বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড জাতির জন্য অপূরণীয় ক্ষতি
বুদ্ধিজীবীরা দেশ-জাতির উন্নয়ন ও অগ্রগতির রূপকার। তাদের উদ্ভাবনী ক্ষমতা, সৃজনশীল কর্মকাণ্ড, উদার ও গণতান্ত্রিক চিন্তা-চেতনা জাতীয় অগ্রগতির সহায়ক। জাতির বিবেক হিসেবে খ্যাত বুদ্ধিজীবীরা তাদের ক্ষুরধার লেখনীর মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত তৈরি, যুদ্ধকালীন মুজিবনগর সরকারকে পরামর্শ প্রদানসহ বুদ্ধিবৃত্তিক চেতনা দিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধকে সাফল্যের পথে এগিয়ে নিতে অসামান্য অবদান রাখেন।
বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা, স্বাধীনতার মহান স্থপতি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ধাপে ধাপে আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্যদিয়ে বাঙালি জাতিকে মুক্তি সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত করেন। নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। তারই আহ্বানে গোটা জাতি মুক্তি সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে। দীর্ঘ নয় মাস সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ১৬ ডিসেম্বর ছিনিয়ে আনে চূড়ান্ত বিজয়। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তাদের নিশ্চিত পরাজয় আঁচ করতে পেরে জাতিকে মেধাশূন্য করার হীন চক্রান্ত করে। এ উদ্দেশ্যে স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনীর সহযোগিতায় ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর দেশের প্রথিতযশা শিক্ষাবিদ, চিকিৎসক, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, শিল্পীসহ বহু গুণীজনকে নির্মমভাবে হত্যা করে। জাতি হারায় তার শ্রেষ্ঠ সন্তানদের। আমাদের স্বাধীনতার ইতিহাসে এটি এক কলঙ্কজনক অধ্যায়।
৩ ডিসেম্বর যখন ভারত-পাকিস্তানের সঙ্গে সর্বাত্মক যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে; তখন যতই দিন গড়াতে লাগল পাকিস্তানি সেনারা বিশেষ করে যারা পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধরত ছিল, তারা বুঝে গেল এ যাত্রায় তাদের আর পরাজয় এড়ানোর কোনো সুযোগ অবশিষ্ট নেই। তবু তারা মরিয়া হয়ে উঠল পরাজয় এড়াতে। যতই দিন গড়াতে লাগল মুক্তিযোদ্ধা এবং ভারতীয় বাহিনীর সর্বাত্মক আক্রমণে সপ্তাহ না পেরোতেই পাকিস্তানি বাহিনীর নাভিশ্বাস উঠে যায়। দশই ডিসেম্বরের পর তারা মোটামুটি মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিতে থাকে পরাজয় বরণের। তবে পরাজয়ের ক্ষতিকে কমিয়ে আনার জন্য তারা আঁটতে থাকে ভিন্ন এক পরিকল্পনা। যদি একান্তভাবেই পূর্ব পাকিস্তান হাতছাড়া হয়ে যায়, তাহলেও যেন এ ভূখণ্ডটি উদারপন্থি চেতনা নিয়ে আগামীতে মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে। তার জন্য কিছু বন্দোবস্ত করতে তারা অস্থির হয়ে যায়। আর এ অস্থিরতার বহিঃপ্রকাশ ঘটে তাদের পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশের সূর্যসন্তানদের গণহত্যার মধ্যদিয়ে।
পরিকল্পনা অনুযায়ী, মূলত ১১ ডিসেম্বর থেকে শুরু করে ১৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত তারা এ হত্যাকাণ্ড চালায়। সারাদেশের প্রায় এক হাজারেরও বেশি বুদ্ধিজীবী এ হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। যদিও ২৫ মার্চ কালরাত থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধের পুরোটা সময়ই বুদ্ধিজীবীদের বেছে বেছে হত্যা করা হয়। তবে বিজয়ের প্রাক্কালে এ হত্যাযজ্ঞ ভয়াবহ রূপ নেয়। মিরপুর, নাখালপাড়া, মোহাম্মদপুর, রাজারবাগ, ফিজিক্যাল ট্রেনিং সেন্টারসহ বিভিন্ন এলাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর নির্যাতনকেন্দ্র ছিল। পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসরদের দ্বারা পৈশাচিক হত্যাকাণ্ডের পর ঢাকার মিরপুর, রায়েরবাজারসহ বিভিন্ন স্থানে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের লাশ ফেলে যাওয়া হয়। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের দেহজুড়ে ছিল আঘাতের চিহ্ন, চোখ-হাত-পা বাঁধা, কারো কারো শরীরে একাধিক গুলি, কাউকে হত্যা করা হয়েছিল ধারালো অস্ত্র দিয়ে।
