বিয়ের আংটির যত রহস্য
বিয়ে, মানুষের জীবনের এক অদ্ভুত, বিচিত্র, কৌতূহল, আবেগময় মজার অধ্যায়। বিয়ে নামক সন্ধির মাধ্যমে মিলন ঘটে দু’টো অচেনা অজানা জীবনের। বিয়ে আসলে আদ্যোপান্ত আনুষ্ঠানিকতায় ঠাসা এক আয়োজন। গায়ে হলুদ, বর ও কনে পক্ষের দু’টো ভালোমন্দ খানাপিনার আনন্দ-আয়োজন তো রয়েছেই। তবে এসব আয়োজনের শুরু হয় কনে দেখা থেকে। যার পরিসমাপ্তি ঘটে বাসর ঘরে গিয়ে।
বিয়ের আনুষ্ঠানিকতার একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে বর-কনের আংটি প্রদান বা আংটি রদ বদল, বাগদান। ইংরেজিতে বলে অ্যানগেজমেন্ট রিং। এটি প্রাকবিবাহের একটি অংশ হিসেবে বিবেচনা করেন বিশ্বের সব বর্ণ, গোত্রের মানুষ। অধিকাংশ দেশে আংটি পরা বিয়ের ধর্মীয় অনুষ্ঠানের অঙ্গ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এই আংটি প্রদানের মাধ্যমে বর-কনে একে অপরকে বিয়ে করার এক অলিখিত চুক্তিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়। যে কারণে বিশ্বের সব আধুনিক সভ্য দেশে বর-কনের মধ্যে আংটি বিনিময় হয়ে আসছে। আমাদের দেশেও বিয়ের আংটির প্রথা আজও রয়েছে। অধিকাংশই বাম হাতের অনামিকায় বিয়ের আংটি পরেন। প্রিয় পাঠক, কখনো কি মনে প্রশ্ন জেগেছে? কেন বিয়ের আংটি শুধু বাঁ হাতের অনামিকায় পরা হয়? কেন হাতের অন্য আঙুলগুলোতে বা ডান হাতে বিয়ের আংটি পরা হয়না? এর পেছনে কি কোনো বৈজ্ঞানিক কারণ রয়েছে?
আরও পড়ুন: খুনি শামুকের কামড়ে মরতে পারে মানুষও
না, গবেষকরা তেমন কোনো কথা বলেননি। আসলে পুরোটাই বিশ্বাস এবং প্রথা। এর বেশি কিছু নয়। বিখ্যাত ডাচ চিকিৎসক লেভিনাস লেমনিয়াস তার বইতে লিখেন প্রাচীন রোমের মানুষদের বিশ্বাস ছিল, ‘ভেনা অ্যামোরিয়াস’ অর্থাৎ প্রেমের শিরা বাঁ হাতের অনামিকা থেকে হৃৎপিণ্ডে গিয়ে ঠেকেছে এবং সে কারণেই বিয়ের আংটি বাঁ হাতের অনামিকায় পরা হতো।
গবেষকদের ধারণা- বিয়ের আংটি অনামিকায় পরার এই প্রথার উৎপত্তি হয়েছে প্রাচীন চীন থেকে। প্রাচীন চীনের আকুপাঙ্কচার বিশারদরা তাদের লেখায় জানিয়েছেন কেন অনামিকায় বিয়ের আংটি পরানো হয়ে থাকে। তাদের মতে, যদি কোনো নারী একটি সোনার আংটি অনামিকায় ঘষতে থাকেন, তাতে তার হৃদয়ে এক ধরনের মৃদু আলোড়ন সৃষ্টি করে। এ রকম করলে তার দেহ মনে, হৃৎপিণ্ডে রক্ত চলাচল বেড়ে যায়। হরমোন নিঃসরণ ঘটে। মন প্রফুল্ল ও সতেজ থাকে।
