ঈর্ষার আগুন জ্বলে ধিকি ধিকি!
ঈর্ষা। এমন একটি আবেগ, যা কম-বেশি সবার মধ্যে লুকিয়ে আছে। কারো চরিত্রের মধ্যে এর উপস্থিতি সহনশীল মাত্রায়, আবার কারো মধ্যে অতি উগ্রমাত্রায় বিদ্যমান। মাত্রা যা-ই হোক। চরিত্রে এর উপস্থিতি যে সুফল দেবে না, এ ব্যাপারে নিশ্চিত থাকুন। মানুষের মনের বাগানে ঈর্ষা হলো একটি সুপ্ত আবেগ। যদি অন্য ব্যক্তির গুণ বা ভালো কিছুর জন্য ওই ব্যক্তির প্রতি অতৃপ্তিবোধ করেন, তার ওই গুণটির ধ্বংস বা সীমাবদ্ধতা চান অথবা তার সে গুণ বিলুপ্তির পর নিজের মধ্যে দেখতে চান, তবে নিশ্চিত ঈর্ষায় ভুগছেন। এখন যা-ই হোক, স্বস্তিটা যে কিছুতেই হবে না; তা নিজেই বুঝতে পারবেন। আর এ অস্বস্তি উগ্র হতে উদ্বুদ্ধ করবে। অতএব শুরুতেই সতর্ক হোন।
গবেষকরা বলেন, কোনো কিছুর অর্জন চাহিদা থেকেই সাধারণত ঈর্ষা তৈরি হয়। তবে অনেক ক্ষেত্রে নিজের কিছু অপূর্ণতা পরিপূর্ণ করতে চাইলে এবং অন্যের মাঝে তার পূর্ণতা দেখলেও এটি হতে পারে। মূলত ঈর্ষা বোধটা দুভাবে আপনার ওপর কার্যকর হতে পারে। একটি নিজের ভেতর থেকে অর্থাৎ আপনার ব্যক্তিত্ব ও বুদ্ধিবৃত্তি আপনাকে ঈর্ষাপরায়ণ করতে পারে। অন্যটি আসে সমাজ বা পরিবার থেকে। এমন কিছু বিষয় আছে, যা ছোটবেলা থেকে অজান্তেই আপনার ভেতরে ঈর্ষার ক্ষেত্র তৈরি করেছে। যেমন ছোটবেলায় ভালো পেনসিল বক্স, খেলনা, কানের দুল ইত্যাদি থেকে সাধারণত শিশুদের ঈর্ষার শুরু হয়। শিশুরা চায় তার ভালোবাসার মানুষের ভাগ আর কেউ না পাক। দেখা যায় ছোট শিশু মায়ের প্রিয় ফুলগাছগুলো ভেঙে ফেলেছে। কারণ মা তাকে সময় না দিয়ে ওই গাছগুলোর যত্ন নেন। একই মানসিকতা কিন্তু বড়দের ক্ষেত্রেও দেখা যায়। স্বামী রোজ অফিসে যাওয়ার সময় তার পোষা টিয়াকে ছোলা খেতে দেন। যে কারণে দেখা যায় স্ত্রী বলছেন, ‘পাখিটার গলা টিপে মেরে ফেলতে ইচ্ছে করে।’
আরও পড়ুন: আকাশে কত তারা?
সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, ঈর্ষার দুটো দিক আছে। একটি ইতিবাচক দিক। যা থাকলে পরবর্তীতে হীন্মন্যতায় ভুগবেন না। ব্যাপারটা স্পষ্ট করা যাক। আপনি যদি কোনো চাহিদা অর্জন করতে যান আর সে লক্ষ্যে নিজের কিছু দক্ষতা বাড়িয়ে নিজের মধ্যে কিছু পরিবর্তনের মানসে উদ্যোগ গ্রহণ করেন এবং এজন্য পর্যাপ্ত শক্তি ব্যয় করতে আগ্রহী হন। তাহলে সেটাই আপনার ইতিবাচক ঈর্ষা। এতে আপনি যার প্রতি ঈর্ষায় ভুগছেন, তার কোনো ক্ষতি করতে চাইবেন না কিংবা তার সেই বৈশিষ্ট্যের বিলুপ্তি বা ধ্বংসও চাইবেন না। ঈর্ষান্বিত হয়ে যদি কেউ সঠিক কাজ করেন। পড়াশোনা আরও বাড়িয়ে দেন। তখন তো ‘অসুখী মনন’ নয়। কিংবা সহকর্মীর পদোন্নতি কেউ কেউ ঈর্ষার চোখে দেখেন আবার কেউ কেউ মনে করেন ওটা অর্জন করার চেষ্টা করতে হবে, যেখানে ঈর্ষার কোনো স্থান নেই।
ঈর্ষার অন্য দিকটি নেতিবাচক দিক। আজকাল এটাই অনেকের মধ্যে সক্রিয়। আপনি যার প্রতি ঈর্ষান্বিত, তার ক্ষতি করতে চাইবেন। এতে আপনার কাছে নৈতিকতার মূল্য গৌণ। অবশ্য অনেক সময় ইতিবাচক ঈর্ষা নেতিবাচক হিসেবেও বিকশিত হয়ে থাকে। যেমন আপনি যদি মনে করেন আপনি যা অর্জন করতে চাচ্ছেন, তা অবাস্তব বা তা অর্জনের যথার্থ ক্ষমতা আপনার নেই; তখন আপনার মধ্যে নেতিবাচক ঈর্ষা দেখা দিতে পারে। তখন আপনি ব্যক্তির প্রতি প্রতিহিংসা পরায়ণ হয়ে উঠবেন এবং আপনার সবকিছুতে এ মানসিকতা অত্যন্ত স্পষ্টভাবে প্রকাশ পাবে।
