রিকশা চালানোর ফাঁকে ফুটপাতে বসে তাদের দাবার আসর
বখতিয়ার আবিদ চৌধুরী
মতিঝিলের পোস্ট অফিস হাইস্কুলের পেছনের ফুটপাত ধরে বুধবার সন্ধ্যে বেলা তড়িঘড়ি হেঁটে যাচ্ছিলাম, দু-তিনটে চায়ের দোকান ফেলে একটু সামনে এগিয়ে হাতের বাঁপাশে তাকাতেই চোখ আঁটকে গেল! স্কুলের পেছন দিকটার দেয়াল ঘেঁষে আবছা আলোয় ফুটপাতে দাবার বোর্ড সাজিয়ে একা বসে আছেন একজন মানুষ। দেখে মনে হলো আরেকজন মানুষের জন্য খেলা শুরু করতে পারছেন না, অপেক্ষা করছেন তিনি। পরনে হালকা গোলাপি রংয়ের শার্ট ও চেক লুঙ্গি, একেবারেই মলিন সেই পোশাক। ধারণা করলাম তিনি শ্রমজীবী মানুষ, কিছুটা কৌতূহলবশত কাছে গিয়ে নাম ও পেশাগত পরিচয় জানতে চাইলাম, জানালেন তার নাম হানিফ, পেশায় রিকশা চালক। একটু তাড়া থাকায় সেদিন আর আলাপ করতে পারলাম না, তার ফোন নম্বর নিয়ে পরদিন আসব বলে চলে চলে যেতে হলো। পরদিন অর্থাৎ বৃহস্পতিবার দুপুরে হানিফ ভাইকে ফোন করে বললাম, আমি আসছি-আপনি কি ওখানে আছেন? জবাবে হানিফ ভাই জানালেন তিনি তিন-চারদিনের জন্য গ্রামে যাচ্ছেন, শুনে একটু দমে গেলাম। পরক্ষণেই হানিফ ভাই জানালেন, সমস্যা নেই আপনি যান ওরা খেলছে। ওরা বলতে হানিফ ভাইয়ের খেলার সঙ্গীরা, তারাও পেশায় রিকশা চালক।
দুপুর ৩টা, মতিঝিল পোস্টাল হাই স্কুলের ফুটপাতে গিয়ে দেখি সবে বোর্ড সাজিয়ে বসেছেন একজন, কাছে গিয়ে হানিফ ভাইয়ের পরিচয়ে আলাপ জুড়ে দিলাম। তার নাম মোহাম্মদ আব্দুল কুদ্দুস, তিনিও রিকশা চালান। কতদিন ধরে খেলছেন- জানতে চাইলে কুদ্দুস জানান, ছাত্র থাকা অবস্থাতেই তিনি দাবা খেলা শিখেছেন, রিকশা চালানোর ফাঁকে অবসর সময়ে দাবা খেলেন, হিসেব করে জানালেন তার দাবা খেলার বয়স প্রায় ৩০ বছর। এই ফুটপাতে খেলছেন গত ছয় মাস ধরে। পেশায় রিকশা চালক কুদ্দুস আরও জানান, উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন গাইবান্ধা সদর উপজেলার ইসলামিয়া বহুমুখী উচ্চবিদ্যালয় থেকে ১৯৯০ সালে এস.এস.সি পাশ করেন। এরপর পারিবারের আর্থিক সমস্যার কারণে গাজীপুরে একটি ঔষধ কোম্পানিতে মার্কেটিং অফিসারের চাকরি নিয়ে চলে আসেন। তখন আর কলেজে ভর্তি হওয়া হয়নি। পাঁচবছর পর ১৯৯৬ সালে গাজীপুরের কাজী আলিমুদ্দীন ডিগ্রী কলেজ থেকে প্রাইভেট কোর্সে এইচ.এস.সি পাস করেন, ২০০৫ সালে কোম্পানি বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর নিজ ইচ্ছেতে রিকশা চালানো শুরু করেন।
কুদ্দুস ভাইয়ের বিপক্ষে খেলছিলেন মোহাম্মদ মামুনুর রশীদ, তিনিও পেশায় রিকশা চালান, দাবা খেলার শুরুটা কীভাবে করলেন জানতে চাইলে উৎসাহের সঙ্গেই মামুন জানালেন, আট-দশ বছর বয়স থেকে দাবা খেলা শুরু করেছেন, গ্রামের মুরুব্বিদের খেলতে দেখেই দাবা খেলা শেখার ইচ্ছা হয়, সেই থেকে শুরু। এখানে তারা চার-পাঁচজন আছেন যারা নিয়মিত দাবা খেলেন।
দাবার আসরের পাশে চায়ের দেকানদার হোসেন বলেন, ‘গত ছয়-সাত মাস ধরে ওদের এখানে দেখছি, গ্রামে সংসার আছে সব সময়তো আর দাবা নিয়ে বসে থাকলে হয় না, রিকশাও চালায় আবার দাবাও খেলে’। সন্ধ্যা পর্যন্ত কুদ্দুস ভাইদের সঙ্গে কাটালাম, উৎসুক পথচলতি মানুষ ক্ষণিক উঁকি দিয়ে আবার চলে যাচ্ছেন গন্তব্যের পথে, কারো কারো চেহারায় বিস্ময়ের রেখা ফুটে উঠেছে। এরমধ্যে একজন খেলতেও বসে গেলেন! কিন্তু নাম-পরিচয় প্রকাশ করতে চাইলেন না, ছবি তুলতেও নিষেধ করলেন। একদফা খেলে তিনি বিদায় নিলেন। এদিকে সন্ধ্যা নেমে আসছে, খেলার জন্য পর্যাপ্ত আলো কমেছে, বোর্ড গুটিয়ে তারা উঠে পড়লেন। এবার জীবিকার জন্য রিকশা নিয়ে বেরোবেন, কাজ শেষে বাসায় ফিরবেন। পরদিন ঠিক এসে পড়বেন চেনা জায়গায়-চেনা মুখের ভিড়ে, ব্যস্ততা কাটিয়ে। শখের টানে দাবার বোর্ড পেতে বসবেন, কেউ হারবেন তো কেউ জিতবেন, নিজেদের মতো করে উদযাপন করবেন আবার পরক্ষণেই নতুন দাফায় খেলা শুরু করবেন।
লেখক: শিক্ষার্থী, হিসাববিজ্ঞান বিভাগ, হাবিবুল্লাহ বাহার কলেজ
কেএসকে/জেআইএম