ভিডিও EN
  1. Home/
  2. ফিচার

একটু ছায়া পেলে কয়েক বছর বাঁচতেন ঋত্বিক ঘটক?

ফিচার ডেস্ক | প্রকাশিত: ০৫:১০ পিএম, ১০ ডিসেম্বর ২০২২

বখতিয়ার আবিদ চৌধুরী

মদের বোতল হাতে মধ্যরাতে টলতে-টলতে খালাসীটোলার ডোমদের ওই আড্ডায় উপস্থিত হলেন মধ্যবয়স্ক, রোগা চেহারা আর ভাঙা স্বাস্থ্যের অধিকারী এক ছন্নছাড়া মানুষ। এসে দাঁড়াতেই মদের নেশায় আসক্ত আড্ডায় উপস্থিত ডোমের দল নেশা জড়ানো কণ্ঠে একসাথে চিৎকার দিয়ে উঠল, ‘গুরু এসেছে!’ মাথাভর্তি এলোমেলো চুল, রংচটা মোটা ফ্রেমের কালো চশমার ভেতরে থাকা খাদে পড়ে যাওয়া চোখ দুটো কেমন উজ্জ্বলতা ছড়িয়ে দিলো মুহূর্তে! দুঃখমাখা এক মলিন হাসি দিয়ে মানুষটি বললেন, ‘কেমন আছিস রে সব?’

মানুষটির নাম ‘ঋত্বিক কুমার ঘটক’। কারো কাছে ঋত্বিক ঘটক, আবার কারো কাছে ভবা। সেই কলেজ স্ট্রিটের প্যারাডাইস ক্যাফের আড্ডার মধ্যমণি ভবা। তর্ক-বিতর্কে চোখ লাল করে টেবিল চাপড়ে যুক্তিতে অটল থাকার একরোখা ভবা। গণনাট্য নামক নাটকের দল থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে সিনেমার পথে পা বাড়ানোর শুরু এই প্যারাডাইস ক্যাফে থেকেই। প্যারাডাইস ক্যাফেতে পানু পাল, কালী ব্যানার্জী, সলিল চৌধুরী, হৃষিকেশ মুখার্জী, মৃণাল সেন ও ঋত্বিক ঘটক প্রভৃতির আড্ডা তখন বিখ্যাত ছিল।

১৯৫১ সালে তৈরি করেন জীবনের প্রথম চলচ্চিত্র ‘নাগরিক’। নানা জটিলতার ফাঁদে আটকে আর মুক্তি দিতে পারেননি চলচ্চিত্রটি। অনেক কষ্টে অর্থ জোগাড় করতে হয়েছিল। ধার করেছিলেন, গণচাঁদা তুলেছিলেন। তবুও শেষ রক্ষা হয়নি। চলচ্চিত্রের প্রসঙ্গে ঋত্বিক প্রায়ই একটি কথা বলতেন, ‘আমি সিনেমার প্রেমে পড়িনি। ওটাকে মানুষের কাছে পৌঁছানোর একটি মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করছি। কাল যদি সিনেমার থেকে ভালো কোনো মাধ্যম আমি পাই। তবে সিনেমাকে লাথি মেরে চলে যাব।’

না, বেঁচে থাকতে সিনেমার চেয়ে ভালো কোনো মাধ্যম তিনি পাননি মানুষের কাছে পৌঁছনোর। তাই জীবনের শেষ নিঃশ্বাস অবধি সিনেমাকে আঁকড়ে বেঁচেছিলেন। তাঁর তৈরি চলচ্চিত্রে সব সময় উঠে এসেছে দেশভাগ, উদ্বাস্তু কলোনির মানুষের জীবনযাত্রা এবং তাঁদের শেকড় ছেঁড়ার যন্ত্রণায় কাতর, আর্তনাদের করুণ দৃশ্য। ঋত্বিক ঘটকের তৈরি চলচ্চিত্রগুলোর ধারাকে সত্তরের দশকের প্রজন্মের অনেকেই ধরতে পারেননি। অনেকে সমালোচনা করেছেন, ব্যাঙ্গ-বিদ্রুপও করেছেন। জনৈক এক প্রযোজক বিদ্রুপ করে বলেছিলেন, ‘তুমি তো উদ্বাস্তু আর কলোনি ছেড়ে বেরোতেই পারছ না ভাই!’

