জিনিসটা আসলে কতটা মারাত্মক। এই যে ছোটবেলায় যা দেওয়া হয়, যা দেখানো হয়-সেটা মানুষের চিত্তরঞ্জন বা মনোরঞ্জন করে ফেলে। আর ভবিষ্যতটাও সেদিকেই ধাবমান হওয়ার উপক্রম তৈরি হয়।
আরও পড়ুন: বাবার হাতের ‘হারকিউলিস’
এবার আমার আব্বার সঙ্গে আপনাদের পরিচয় করিয়ে দিই। তার পুরো নাম মোঃ সিদ্দিকুর রহমান। বয়স বাংলাদেশের মতোই। তিনি একজন বাংলাদেশ আনসার বাহিনীর গর্বিত সদস্য বা সৈনিক। দেশের জন্য তার অবদান যেমন আছে, তেমনই পরিবারের জন্যও যে কত গুরু দায়িত্ব ও কর্তব্য তিনি পালন করছেন, তা অনস্বীকার্য। আব্বা আমার সব চাওয়াই পূরণ করতে সবসময় সর্বোচ্চ চেষ্টা করেন। আমাকে পূর্ণতা দিতে, তিনি অনেক সময় অপূর্ণ থাকেন-নিজের শূন্যতার কথা তিনি বুঝতে দেন না। তবে আমার দৃষ্টি এড়ায় না। আমি শুধু ভবিষ্যতের কাছে করুণ দৃষ্টিতে তাকাই। আল্লাহকে মনে মনে বলি, আল্লাহ আমার স্বপ্নগুলো পূরণ করো। আমি যেন আব্বাকে শান্তি দিতে পারি, পরিবারকে দিতে পারি এক টুকরো স্বর্গ আর দেশকে দিতে পারি নিজেকে বিসর্জন দিয়ে।
আজ আর লিখবোনা। শুধু লিখবো-আমি কত বোকা! কত অকর্মণ্য! কত ভালোবাসি আব্বাকে তবু বুঝাতে পারিনা। কাছে থেকেও আরও কাছে যেতে পারিনা। আমার মাঝে মাঝে খুব করে ইচ্ছে করে তাকে জড়িয়ে ধরে বলি, ‘আব্বা, হয়নি বলা একটি কথা ভালোবাসি তোমাকে’।
লেখক: শিক্ষার্থী, তরুণ কবি, প্রতিষ্ঠাতা বইবন্ধু পাঠাগার।
কেএসকে/এএসএম