বিলুপ্তির পথে মণিপুরীদের ঐতিহ্যবাহী কোমর তাঁত
রফিকুল ইসলাম জসিম
বাংলাদেশের অন্যতম ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী মণিপুরী সম্প্রদায় সিলেটের বিভিন্ন এলাকায় বসবাস করে। আঠারোশ শতক থেকে এই এলাকায় মণিপুরীদের বসবাস শুরু হয়। এ সম্প্রদায়ের আদি নিবাস ভারতের মণিপুর রাজ্যে। মণিপুরী নারীদের সুখ্যাতি রয়েছে তাদের হাতে বোনা তাঁতের কাপড়ের জন্য।
দেশের প্রাচীন হস্তশিল্পগুলোর মধ্যে মণিপুরী হস্তশিল্প সু-প্রসিদ্ধ। মণিপুরীদের কাছে যা অনেকটা উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে এই জনগোষ্ঠীর অতি প্রাচীন কোমর তাঁতশিল্প আজ বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে। এক সময় সব বাড়িতেই শোনা যেত তাঁত বুননের খটখট শব্দ। এখন তা নেই।
সুতার বিম একটু উঁচু কিছুর সঙ্গে বেঁধে, কাপড়ের বিমের সঙ্গে দড়ি বা বেল্ট বেঁধে সেই দড়ি বা বেল্ট কোমরের সঙ্গে পেঁচিয়ে টান টান করে কাপড় বোনা হয় কোমরতাঁতে। এই তাঁতের গঠনকাঠামো খুবই সরল। কখন, কোথায় এই তাঁতের জন্ম হয়েছিল, সেটা জানা যায় না।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, মণিপুরী বয়নশিল্পের ইতিহাস খুবই প্রাচীন। দ্বাদশ শতাব্দীর দিকে ভারতের মণিপুরে মোইরাং অঞ্চলে বস্ত্র বয়নশিল্প যথেষ্ট উৎকর্ষ লাভ করেছিল। সেই সময় মোইরাং মণিপুরী রাজকন্যা থোইবীর হাতে বোনা কাপড় উৎকর্ষে এবং মিহি কারুকাজে এতোটাই মুগ্ধকর ছিল যা এখন ও মণিপুরের যাদুঘরে রাখা আছে।
স্থানীয় তাঁতি ও বিশেষজ্ঞদের মতে, তাঁতের কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধি ও প্রযুক্তিগত সমস্যা, কোমরতাঁত তৈরিতে কম আয়, হস্তশিল্প থেকে যান্ত্রিক শিল্পের পরিবর্তন, পর্যাপ্ত মূলধনের অভাব এ শিল্পে সরকারি সহযোগিতা অপর্যাপ্ত এবং আধুনিক ডিজাইনের মণিপুরী শাড়ি তৈরিতে যুক্তথাকায় ও বাজারজাতকরণের সমস্যা অন্যতম কারণ।
আরও পড়ুন: মণিপুরী নৃত্যকে সারাবিশ্বে ছড়িয়ে দেন কবিগুরু
মণিপুরী ভাষায় তাঁতকে বলে ‘ইয়োং’। ইয়োং আবার দুই ধরনের। খোয়াং ও পাং। খোয়াং বা কোমর তাঁতে ফানেক, বিছানার চাদর, শাল ইত্যাদি তৈরি হয়। এই তাঁতে সাধারণত মোটা সুতার কাপড় তৈরি করা হয়। ফানেক (কোমর পর্যন্ত প্যাঁচানো কাপড়) বিভিন্ন ডিজাইন আছে যেমন-লাই, সালু, হাংগামপাল, সোনারং, চুমহাপ্পা, মকং (বিভিন্ন ধরনের রং ও কাজ করা) ইত্যাদি। বিবাহিত মেয়েরা লৈফানেক আরলবা, লৈফানেক মায়াইরনবি, সালু ফানেক আরনবা, লৈচিল ফানেক, উরেং আরনবা, উরেং চুমহাপ্পা, লৈচিল উরেং (বুক পর্যন্ত প্যাঁচানো বিভিন্ন রং ও ডিজাইনের কাপড়) ইত্যাদি পরিধান করে থাকে। মনিপুরী মেয়েদের কোমর তাঁতে কাপড় বোনা এবং তাদের পরিধেয় ফানেক বা চাকসাবির উপর সুঁই সুতার সুক্ষ কারুকাজ দেখলে বিস্মিত হতে হয়। তাদের নিপুণ হাতে গড়া কাপড়ের আঁচলে গাঁথা আর পরতে পরতে আঁকা রং-বেরঙের নকশাগুলো যেন সহসাই মনে করিয়ে দেয় মনিপুরী সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের কথা।
