সাগরের নিচে যেভাবে শুটিং হয়
এখন ডিজিটাল যুগ। ঘরে ঘরে, হাতে হাতে স্মার্ট স্যাটেলাইট টিভি। বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় স্যাটেলাইট টিভি- ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক চ্যানেল, ডিসকভারি ও ইউটিউবের বিভিন্ন চ্যানেলে সাগরের নিচের শুটিং আমরা ভিজ্যুয়াল পর্দায় উপভোগ করে থাকি। সাগরতলার ডকুমেন্টরিগুলো অদ্ভুত। জলজ প্রাণীদের রোমাঞ্চকর জীবন নিজ চোখে ডিজিটাল পর্দায় দেখে আমরা ভাবিত হই। এত ভিডিও ফুটেজ, চিত্র কীভাবে শুটিং করা হয়? সত্যিই সাগরতলের এই বাস্তব দৃশ্যগুলোকে চলচ্চিত্র আকারে তুলে আনতে অসীম সাহস আর নিখুঁত দক্ষতার পরিচয় দিয়ে যাচ্ছে মানুষ!
ক্যামেরা হাতে ডুবুরি গহীন সাগরের পানির তলায় ঠায় দাঁড়িয়ে থাকেন। যেখানে সাঁই সাঁই করে ছুটে আসে হাতুড়ি মাথার হাঙরগুলো। উপর-নিচ, ডান-বাম যেদিকেই তাকান শুধু হাঙর আর হাঙর। আর গোখরো সাপের থেকেও বেশি বিষাক্ত জেলিফিশ চারিদিকে কিলবিল করে। ঠিক এরকম পরিবেশেই কাজ করতে হয় আন্ডারওয়াটার মুভি মেকারদের। এরকম দুটো উল্লেখযোগ্য মুভি হচ্ছে ‘ডলফিনস’ এবং ‘আইল্যান্ড অব দ্য শার্কস’। হাঙরের ওপর তৈরি শেষোক্ত মুভিটিতে হাওয়ার্ড, মিচেল হ্যাল ও তাদের দলবল নিয়ে প্রায় ১৮শ ঘণ্টা থাকতে হয় সাগরের গভীর নিচে। এই ডকুমেন্টরি তৈরির জন্য তারা লোকেশন হিসেবে বেছে নেন প্রশান্ত মহাসাগরের ছোট্ট কাকোস আইল্যান্ডকে। এ দ্বীপের রেইন ফরেস্টের ঝরনাগুলো ভারি সুন্দর। কিন্তু হাওয়ার্ড আর মিচেল হ্যাল তাদের শুটিং নিয়ে বেশিরভাগ সময় ব্যস্ত ছিলেন পানির নিচে। পৃথিবীর অন্য যে কোনো অঞ্চলের চেয়ে এখানে হাঙরের সংখ্যা বেশি। এছাড়া স্টিংরে, মোরেইল আর সামুদ্রিক কাছিম এখানে পর্যাপ্ত পরিমাণে রয়েছে। সাগরতলের দৃশ্য ধারণের সময় শত শত হাঙরের মুখোমুখি হয়েছেন হাওয়ার্ড হ্যাল। আত্মরক্ষামূলক কোনো পোশাক ছিল না তার। তাই বলে একটুও ঘাবড়ে যাননি তিনি। হাওয়ার্ড বলেন, ‘এটা ছিল আসলে একটা অ্যাডভেঞ্চার। ওই হাঙরগুলো মোটেও আমাদের প্রতি আগ্রহী ছিল না। ওরা অন্য মাছের দিকেই ছুঁটেছে।’
আরও পড়ুন: নতুন উদ্যমে বাঁচার প্রেরণা জোগায়
