ভিডিও EN
  1. Home/
  2. ফিচার

মাকড়সা কীভাবে ওড়ে?

শেখ আনোয়ার | প্রকাশিত: ০৪:২৩ পিএম, ০৯ ডিসেম্বর ২০২২

পৃথিবীর প্রথম স্থলচর প্রাণীদের মধ্যে অন্যতম আদী প্রাণীর নাম স্পাইডার বা মাকড়সা। মাকড়সা উপকারী প্রাণী। পৃথিবীতে প্রায় ৫০ হাজার প্রজাতির মাকড়সা রয়েছে! এদের সিংহভাগই নির্বিষ। এই বিশাল সংখ্যক প্রজাতির মধ্যেও রয়েছে বেশ কিছু বিষাক্ত প্রজাতির মাকড়সা। এদের কামড়ে মানুষের মৃত্যু পর্যন্ত ঘটতে পারে। তবে অনেকাংশেই এটি নির্ভর করে প্রাণীর আকার, বিষের পরিমাণ, বিষ সহনশীলতার ক্ষমতা এবং শরীরের রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতার উপর। মাকড়সার একটি বিশেষ গুণ হলো, এরা জাল তৈরি করে এবং জালের মাধ্যমে অন্যান্য কীট-পতঙ্গ খাবার হিসেবে শিকার করে। পরিবেশ বিজ্ঞানীরা বলেন, পোকামাকড় খেয়ে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে মাকড়সা। মাকড়সা কীটপতঙ্গ না খেলে পোকামাকড়ের সংখ্যা অনেক বেড়ে যেতো।

জীববিজ্ঞানীদের মতে, মাকড়সা কোনো পতঙ্গ নয়। এর মূল কারণ মূলত: দু’টো। প্রথমত, এদের পায়ের সংখ্যা আট। দ্বিতীয়ত, এদের দেহ, শরীর মাথা ও ধড় দু’ভাগে দুটো অংশে বিভক্ত। এদের মাথা ও বুক একসঙ্গে জুড়ে সেফালোথোরাক্স বা মস্তক-বক্ষ গঠন করে। অপেক্ষাকৃত প্রাচীন মাকড়সারা নিঃসঙ্গ শিকারি অর্থাৎ এরা জাল বোনে না। লাফিয়ে লাফিয়ে শিকার ধরে। এদের চেনার উপায় হলো নিচ দিকে বাকা দাঁড়া যা সোজা উপর নিচ নড়ে। মাকড়সার শরীরে কোনো অ্যান্টেনা নেই, পাখাও নেই। জীববিজ্ঞানে ওরা অ্যারাকনিডা শ্রেণির সন্ধিপদ সদস্য। প্রাণী জগতের সব প্রাণী চলাফেরার জন্য পেশি ব্যবহার করলেও মাকড়সা তা করে না। এর কারণ মাকডসার পেশি নেই। তাই গবেষকদের প্রশ্ন, তবে ওরা চলাফেরা করে কী করে? বিজ্ঞানীরা জানান, মাকড়সা চলাফেরা করে ‘হাইড্রোলিক পাওয়ার’ ব্যবহার করে। অর্থাৎ এদের পাগুলো শরীরের ভেতরের এক বিশেষ তরলের মাধ্যমে চলে।

মাকড়সার জাল টানলে অনেক লম্বা হয়, কিন্তু সহজে ছিঁড়ে না। গবেষকদের মতে, মাকড়সার জালের প্রসারিত হওয়ার ক্ষমতা স্টিলের চেয়েও বেশি। পা এবং হাঁটার কৌশলের কারণে ওরা নিজেদের জালে নিজেরা আটকে যায় না। এছাড়া ওদের শরীরের এক বিশেষ রাসায়নিকও আরেকটি কারণ। মাকড়সা নিঃসঙ্গ শিকারি। তবে সব মাকড়শার একজোড়া করে বিষগ্রন্থি রয়েছে। এদের অনেকের কামড় খুবই বিষাক্ত। তবে সব মাকড়সা প্রাণঘাতী নয়। মাকড়সার লোমশ শরীর দেখে অনেকেরই পিলে চমকে ওঠে। যারা মাকড়সা দেখে ভয় পায় তাদেরকে মেডিকেল সায়েন্সের ভাষায় বলা হয় ‘আরকোনফবিক’। মজার ব্যাপার হচ্ছে মাকড়সা কিন্তু দূরের কোনো কিছুই স্পষ্ট দেখতে পায় না। তাই দূর থেকে মাকড়সা দেখে ভয়ে দৌঁড়ে পালানোর কিছু নেই।