আরও পড়ুন: বিয়ের আংটির যত রহস্য
সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, পরের শ্রী দেখে ভালো লাগা বা মুগ্ধ হওয়া অনেক ক্ষেত্রে স্বাভাবিক ঘটনা। একইভাবে অন্যের সুখে সুখী হওয়া ও দুঃখে দুঃখী হওয়া হচ্ছে কারো সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করা। এসবই স্বাভাবিক সামাজিক ঘটনা। গাছের ফুল দেখলে ভালো লাগতেই পারে। কিন্তু যার গাছের ফুল এতো সুন্দর, তার কথা ভেবে ফুলটা খারাপ লাগাই ঈর্ষা। সভ্যতার শুরু থেকে ঈর্ষার সূচনা। সভ্যতার বর্তমান উৎকর্ষেও মানুষের যেসব আদিম বৈশিষ্ট্য রয়ে গেছে, ঈর্ষা তারই একটি। ঈর্ষার কারণে মানুষের হিতাহিত জ্ঞান লোপ পায়। যে কারণে মানুষ ঈর্ষার যুক্তিহীন দহনে পুড়ে মরে। ঈর্ষা মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য যেমন ক্ষতিকর; তেমনই সমাজের জন্যও বেশ ক্ষতিকর। অবশ্য এর জন্য শুধু আপনিই দায়ী নন। অনেক কিছুই দায়ী থাকতে পারে। বিজ্ঞানীদের অনেকে বলেন, ঈর্ষা জিনঘটিত। ঈর্ষা ও জিনের সম্পর্ক যদি কখনো থেকেও থাকে, তবে কোন প্রজন্মে তার প্রকাশ ঘটবে, তা আগে থেকে নির্ধারণ করা সম্ভব নয়। এর প্রকাশ নির্ভর করে পরিবেশের ওপর। সত্যিকার অর্থে জিনের প্রকাশ এক প্রজন্মে হয় না। শারীরিক উপাদান ও পরিবেশের নানা উপাদানের রাসায়নিক বিক্রিয়ার ফলে মানুষের একেকটা গুণ বা দোষের প্রকাশ ঘটে। কোনো কোনো গবেষক বলেন, অভাববোধ থেকেই মানুষের মনে ঈর্ষার জন্ম হয়। যদি তা-ই হয়; তবে প্রশ্ন ওঠে, এ অভাববোধ পার্থিব বস্তুর অভাব? নাকি সুখের অভাব?
ঈর্ষা থেকে আসে মানুষের অসামাজিক আচার-আচরণ। বাগানের ফুল ছিঁড়ে ফেলার আপাতত তুচ্ছ ঘটনাও যার মধ্যে পড়ে। সমাজের মূল স্রোত থেকে যারাই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন, তাদের মধ্যেই এ প্রবণতা প্রবল। কারণ এ ক্ষেত্রে মমত্ববোধ কাজ করে না। বাণ মারা, তুক-তাক করাও ঈর্ষার সংস্কারাচ্ছন্ন সামাজিক প্রকাশ। শেক্সপিয়রের উপমায় ঈর্ষা হলো গ্রিন আইভ মনস্টার। এ সবুজ চোখের দানব খুবই শক্তিশালী। এর দানবীয় শক্তি মোকাবিলায় চাই অন্তরের সুপ্ত মানবিক বোধের বিকাশ। তাই ঈর্ষা থেকে চিন্তাকে মুক্ত করাটা নিজের দায়িত্ব।
আরও পড়ুন: মহাকাশে বেড়াতে যাবেন?
তবে হ্যাঁ। আপনার ব্যক্তিত্ব যদি শানিত হয়, তাহলে দিকটি সামলে উঠতে পারবেন। কিন্তু এজন্য আপনার মনোভাব, আবেগ ও আচরণের ওপর প্রয়োজনীয় নিয়ন্ত্রণ রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে, জীবনে সবকিছু নিজের চাহিদামতো পাওয়া যায় না। মনে মনে সুখী হওয়াটা বড় কথা। পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে যথাসম্ভব সৎ থাকার চেষ্টা করতে হবে। আর এটি করতে পারলেই নেতিবাচক ঈর্ষার প্রভাব কাটিয়ে উঠতে পারবেন।
লেখক: বিজ্ঞান লেখক ও গবেষক। এমফিল স্কলার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
এসইউ/এএসএম