সাগরতলার শুটিং বা আন্ডারওয়াটার শুটিং অনেকের কাছেই খুব মজার কাজ মনে হলেও প্রচুর কষ্ট রয়েছে শুটিংয়ের সময়। শুটিং যারা করেন, তাদের বলা হয় আন্ডারওয়াটার ভিডিওগ্রাফার। জলে-স্থলে রঙিন ছবি তোলার ডিজিটাল প্রযুক্তি আবিষ্কার ও ব্যবহারের ক্ষেত্রে অন্যতম পথিকৃৎ মার্কিন আলোকচিত্রী লুইস মার্ডেন। তিনি বলেন, ‘সাগরের নেশা আমাকে বারবার টেনে নিয়েছে সেই নীল দিগন্তের ওপারে। বিশাল আকৃতির ভারত মহাসাগরের একটি বিন্দুর নাম অ্যাজাম্পশন দ্বীপ। এটি মাদাগাস্কারের ২৪০ মাইল উত্তরে। দ্বীপটিতে কিছু মানুষের বাস। দ্বীপের সাদা বালু ও ঝোপ ততটা আকর্ষণীয় নয়। এই দ্বীপের ওপর দিয়ে তীব্র বেগে মৌসুমি বায়ু বয়ে যায়। তারপরও ডুবুরিদের জাহাজ ধীরে ধীরে সেদিকেই এগিয়ে যেতে থাকে। একসময় হলদে-বাদামি রঙের একটি বিশাল প্রবাল প্রাচীর এলাকায় নোঙর করে। জাহাজের ডুবুরি ফ্রেডেরিক ডুমা ও অ্যালবার্ট ফ্যালকো পানিতে নামেন। কিছুক্ষণ পর তারা শিলের মতো ভেসে ওঠেন এবং অক্সিজেনের মাস্ক মুখ থেকে সরিয়ে ‘অসাধারণ!’ বলে চিৎকার করে ওঠেন। আমি সিঁড়িতে ঝুলে পেছনের দিকে মাথা কাত করে সাগরে ঝাঁপ দিলাম। প্রথম দফায় সাগরের মাত্র কয়েক ফুট নিচে যেতে পারলাম। তারপর গভীরতা দ্বিগুণ করে পায়ের পাতায় লাগানো রাবারের পাখনার সাহায্যে সোজা নিচের দিকে এগিয়ে গেলাম। ৩০ ফুট নিচে পেলাম একটি নিচু ‘প্রবালারণ্য’, যা হালকা হলদে, গোলাপি, নীল ও বেগুনি আলো ছড়াচ্ছে। বিভিন্ন আকৃতির প্রবাল। বামন গাছ, ছাতা, কুণ্ডলী পাকানো গম্বুজ এবং বাঁকানো আঙুল ছড়িয়ে আছে।’
তিনি বলেন, ‘ক্রমেই যেতে যেতে দূর নীলের মধ্যে হারিয়ে গেছে প্রবালের সারি। উষ্ণ পানির উজ্জ্বল স্বচ্ছতা ভেদ করে সূর্যের আলো এসে আমার গায়ে পড়লো। চাঁদের আলোর মতো কোমল আলোকধারায় মাছ, প্রবাল, এমনকি শরীর অবয়ব পেয়েছে। মনে হয় একটি তরল নীলকান্ত মণির মাঝখানে স্থির ঝুলে আছি। প্রবালারণ্যে অসংখ্য মাছের বসবাস। সবুজ, হলুদ, লাল, নীল ও কালো রঙের ছোট ছোট মাছ কখনো দ্রুতগতিতে ছুটে যাচ্ছে, কখনোবা বোকার মতো স্থির দাঁড়িয়ে থাকছে। নিজেদের উচ্চবর্গীয় বিবেচনা করেই কি না কে জানে? বড় মাছেরা কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করে এই ভিতু ছোট মাছের ভিড়ের মধ্যখান দিয়ে চলে যায়। আমি তিন ফুট দূরে ক্যামেরা স্থাপন করে ভিউফাইন্ডারে চোখ রাখি। তখন দেখা যায়, ওই ভোঁতা মাথাওয়ালা মাছটিও ক্যামেরার কাছে চলে এসেছে। শাটার রিলিজ বোতাম চাপার আগেই দেখি সে ক্যামেরার লেন্সের সঙ্গে মুখ লাগিয়ে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে।’
আরও পড়ুন: আগুন লাগলে কী করবেন?