অন্যদিকে পাং অনেকটা চিত্তরঞ্জন তাঁতের মতোই। তবে গঠন প্রণালীতে কিছুটা পার্থক্য আছে। বর্তমানে মণিপুরীরা বেশিরভাগ পাং (তাঁত) ব্যবহার করছে। এই তাঁতে মণিপুরী শাড়ি, বিছানার চাদর, গামছা, ওড়না, ফানেক ইত্যাদি কাপড় বোনা যায়। পাং তাঁতে সাধারণত চিকন সুতার কাপড় তৈরি করা হয়।
আদমপুর, মাধবপুর, ইসলামপুর ও তিলকপুরের বেশ কয়েকজন মণিপুরী তাঁতি সম্প্রদায়ের মাঝে নারীদের তাঁতশিল্পে জড়িত হাওয়ার কারণ অনুসন্ধানে জানা যায়, বংশ পরস্পরায় চলে আসছে, অন্য কোনো কাজ শিখেনি বলে, অন্যান্য কাজে জড়িত হাওয়ার সুযোগ নেই, তাদের নিজস্ব কাপড় কিনতে পাওয়া যায় না। পরিবারে আর্থিক লাভবানের উদ্দেশ্যে মণিপুরী নারী তাঁত পেশা পছন্দ করেন।
স্থানীয় তাঁতিরা অভিযোগ করে জানান, তাঁত বোর্ড থেকে তাদের অনেকে তাঁতি ঋণ ও প্রশিক্ষণ পান। সেটা তাদের কাজে লাগে। এর বাইরে তাঁত বোর্ড তেমন ভূমিকা রাখতে পারছে না। কোমর তাঁত কমে যাওয়ার বড় কারণ তাঁতিদের আয় কমে যাওয়া। সুতার দামই তাঁতিদের বেশি বিপাকে ফেলে। এখানে রয়েছে দাদন ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্য, যে কারণে সঠিক মূল্য পাচ্ছেন না প্রান্তিক তাঁতিরা। এ শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে উপযুক্ত মূলধন, প্রয়োজনীয় কাঁচামাল ও বাজারজাত করার ব্যবস্থা প্রয়োজন মনে করছেন অনেকে। বিচ্ছিন্নভাবে গড়ে ওঠা তাঁতিদের একটি জায়গায় নিয়ে এলে শিল্পটি লাভের মুখ দেখবে বলেও ধারণা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের।
কোমর তাঁত শিল্পকে নিজেদের ঐতিহ্য বলে স্বীকার করলেও অনেক তাঁতি তাঁতের শাড়ি তৈরি করে বেশি দামে বিক্রি করতে পারলে নিজের সার্থকতা মনে করেন। কোমর তাঁতে তৈরি কাপড়গুলো মণিপুরীদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক। নিজস্ব পোশাকের ঐতিহ্য ধরে রাখতে নিজেদেরই সচেতন হতে হবে বলে মনে করেন মণিপুরী নারী উদ্যোক্তা জাহুরা আক্তার।
চিঙলেনের স্বত্বাধিকারী মনিতা চানু বলেন, নিজেদের ঐতিহ্য মণিপুরী পণ্য টিকিয়ে রাখার দায়িত্ব আমাদের নিজেদের। মণিপুরী তাঁত শিল্প উন্নতি হলেও বিভিন্ন কারণে কোমর তাঁতে বোনা আজ বিলুপ্তির পথে। আগামী প্রজন্মের জন্য আমাদের শিল্পকে ধরে রাখার দায়িত্ব আমাদের সবার। এক্ষেত্রে সরকার ও তাঁতবোর্ডের ভূমিকা রাখতে হবে।