দেশভাগের পর তৎকালীন পূর্ববঙ্গ (বর্তমান বাংলাদেশ) থেকে আসা উদ্বাস্তুদের জন্য ঋত্বিক ঘটক ছিলেন দারুণ সমব্যথী। কলকাতার রাস্তায় তাঁকে ভিক্ষা করতেও দেখেছেন অনেকে! তাই তো তাঁর কথায়-কাজে প্রতিটি পদক্ষেপে উঠে এসেছে কলকাতা শহরতলীর উদ্বাস্তু মানুষগুলোর কথা।

দেশভাগটা তিনি কখনোই মেনে নিতে পারেননি। কখনো যদি কেউ বলতো, আপনি তো ওপার বাংলার লোক তাই না? তখন ঋত্বিক ঘটক ক্ষেপে গিয়ে বলতেন, ‘বাংলার আবার এপার-ওপার হয় নাকি মশাই?’ তাঁর প্রথম নাটক ‘দলিল’। দেশভাগের সময় তিনি যে প্রচণ্ড আঘাত পেয়েছিলেন, এ নাটকে তা ভলো ভাবেই ফুটে ওঠে। নাটকটিতে একটি বিখ্যাত সংলাপ আছে, যা তিনি বাস্তব জীবনেও বলতেন, ‘বাংলারে কাটিবার পারিছ কিন্তু দিলটারে কাটিবার পারো নাই।’ ব্যক্তি জীবনে কখনো কখনো দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে অন্যমনস্ক হয়ে বলতেন, ‘আমিও কেমন রিফিউজি হয়ে গেলাম! দেশ ছাড়া এক রিফিউজি।’

ঋত্বিক ঘটকের স্ত্রী সুরমা ঘটক তাঁর লেখা ‘ঋত্বিক’ নামের বইতে স্মৃতিচারণ করেন এভাবে, ‘গেরুয়া পাঞ্জাবি পরা মানুষটির সাথে হাঁটতে হাঁটতে বহুদিন ওই রূপকথার দেশের বর্ণনা শুনেছি, শ্বশুরবাড়ির দেশে যাওয়ার সৌভাগ্য আমার হয়নি কিন্তু পদ্মা, হাওরবিল, কাশবন যেন দেখতে পেয়েছি।’

বাংলা ভাগের যন্ত্রণায় হতাশায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়েন ঋত্বিক, মদে আসক্ত হয়ে পড়েন ভীষণ ভাবে। যে মানুষটি জীবনের ৩৫ বছর পর্যন্ত মদের বোতলে হাত পর্যন্ত লাগাননি, এমনকি তাঁর চলচ্চিত্রের শ্যুটিংয়ে এবং এডিট স্পটে কেউ তাঁর ভয়ে মদের কথা উচ্চারণ পর্যন্ত করতে পারত না! অথচ মানুষটির এই অকালমৃত্যুর জন্য দায়ী এই মদ।

সাংসারিক জীবনে প্রচণ্ড উদাসীন ছিলেন। দায়বদ্ধতা ব্যাপারটি ঋত্বিক এড়িয়ে চলেছেন সব সময়। তাঁর স্ত্রী সুরমা ঘটক অনেক চেষ্টা করেছেন এ উদাসীনতাকে নিয়ন্ত্রণ করতে কিন্তু পারেননি। একটা সময় তিনি অনেকটা অভিমান আর ক্ষোভ নিয়ে চলে যান প্রত্যন্ত গ্রামে, স্কুলে শিক্ষকতার চাকরি নিয়ে। মৃত্যুর সময় পাশে থাকতে পারেননি সুরমা ঘটক। পাশে ছিলেন বন্ধু বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার মৃণাল সেন। ঋত্বিক ঘটকের মৃত্যুর পর মৃণাল সেন সুরমা ঘটককে টেলিগ্রাম করেন, ‘Ritwik Ghatak expired’।

