ভিডিও EN
  1. Home/
  2. ফিচার

স্বাধীনতা সংগ্রামের সাক্ষী ‘কল-রেডী’

ফিচার ডেস্ক | প্রকাশিত: ০৫:০৮ পিএম, ০৭ মার্চ ২০২৩

মেহেরাবুল ইসলাম সৌদিপ

দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সাক্ষী ঢাকার প্রথম মাইক সার্ভিস ‘কল-রেডী’। দেশ বিভাগের পর থেকে মুক্তিযুদ্ধ সংগ্রাম পর্যন্ত বাঙালির প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রামে অকুতোভয়ে মাইক সার্ভিস দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের জন্য ব্যবহৃত কলরেডির সেই মাইক্রোফোনটি এখনো সংগ্রহে রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির কাছে। এটি যথাযথ স্বীকৃতি দিয়ে জাতীয় জাদুঘরে রাখার দাবি জানিয়েছেন কল-রেডীর প্রতিষ্ঠাতা হরিপদ ঘোষের ছেলে সাগর ঘোষ।

১৯৪৮ সালের দিকে দয়াল ঘোষ ও হরিপদ ঘোষ নামে দুই ভাই পুরান ঢাকার লক্ষ্মীবাজারে আরজু লাইট হাউজ প্রতিষ্ঠা করেন। পরে সেটির নাম দেয় কল-রেডী। অর্থাৎ কল করলেই রেডী। এরপর একে একে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ১৯৬৬ সালের ৬ দফা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থান, ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনের সভা-সমাবেশে এই প্রতিষ্ঠানের মাইক্রোফোনের সামনে অগ্নিঝরা বক্তৃতা করেছেন দেশবরেণ্য রাজনীতিকগণ। এছাড়াও ১৯৭১ সালের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের সমাবেশে মাইক সার্ভিস হিসেবে ব্যবহার করা হয় কলরেডী।

আরও পড়ুন: ঐতিহাসিক ৭ মার্চ: স্বাধীনতা শব্দটি আমাদের হলো

৭ মার্চে কল-রেডীর যে মাইক্রোফোনে বঙ্গবন্ধু তার ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়েছিলেন সেই মাইক্রোফোন আর কাউকে ব্যবহার করতে দেওয়া হয়নি। দেশ স্বাধীনের পর বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি দেশে ফিরে এসেও কল-রেডীর মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়িয়ে ভাষণ দিয়েছিলেন।

কল-রেডীর প্রতিষ্ঠাতা হরিপদ ঘোষের ছেলে সাগর ঘোষ বলেন, ৭ মার্চের ৩ দিন আগে বঙ্গবন্ধু তার ধানমন্ডির বাসায় আমার বাবা হরিপদ ঘোষ ও জ্যাঠা দয়াল ঘোষকে ডেকে সমাবেশে মাইকের ব্যবস্থা করতে বলেন। সেদিন একশোর বেশি মাইক লাগানো হয় জনসমাবেশ স্থলে। সমাবেশের তিনদিন পূর্ব থেকেই রাতের আঁধারে মাইকগুলো প্রস্তুত রাখার কাজ শুরু করে কল-রেডী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও কিছু মাইক মজুদ রাখা হয়। কিন্তু স্বৈরশাসকের রক্তচক্ষুতে জীবন বিপন্নের ভয় ও এতো বড় সমাবেশে মাইক ভাড়ার খরচ বেশি হওয়ার কারণে অনেকে তাদের মানা করেন। কিন্তু স্বাধীনতার ডাকে রাতের অন্ধকারে লুকিয়ে মাঠে মাইক লাগান বাবারা। মাইক লাগিয়ে কাপড় দিয়ে ঢেকে দেন তারা।

বঙ্গবন্ধুর ভাষণে যান্ত্রিক ত্রুটি যেন না হয় সেজন্য অতিরিক্ত তিনটি মাইক্রোফোন, কিছু হ্যান্ড মাইক ও ইঞ্জিনিয়ার নিয়োগসহ নিজেরা উপস্থিত ছিলেন। তবে এতে ভয়ও ছিল। সে সময় পাকিস্তানি শাসকের ভয় উপেক্ষা করে কাজ করেছিল প্রতিষ্ঠানটি। পাকিস্তানি সামরিক সরকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে (তৎকালীন রেসকোর্স ময়দান) সৈন্য মোতায়েন করে।

যে কোনো সময় হতে পারে তাদের আক্রমণ। তাই এমন উৎকণ্ঠিত পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণে শুধু টাকার জন্য সাড়া দেয়নি কল-রেডী। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে পাকিস্তানি স্বৈরশাসকের হুমকির মুখে রাতের অন্ধকারে সেদিন প্রায় ১০ লাখ মানুষের সেই ঐতিহাসিক সমাবেশে মাইকের আয়োজন করে কল-রেডী। বঙ্গবন্ধু ঐতিহাসিক ভাষণের সাক্ষী হতে পেরে কলরেডী গর্ববোধ করে।

বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের সেই স্ট্যান্ড, মাইক্রোফোন সবই আছে এখনো। কিন্তু কল-রেডীর কোনো স্বীকৃতি মেলেনি। সরকার এগুলো যথাযথ মর্যাদায় সংরক্ষণ করলে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ ও কল-রেডীর ইতিহাস সংরক্ষিত হবে। ৭ মার্চ ভাষণে বঙ্গবন্ধু যে মাইক্রোফোন, মাইক্রোফোনের স্ট্যান্ড ব্যবহার করেছিলেন বর্তমানে কল-রেডীর কাছে সংরক্ষিত আছে। তবে এগুলো আরও ভালোভাবে সংরক্ষণ করা প্রয়োজন।