পৃথিবীতে অনেক রকম মাকড়সা হয়ে থাকে। কেউ জাল বোনে। কেউ লাফিয়ে শিকার ধরে। এমনকি কিছু মাকড়সা রয়েছে যেগুলো উড়ে চলে। সাগরের উপর দিয়েও ওড়তে পারে। অনেক উপরের আকাশে ওড়ে চলার মতো ক্ষমতাও রয়েছে এই মাকড়সার। কীভাবে সম্ভব মাকড়সার এই ওড়ে চলা? মাকড়সার এই গতিশক্তির আশ্চর্য ক্ষমতা নিয়ে বিজ্ঞানীরা গবেষণা করেছেন। লন্ডনের রোথামস্টেড রিসার্চের একটি টিম ক’দিন আগে একটি গাণিতিক মডেল তৈরি করে দেখিয়েছেন, মাকড়সা কোনো এক উপায়ে ওড়ে চলতে পারে। তারা এই পদ্ধতির নাম দিয়েছেন বেলুনিং। বিজ্ঞানীরা বলছেন, এ প্রক্রিয়াতেই মাকড়সা তার ঈপ্সিত দূরত্ব অতিক্রম করতে পারে। গবেষকরা প্রমাণ করে দেখিয়েছেন- একটি মাকড়সা ২০০ মিটার পর্যন্ত উপরে উঠে যেতে পারে। বিজ্ঞানীদের মতে, ‘বিজ্ঞানী চার্লস ডারউইন বিগল জাহাজে করে দক্ষিণ আমেরিকার উপকূলে প্রায় ১০০ কিলোমিটার দূরে গিয়েও এই উড়ন্ত মাকড়সাকে দেখতে পেয়েছেন। প্রচুর পরিমাণে ছোট ছোট মাকড়সা নতুন ঠিকানা স্থাপনের লক্ষ্যে সঙ্গীদের নিয়ে বাতাসে ভেসে বেড়ায়। এসময় তারা এক ধরনের সিল্কের মতো জাল বাতাসে ছুঁড়ে দিয়ে তাতে প্যারাসুটের মতো চড়ে বসে। ফলে বাতাস তাদের নিয়ে খুব সহজেই ওড়ে যায় দূর দূরান্তে। মাকড়সা এমনটা সবচেয়ে বেশি করে শরৎ ও বসন্তকালে। যদিও ভূমিতে যখন এরা ওড়ে বেড়ায় তখন বাতাস তাদের শুধু একটি মাঠে একপ্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত পর্যন্ত উড়িয়ে নেওয়ার মতো ক্ষমতাই প্রদর্শন করে। কিন্তু সমুদ্রে অবস্থানকালে বাতাসের তোড়ে এদের যাত্রার গতি থাকে অভাবনীয়। গত বিশ বছর ধরে হামফ্রে নামক একটি মডেলে মাকড়সার ওড়ে বেড়ানোর একটি গাণিতিক ব্যাখ্যাই কেবল দেখানো হয়েছে। কিন্তু রোথামস্টেড টিমের বিজ্ঞানীরা প্রমাণ করে দেখিয়েছেন, মাকড়সার ওড়ার শক্তি যোগায় একমাত্র বাতাস।

তুলনামূলকভাবে বড় উড়ন্ত মাকড়সা কীভাবে বাতাসে ভেসে ওড়ে? এ প্রশ্নের জবাবে গবেষকরা জানান, ‘আমরা শেষ পর্যন্ত গবেষণায় লক্ষ্য করেছি- মাকড়সা বাতাসে ওড়ার জন্য শুধু এক বা দু’টো সিল্ক ফাইবার ঘুরায় শুধু তা কিন্তু নয়। উড়ন্ত মাকড়সারা কয়েক ডজন পাতলা ফাইবার থেকে ‘প্যারাগ্লাইডার’ তৈরি করে। কিছু উড়ন্ত মাকড়সার প্রজাতি গ্লাইড বা উইন্ডসার্ফও করতে পারে। জার্মানির বার্লিনের টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটির এরোডাইনামিক ইঞ্জিনিয়ার মুনসুং চো বলেন, ‘আমাদের খালি চোখে তন্তুগুলো পর্যবেক্ষণ করা খুব কঠিন। এ কারণেই এখন পর্যন্ত আমরা বেলুনিং মাকড়সার ফ্লাইটের ব্যাখ্যা করতে পারিনি।’