১৯৭২ সালে জাতীয়ভাবে প্রকাশিত বুদ্ধিজীবী দিবসের সংকলন, পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ ও আন্তর্জাতিক নিউজ ম্যাগাজিন নিউজ উইকের সাংবাদিক নিকোলাস টমালিনের লেখা থেকে জানা যায়, শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সংখ্যা মোট ১ হাজার ৭০ জন। বাংলাপিডিয়া থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সংখ্যাগত চিত্র হলো, শিক্ষাবিদ ৯৯১ জন, চিকিৎসক ৪৯ জন, সাংবাদিক ১৩ জন, আইনজীবী ৪২ জন এবং অন্যান্য (সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, শিল্পী এবং প্রকৌশলী) ১৬ জন। দেশের খ্যাতনামা বুদ্ধিজীবীদের নির্মম এ হত্যাকাণ্ড ছিল জাতির জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি।
বিজয়ের ৫০ বছর অতিক্রম করলেও বুদ্ধিজীবী হত্যার সঠিক হিসাব জাতি আজও জানতে পারেনি। বুদ্ধিজীবীদের কে কোথায় কীভাবে শহীদ হয়েছেন, তারও কোনো সঠিক তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে বর্তমান আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে গঠিত সরকার শহীদ বুদ্ধিজীবীদের একটি পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রণয়নের কাজ শুরু করেছে। সরকারের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় ২০২০ সালের ১৩ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবীদের একটি প্রাথমিক তালিকা চূড়ান্ত করেছে। এতে ১,২২২ জন শহীদ বুদ্ধিজীবীর নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা তৈরির অংশ হিসেবে শহীদ বুদ্ধিজীবীর সংজ্ঞা চূড়ান্ত করেছে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়। নতুন সংজ্ঞা অনুযায়ী, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকে ৩১ জানুয়ারি ১৯৭২ সাল পর্যন্ত সময়কালে যেসব বাঙালি সাহিত্যিক, দার্শনিক, বিজ্ঞানী, চিত্রশিল্পী, শিক্ষক, গবেষক, সাংবাদিক, আইনজীবী, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, স্থপতি, ভাস্কর, সরকারি ও বেসরকারি কর্মচারী, রাজনীতিক, সমাজসেবী, সংস্কৃতিসেবী, চলচ্চিত্র, নাটক ও সংগীতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন এবং এর ফলে দখলদার পাকিস্তানি বাহিনী কিংবা তাদের সহযোগীদের হাতে শহীদ কিংবা ওই সময়ে চিরতরে নিখোঁজ হয়েছেন, তাঁরা শহীদ বুদ্ধিজীবী হিসেবে বিবেচিত হবেন।
জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের অপরাধ ছিল, নিজ নিজ অবস্থান থেকে জনসাধারণকে স্বাধিকারের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে তোলা ও মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা জোগানো। হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়া শহীদ বুদ্ধিজীবীরা তাদের মেধা, সৃজনশীলতা, জ্ঞান ও দক্ষতা দ্বারা স্বাধীন বাংলাদেশকে আরও সমৃদ্ধ করতে পারতেন। দেশের জন্য বড় ধরনের অবদান রাখতে পারতেন। কিন্তু ঘাতকদের নির্মমতায় তারা সেটি পারেননি। এটি নিঃসন্দেহে জাতির জন্য অপূরণীয় ক্ষতি। ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর জাতির যে সূর্যসন্তানদের আমরা হারিয়েছি, সে ক্ষতি আজও জাতি হিসেবে আমরা কাঁটিয়ে উঠতে পারিনি। যে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে শহীদ বুদ্ধিজীবীরা জীবনের মায়া তুচ্ছ জ্ঞান করেছেন, সেই দেশপ্রেমে উজ্জীবিত হয়ে একটি সুখী সমৃদ্ধ বাংলাদেশ বিনির্মাণের পরিকল্পনা নিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য নতুন প্রজন্মকে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে।
বাঙালি জাতি আজও দেশের সূর্যসন্তানদের হারানোর শোক হৃদয়ে ধারণ করে চলেছে। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের রেখে যাওয়া আদর্শ ও পথকে অনুসরণ করে অসাম্প্রদায়িক ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাভিত্তিক সুখী-সমৃদ্ধ সোনার বাংলা গড়তে পারলেই তাদের আত্মত্যাগ সার্থক হবে বলে বিশ্বাস করি।
লেখক: সাবেক সহ-সম্পাদক, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটি।
এসইউ/এএসএম