আরেকটি ব্যাপার লক্ষ্য করেছনে কি? বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বিয়ের আংটি গোল হয় কেন? এর কারণ ব্যাখ্যায় গবেষকরা জানিয়েছেন- পৃথিবীর সব দেশেই যে কোনো গোলাকার জিনিসকে শাশ্বত বা চিরন্তন হিসেবে দেখা হয়ে থাকে। তাই বিয়ের আংটিও গোল হয়। প্রাচীন ভারতীয় জ্যোতিষশাস্ত্র অনামিকায় বিয়ের আংটির বিষয়ে কী বলেছে। ‘বিশুদ্ধ প্রেম সব সময়ই স্বর্গীয় বস্তু। সেই প্রেম মানুষ, জীবজন্তু, কীটপতঙ্গ সব কিছুর মধ্যেই বিদ্যমান। এটি একটি নিরবিচ্ছিন্ন প্রক্রিয়া। জন্ম ছকে পঞ্চম ভাবে থেকে প্রেমের আত্মপ্রকাশের বিচার হয়। কালপুরুষের পঞ্চম ভাব হচ্ছে সিংহরাশি যা রবির রাশি বা প্রেমের রাশি। আর রবির আঙুল অনামিকা।’ সেই অর্থে অনামিকা হলো প্রেমের আঙুল। আর সে কারণেই অনামিকাতে বিয়ের আংটি পরানোর নিয়ম।
চীনের ব্যাখ্যার নেপথ্যে যেমন রয়েছে যৌক্তিকতা তেমনি রয়েছে আমাদের সামাজিক বাস্তবতা। চীনে মনে করা হয় আমাদের হাতের পাঁচটি আঙুল পাঁচ রকম নির্দেশক। বৃদ্ধা হচ্ছে বাবা-মা’র প্রতীক। তর্জনী হচ্ছে ভাই-বোনের প্রতীক। মধ্যমা হচ্ছে নিজের প্রতীক। কনিষ্ঠা হচ্ছে সন্তানের প্রতীক। আর অনামিকা হচ্ছে জীবনসঙ্গীর প্রতীক। আর অনামিকা যে আসলে জীবনসঙ্গীর নির্দেশক হতে পারে তা বোঝানোর জন্য চীনে প্রচলিত আছে এক ম্যাজিক খেলা। প্রিয় পাঠক, আসুন এবার খেলাটি আপন মনে নিজে নিজেই খেলি। খেলতে হবে আপনাকেই। ভড়কে যাবেন না। দু’ মিনিটের এই খেলার মাধ্যমেই আপনি বুঝে যাবেন-কেন অনামিকাকে জীবনসঙ্গীর প্রতীক বলে মনে করা হয়?
আরও পড়ুন: ১৪ দিন ধরে চলে তেলেগুদের বিয়ের আয়োজন
প্রথমে হাতের তালু প্রদর্শন করুন। মধ্যমাটিকে গুটিয়ে নিন। একে একে এবার সব ক’টা আঙুল মুঠোবদ্ধ করুন। এবার শুরু হচ্ছে খেলা। আপনার বৃদ্ধাঙ্গুলিটি খোলার চেষ্টা করুন যা বাবা-মা’র প্রতীক। আপনি লক্ষ্য করবেন বৃদ্ধাঙ্গুলিটি অনায়াসে খোলা যাচ্ছে। যার মানে হচ্ছে, প্রতিটি মানুষ মরণশীল। একদিন সবাইকে পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে চলে যেতে হয়। মা-বাবাও একদিন আমাদের ছেড়ে চলে যাবেন। মা-বাবার সঙ্গে সন্তানের সম্পর্ক চিরস্থায়ী নয়। এবার বৃদ্ধাঙ্গুলিটি বন্ধ করুন। হাতের তর্জনী খোলার চেষ্টা করুন। দেখবেন এটিও খুলে যাচ্ছে। যার মানে হচ্ছে আপনার ভাই-বোন একদিন আপনাকে ছেড়ে চলে যাবে। তাদের নতুন জীবন হবে। নতুন সংসার হবে।
এবার তর্জনী বন্ধ করুন। কনিষ্ঠ আঙ্গুলটি খোলার চেষ্টা করুন। এটিও খুলে যাবে। কারণ আজ হোক কাল হোক আপনার সন্তান আপনাকে ছেড়ে চলে যাবে। নিজের মতো করে সন্তান নতুন জীবন গড়বে। এবার আপনার অনামিকাটি খোলার চেষ্টা করুন। আশ্চর্য হবেন! এটি পুরোপুরি খোলা যাচ্ছে না। আর যাবেই বা কেন? এটি যে স্বামী-স্ত্রীর চিরন্তন সম্পর্ক নির্দেশ করে! পুরো জীবন তারা একসঙ্গে থাকেন। কেউ কাউকে কখনো ছেড়ে যান না।
লেখক: বিজ্ঞান লেখক ও গবেষক। এম.ফিল স্কলার, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
কেএসকে/এএসএম