তবে অনেক ধরনের মাকড়সা ‘বেলুন’ রেশম তন্তুগুলোর সাহায্যে ওড়ে। যা সাধারণত প্যারাগ্লাইডারের মতো কাজ করে। বাতাসের সঙ্গে শত শত কিলোমিটার এভাবেই ভ্রমণ করে উড়ন্ত মাকড়সা। এমনকি এসব উড়ন্ত মাকড়সার ৪.৫ কিলোমিটার পর্যন্ত উচ্চতায়ও পাওয়া গেছে। পৃথিবীর নতুন নতুন দ্বীপে পৌঁছানো প্রথম প্রাণীদের মধ্যে রয়েছে এই উড়ন্ত মাকড়সা।

বিজ্ঞানীরা বলছেন, এসব মাকড়সার জালগুলো খুবই মজবুত। বাতাসে এই জাল একটি বুদবুদের মতো ছড়িয়ে থাকে। খালি চোখে মাকড়সার এই বুদবুদের মতো জালগুলো দেখলে মনে হবে, ঠিক যেনো একটি ললিপপ। তবে আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, এই বুদবুদ নিজের ইচ্ছামতো দিক পরিবর্তন করতে পারে। এই ব্যাপারটি নিয়েই বিজ্ঞানীরা মন্তব্য করেন, মাকড়সার এই জাল প্রাকৃতিক হলেও অদ্ভুত এক আশীর্বাদ। মাকড়সার এই প্রাকৃতিক ক্ষমতা অন্য যে কোনো প্রাণীর জন্য ঈর্ষনীয় বৈকি!

গবেষক দল এবার মাকড়সা নিয়ে একটি বাতাসের টানেলে ছাড়বেন বলে চিন্তা-ভাবনা করছেন। গবেষকদের ধারণা এই টানেলে যখন মাকড়সার দল তাদের জাল ছড়ানো শুরু করবে, তখনই তাদের নতুন গবেষণা আরও স্বচ্ছ হয়ে উঠবে। বিজ্ঞানীদের মতে, মাকড়সা নিয়ে এখন ব্যাপক গবেষণা হওয়া উচিত। কারণ কৃষিক্ষেত্রে মাকড়সা একটি বড় শত্রু হয়ে ওঠেছে। লক্ষ্য করা গেছে, ফিলিপিন্সে বেশ কয়েকটি পপির ক্ষেতে এক দূর্লভ প্রজাতির মাকড়সার প্রাদুর্ভাবে ফসলের দারুণ ক্ষতি হয়েছে। এমনকি দক্ষিণ এশিয়ার বেশ কয়েকটি কৃষি নির্ভর দেশেও মাকড়সার উপদ্রব বেড়ে গেছে। যদি কোনোভাবে মাকড়সার এই উৎস চিহ্নিত করা যায়, তাহলে আশা করা যায়, এ সমস্যার সমাধানে মানুষ এগিয়ে যাবে। একই সঙ্গে উপকারী এই মাকড়সা পরিবেশ ভারসাম্য রক্ষার কজেও ব্যবহৃত হতে পারে। বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, এ ধরনের গবেষণা চালিয়ে নেওয়ার জন্য আরও অনেক সময় ও অর্থের প্রয়োজন।

মাকড়সা নিয়ে কতখানি ফলপ্রসু গবেষণা হচ্ছে সেটিও ভাবার বিষয়। তবে মাকড়সার বিষ বিশ্বব্যাপী সৌন্দর্য্য বর্ধক সেরা পণ্যের উপাদান ও মেডিকেল থেরাপির কাজেও ব্যবহার হয়ে থাকে বলে জানা যায়। যুক্তরাজ্যের ব্রিস্টল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্প্রতিক নতুন এক গবেষণায় জানা যায়, উড়ন্ত মাকড়সা ওড়ার সময় নিজেদের শরীর থেকে উৎপন্ন জড় বিদ্যুৎ ব্যবহার করে থাকে। তবে উড়ন্ত মাকড়সা নিয়ে চলতি গবেষণায় মাকড়সা জগতের অনেক নানারকম অজানা গুপ্তরহস্য উদঘাটন করা যাবে বলে গবেষকরা প্রত্যাশা করছেন।

লেখক: বিজ্ঞান লেখক ও গবেষক। এম.ফিল স্কলার, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

কেএসকে/এএসএম

আরও পড়ুন