দ্য সাইলেন্ট ওয়ার্ল্ড তথ্যচিত্রের নির্মাতারা অভিজ্ঞতা জানান, পানির ১৪৪ ফুট নিচে শুটিং করার সময় দ্রুত সম্ভব চাপ বাড়িয়ে গভীর পানির নীলাভ অন্ধকারের দিকে এগিয়ে যেতে হয়। খাদের ওপর দিয়ে যাওয়ার সময় ঠিক নিচেই ডুবুরি ভিডিও শুটিংম্যানরা দেখতে পান রহস্যময় নীল রঙের আরেক দুনিয়া। গবেষকদের মতে, সাগরের পানির গভীরতা যত বাড়ে, নীল কোবাল্টের ঘনত্ব তত বাড়ে। এমনকি স্বচ্ছ পানিতেও অসংখ্য নীল ক্ষুদ্র কণা মিশে থাকে। আলো এই কণাগুলোয় প্রতিফলিত হয় বলেই পানি নীল দেখায়। স্বচ্ছ পানিতে দেখতে পাওয়া না পাওয়ার বিষয়টি নির্ধারিত হয় আলো-ছায়ার খেলায়। মেঘাচ্ছন্নতার কারণে দূরের কোনো কিছু একেবারে হারিয়ে যায় না। উজ্জ্বল নীল আলোয় অদৃশ্য হয়ে যায়।
সাগরের পানির গভীর থেকে উঠে আসা অনেকটা স্বপ্ন থেকে জেগে ওঠার মতো ব্যাপার। সাগরের পানির গভীর থেকে ওপরে উঠতে উঠতে চাপও কমতে থাকে। মাথা তখন ঝিমঝিম করে। একজন ডুবুরি এক নির্মল নীল জগতের সন্ধান পান; যখন তিনি ১০০ ফুট স্বচ্ছ সাগরের পানির নিচের স্তরের দিকে চোখ দেন। এমন মনোমুগ্ধকর দৃশ্যের সঙ্গে একমাত্র ফ্রান্সের ত্রয়োদশ শতকের শারট্রে ক্যাথেড্রালের জানালার কাচের মিল খুঁজে পাওয়া যায়। আবার সাগর তলার শুটিংয়ের সঙ্গে যুক্ত কোনো কোনো ডুবুরির মতামত ও অভিজ্ঞতা বড়ই পীড়াদায়ক। তারা জানান, আন্ডারওয়াটার মুভি ফুটেজ তোলার কাজ বাজে কাজ। মানুষ পানির তলায় গিয়ে শুটিং করবে স্রষ্টা যদি চাইতেন, তাহলে তো তিনি মানুষকে মাছের মতো ফুলকোও দিতে পারতেন।
আরও পড়ুন: মহাবিশ্ব সৃষ্টির রহস্য জানলে চমকে উঠবেন!
ডলফিনস, অ্যাকোয়া ইত্যাদি মুভি তৈরির সময় মুভির পরিচালক, নির্দেশক, অভিনয়শিল্পী, লাইটম্যান, ক্যামেরাম্যানসহ ডজন ডজন ডুবুরি সাগরের তলার অংশে শুটিংয়ে অংশ নেন। তথ্যচিত্র নির্মাণ করেন। শুটিং ক্রুরা পুরোটা দিনের ১২ ঘণ্টা সময়ই ব্যয় করেন তাদের পারফরমার ডলফিনদের খুঁজে বের করতে। এজন্য তাদের দীর্ঘ সময় থাকতে হয়েছে আটলান্টিক মহাসাগরের বাহামা দ্বীপপুঞ্জের কাছাকাছি। ডলফিনদের নিয়ে সারাদিন ব্যস্ত থাকার পর ঘণ্টা চারেক আবার ব্যয় করতে হয়েছে ক্যামেরা এবং আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতি থেকে লবণ আর বালি পরিষ্কার করতে। মিচেল হ্যাচ কোকো দ্বীপের রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, ‘ওখানে সাগরতলে শুটিংয়ের সময় আরেকটা উটকো আপদ সব সময় টেনশনে রাখে আমাদের। এই আপদ হচ্ছে ম্যানটিস শ্রিম্প। এক ধরনের সামুদ্রিক চিংড়ি। এরা বালির তলায় লুকিয়ে থাকে। তারপর নাগালের ভেতরে কোন মাছ ঘুরতে এলে আচম্বিতে শিং চালিয়ে দেয়। এই চিংড়ি মাত্র ফুটখানেক লম্বা হয়। কিন্তু চোখের পলকে মুভির ডুবুরি পরিচালক, নির্দেশক, অভিনয়শিল্পী, লাইটম্যান, ক্যামেরাম্যানের আঙুল কেটে নিতে সক্ষম।’
যারা সাগর তলায় দুঃসাহসিক শুটিংয়ের ডকুমেন্টরি তৈরি করেন; তাদের শরীর বাঁকা করে সাগরের পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়তে হয়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা গহীন সাগরের নিচে কষ্ট করে কাটাতে হয় সময়। তবুও নানা বিপদ, অ্যাডভেঞ্চার রোমাঞ্চকর অনির্বচনীয় স্বাদ রয়েছে সাগরতলের শুটিংয়ের দৃশ্য ধারণে।
লেখক: বিজ্ঞান লেখক, গবেষক এবং এমফিল স্কলার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
এসইউ/জেআইএম