এক সময়ের খুব কাছের বন্ধুরা দূরে সরে গেলেন। ঋত্বিক ঘটক নামের একটি আগুন হয়তো তাঁরা সহ্য করতে পারেননি। অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির একনিষ্ঠ কর্মী ছিলেন। এনারকিস্ট আখ্যা দিয়ে পার্টিও দূরত্ব বাড়ায় তাঁর সাথে। একে একে বাঁচার অবলম্বনগুলো হারাতে থাকা ঋত্বিক ঘটক এক সময় প্রচণ্ড মানসিক অবসাদে ভুগতে থাকেন। ১৯৬৯ সালে তাঁকে ভর্তি হতে হয় মানসিক রোগ নিরাময় কেন্দ্রে। সুস্থ হয়ে নতুন করে লড়াই শুরু করেন কিন্তু বিধাতা আর বেশি সময় দেননি। ১৯৭৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি মৃত্যুবরণ করেন এ কিংবদন্তি।

বর্তমান তরুণ প্রজন্মের একটি বৃহৎ অংশের কাছে (পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশ) খুব জনপ্রিয়তা পেয়েছেন ঋত্বিক। তাঁর তৈরি চলচ্চিত্রগুলো এখন মানুষ বুঝতে পারছে। হয়তো তিনি তাঁর সময় থেকে অনেকটা দূর এগিয়ে ছিলেন। আক্ষেপের বিষয়, জীবিত থাকতে তিনি কাজের প্রকৃত মূল্যায়ন পাননি। অনেকটা দেরিতে হলেও মানুষ তাঁকে বুঝতে পেরেছে, এটাই তাঁর কাজের সার্থকতা।

মৃত্যুর আগে একটুখানি ছায়ার আশায় ভবঘুরের মতো ছুটে বেরিয়েছেন মানুষের দ্বারে-দ্বারে। কি বন্ধু-বান্ধব, কি শুভাকাঙ্ক্ষী কারো ছায়াই পাননি তিনি। নিদারুণ অর্থকষ্টে জর্জরিত হয়েছেন। পাশে দাঁড়াননি কেউ, এড়িয়ে চলেছে সবাই। স্থিরতায় বিশ্বাস তাঁর কখনোই ছিল না; বদ্ধ জলার মতো এক জায়গায় আবদ্ধ না থেকে পাহাড়ি নদীর মতো লাফিয়ে চলার নীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন। অনেক ফিল্ম স্ক্রিপ্ট এবং নাটক লিখেছেন, যার একটা অংশ অপ্রকাশিতই থেকে গেছে বাণিজ্যিক ধারার চলচ্চিত্রের বিপরীতে পথচলায়।

সে সময় চলচ্চিত্র পাড়ার অনেকেই একবাক্যে স্বীকার করতো ঋত্বিক অনবদ্য-অপ্রতিরোধ্য এক আগুনের গোলা! কিন্তু কেউ তো এগিয়ে এলেন না ঝড়ো হাওয়া থেকে ঋত্বিককে বাঁচাতে! কালের গহ্বরে হারিয়ে যাওয়া রুখতে! একটি প্রশ্ন তো থেকেই যায়, কারো একটু ছায়া পেলে আর কয়েক বছর কি বাঁচতেন ঋত্বিক ঘটক?

লেখক: শিক্ষার্থী, হিসাববিজ্ঞান বিভাগ, হাবিবুল্লাহ বাহার কলেজ, ঢাকা।

এসইউ/এএসএম

আরও পড়ুন