৭ মার্চে বঙ্গবন্ধুর ব্যবহৃত সেই মাইক্রোফোনটি ছাড়া আরও মাইক্রোফোন রয়েছে যেগুলোর সামনে সামনে দাঁড়িয়ে ভাষণ দিয়েছেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, এ কে ফজলুল হক, ইন্দিরা গান্ধী, প্রণব মুখার্জি, অটল বিহারি বাজপেয়ি, ইয়াসির আরাফাত, নেলসন ম্যান্ডেলা, বিল ক্লিনটনসহ দেশ ও বিদেশের গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ আরও অনেকে। এগুলো দেশের স্বাধীনতা জাদুঘরে সংগ্রহ করে যথাযথ স্বীকৃতি মিললে দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস রক্ষিত থাকবে বলে মনে করেন কল-রেডীর বর্তমান কর্ণধাররা।

কল-রেডীর ইতিহাস থেকে জানা যায়, হরিপদ ঘোষ ও দয়াল ঘোষ নামে দুই ভাই, পুরান ঢাকায় ব্যবসা করার সিদ্ধান্ত নেন। বাবার ইচ্ছা ছিল ইসলামপুরে কাপড়ের পাইকারী দোকান দেবেন দুই সন্তান। কিন্তু তাদের আগ্রহ ছিল না কাপড়ের ব্যবসায়। কারণ পুরান ঢাকায় কাপড়ের দোকানের অভাব ছিল না। দুই ভাই তখন সিদ্ধান্ত নেন বাতি ও লাইটের ব্যবসা করবেন। পুরান ঢাকার মানুষ আলোকসজ্জা পছন্দ করে, বেশ ভালো চলবে।

আরও পড়ুন: নেতাজীকে বাঁচাতে স্বামীকে হত্যা করেছিলেন নীরা

এরপর দুজন ১৯৪৮ সালে ‘আরজু লাইট হাউস’ নামে একটি দোকান চালু করেন। দোকানের প্রথম গ্রাহক ছিলেন স্থানীয় শ্যামলকান্তি বড়াল। ৩ টাকা অগ্রিম দিয়ে তিনি বিয়েবাড়ির আলোকসজ্জার দায়িত্ব দিয়ে যান দুই ভাইকে। কিন্তু সমসাময়িক আরও অনেক দোকান গড়ে ওঠায় শঙ্কায় পড়েন তারা। এমন সময় লাইটের পাশাপাশি ব্যবসায় সাউন্ড সিস্টেম যুক্ত করার কথা চিন্তা করেন হরিপদ ঘোষাল। শুরুতে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গ্রামোফোন ভাড়া ও আলোকসজ্জার কাজ করতেন। দিন দিন বাড়তে লাগলো এসবের চাহিদা। তাই ভারত থেকে কয়েকটি মাইক নিয়ে এসে এবং নিজেরাই হ্যান্ড মাইক তৈরি করে বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও সভা-সমাবেশে ভাড়া দেওয়া শুরু করেন। পরবর্তীতে চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় চীন, তাইওয়ান ও জাপানসহ অন্যান্য দেশ থেকেও মাইক আনতে হয় দুই ভাইকে।

কল-রেডী নামের ইতিহাস সম্পর্কে জানা যায়, মাইক যারা ভাড়া করবেন তারা কল করলে যাতে তাদের প্রতিষ্ঠান রেডি থাকে এই ভাবনা থেকেই নামটি এসেছে। অর্থাৎ কল করলে মাইক পৌঁছে যাবে দ্রুত।

কল-রেডী দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে স্মরণীয়। তাছাড়া কল-রেডীর মাইক্রোফোনের সামনে কথা বলেছেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক এবং অবশ্যই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বিদেশিদের মধ্যে দক্ষিণ আফ্রিকার অবিসংবাদিত নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা, ভারতের ইন্দিরা গান্ধী, ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি, যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন প্রমূখ।

‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ একাত্তরের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের অমর বাক্য। এই ভাষণ সেদিন ৭ কোটি বাঙালির পথের দিশা দেখিয়েছিল। অত্যন্ত আনন্দ এবং গর্বের বিষয় যে, ভাষণটি এখন বৈশ্বিক সম্পদ। ইউনেস্কো এই ভাষণকে বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্যের স্বীকৃতি দিয়েছে।

এর আগে ব্রিটিশ ঐতিহাসিক জ্যাকব এফ ফিল্ড বিশ্বের সেরা ভাষণগুলো নিয়ে ‘উই শ্যাল ফাই অন দ্য বিচেস: স্পিচেস দ্যাট ইন্সপায়ার হিস্ট্রি’ নামে যে বই প্রকাশ করেছিলেন, সেখানে তিনি বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণ অন্তর্ভুক্ত করেন বিশ্বের অন্যতম অনুপ্রেরণাদায়ক বক্তৃতা হিসেবে। যে ভাষণ জাতির মুক্তির স্বপ্নে জড়িয়ে আছে, তার সঙ্গে ইতিহাসের অংশ হয়ে আছে আরেকটি নাম ‘কল-রেডী’। ৭ মার্চে ব্যবহৃত মাইক্রোফোনকে স্বীকৃতির দাবিও জানান ঐতিহাসিক এ প্রতিষ্ঠানটির বর্তমান কর্ণধাররা।

লেখক: শিক্ষার্থী ও ক্যাম্পাস সাংবাদিক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা

কেএসকে/এএসএম

আরও পড়ুন