মণিপুরী তাঁত শিল্পের জন্য সিলেটের মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল ও কমলগঞ্জ উপজেলা প্রসিদ্ধ। সেখানে কমলগঞ্জে মাধবপুর ইউনিয়নের হিরামতি এলাকায় বাংলাদেশ তাঁতবোর্ডের বেসিক সেন্টার রয়েছে। সেন্টারের লিয়াজো অফিসার (অতিরিক্ত) আজহারুল ইসলাম জানান, সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, জেলার আওতাধীন ২০১৮ সালে সর্বশেষ তাঁত শুমারিতে সিলেট বিভাগে ৩ হাজার ৫০০ জন তাঁতি রয়েছে। কোমর তাঁতে আলাদা তাদের কোনো পরিসংখ্যান নেই। সিলেটের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীসহ সব তাঁতিদের কল্যাণে তারা কাজ করে যাচ্ছেন। তিনি আরও জানান, এই পর্যন্ত ক্ষুদ্র তাঁতিদের ঋণ দিয়েছেন ১ কোটি ৬২ লাখ টাকা। এছাড়া আর্থ সামাজিক অবস্থা উন্নয়নের লক্ষ্যে চলতি মূলধন সরবরাহ, বন্ধ হয়ে যাওয়া তাঁত চালু করা এবং তাঁতের আধুনিকায়ন প্রকল্পে এ পর্যন্ত তাঁতিদের ২৩ লাখ টাকা ঋণ দিয়েছেন তারা।
আরও পড়ুন: বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীদের বৈচিত্র্যময় বিবাহ প্রথা
মণিপুরী তাঁতিদের সংগঠক সমরজিত সিনহা বলেন, বাংলাদেশের তাঁত বস্ত্রের রয়েছে সোনালি ঐতিহ্য। আমাদের মণিপুরীদের ঐতিহ্যবাহী শিল্প কোমর তাঁত বর্তমানে পৃষ্ঠপোষকতা, রক্ষণাবেক্ষণ, দিকনির্দেশনা এবং উন্নত যন্ত্রপাতির অভাবে এই তাঁতশিল্প হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এতে মণিপুরীদের ইতিহাস ও ঐতিহ্য দুটিই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সরকারের একটু শুভ দৃষ্টির মাধ্যমেই সম্ভব কোমর তাঁত শিল্পকে ধরে রাখা। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ তাঁত বোর্ডের যথাযথভাবে সহযোগিতা প্রয়োজন।
কমলগঞ্জ উপজেলা মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান জনাব বিলকিস বেগম বলেন, দেশের তাঁত শিল্পের উন্নয়নে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবদান অপরিসীম। বঙ্গবন্ধুর হাত ধরে বাংলাদেশ তাঁত বোর্ড গঠিত হয়। বর্তমান সরকার দেশের লাখ লাখ গরিব ও নিঃস্ব তাঁতিদের আর্থ সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন ত্বরান্বিত করার কাজ করছেন। মণিপুরীদের ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতে সরকারের পাশাপাশি অন্যান্য ব্যাংকগুলো মণিপুরী তাঁতিদের বিনা সুদে ও জামানতে পর্যাপ্ত ঋণের সুবিধা এবং বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষকতা প্রয়োজন। তিনি আরও বলেন, কোমর তাঁতে একটি কাপড় তৈরি করতে এখন যে পরিশ্রম, সময় ও অর্থ ব্যয় হয় হাটবাজার থেকে তারচেয়ে অনেক কম দামে আধুনিক পোশাক-পরিচ্ছদ কেনা যায়। যদিও আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে তৈরি ও বাজারজাতকরণে সহযোগিতা পেলে কোমর তাঁত আরেক সম্ভাবনাময় শিল্প হবে।
বাংলাদেশ মণিপুরী সমাজকল্যাণ সমিতির সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা আনন্দ মোহন সিংহ বলেন, কোমর তাঁত মণিপুরীদের ঐতিহ্যবাহী তাঁত। আমাদের মেয়েরা ১২ বছর পর মায়েদের সঙ্গে তাঁতবোনা শিখতে শুরু করে। বর্তমানে কোমর তাঁত হারিয়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ বাজারজাতকরণের সরকারি কোনো উদ্যোগ নেই। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ সরকার তাঁত বোর্ডের অধীনে মাধপুরের একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র করেছে, এজন্য ধন্যবাদ জানাই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে। তবে প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা কোমর তাঁত ব্যাপারে কোনো রকমের উদ্যোগ গ্রহণ করেন নাই। যদি এই তাঁতের তৈরি পোশাক বাজারজাতকরণ ও তাঁতিদের অর্থনৈতিক সাপোর্ট দেওয়া যায় তাহলে এই তাঁতকে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব।
তাঁত বোর্ডের সূত্রে জানা যায়, সরকার ২০১৮ সালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর শেখ হাসিনা মৌলভীবাজার কমলগঞ্জে বাংলাদেশ তাঁত বোর্ডের অধীনে কমলগঞ্জ বেসিক সেন্টারের অভ্যন্তরে তাঁতিদের প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে দক্ষতা বৃদ্ধি, কম সময়ে অধিক উৎপাদন, পরিবর্তন বাজারের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে ফ্যাশন ডিজাইনার প্রশিক্ষণ উপকেন্দ্র উদ্বোধন করেন। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে এই পর্যন্ত ২০০ জন তাঁতিকে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন।
মণিপুরীদের ঐতিহ্যবাহী কোমর তাঁত দিন দিন কমে যাচ্ছে? এনিয়ে জানতে চাওয়া হলে বাংলাদেশ তাঁত বোর্ডের উপ মহাব্যবস্থাপক রতন চন্দ্র সাহা জাগো নিউজকে বলেন, হস্তচালিত তাঁতের জায়গায় পাওয়ারলুম চলে আসায় অনেক তাঁতি ঝরে পড়েছেন। মণিপুরী তাঁতি পরিবারের ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা করে অন্য পেশায় যাচ্ছে। তবে তাঁতি কমলেও তাঁতের সংখ্যা কমেছে বলে তিনি মনে করেন না। কোমরতাঁত বিলুপ্তির প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, মণিপুরী সম্প্রদায়ের তাঁতিদের নিয়ে তাঁত বোর্ড অনেক বছর ধরে কাজ করছে। তাঁতি নেতাদের সঙ্গে অনেক সভা হয়েছে। কিন্তু মণিপুরীদের ঐতিহ্যবাহী কোমর তাঁত নিয়ে বিলুপ্তির পথে আজ পর্যন্ত কেউ এই বিষয়ে কোনো কথা বলেনি।
সিলেটের মণিপুরী তাঁত শিল্প এই সর্ববৃহৎ শিল্পের অন্যতম অংশীদার। বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা ও হিউয়েন সাংয়ের ভ্রমণ কাহিনিতেও মণিপুরী তাঁত শিল্পের উল্লেখ রয়েছে। সেদিক থেকে বলা যায়, মণিপুরীদের হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী কোমর তাঁত শিল্পের সৃজনশীলতা, নকশার বৈচিত্র্যময়তা, গুণগত মানসমৃদ্ধ পণ্যের সঙ্গে মণিপুরী সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের এক নিবিড় গূঢ় বন্ধন রয়েছে। এ নিবিড় গূঢ় বন্ধনের পুনরুজ্জীবিতকরণে মনিপুরী তরুণ সমাজকে এগিয়ে আসতে হবে। মণিপুরী তরুণ প্রজন্মদের ঐতিহ্যের শিক্ষা ও অনুশীলনে সম্পৃক্তকরণেই বিলুপ্তপ্রায় ঐতিহ্যের বির্নিমাণ সম্ভব।
লেখক: ফিচার লেখক ও গণমাধ্যমকর্মী।
কেএসকে/জেআইএম