ভিডিও EN
  1. Home/
  2. ফিচার

মুক্তিযুদ্ধের সহায়ক শক্তি বিদেশি গণমাধ্যম

মো. সাঈদ মাহাদী সেকেন্দার | প্রকাশিত: ১২:৩৩ পিএম, ০১ ডিসেম্বর ২০২২

জাতিগতভাবে বাংলাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও গৌরবময় অধ্যায় হচ্ছে স্বাধীনতা লাভ। দীর্ঘদিনের শোষণ বঞ্চনা আর পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে স্বাধীন বাংলাদেশ হিসেবে বিশ্ব মানচিত্রে নিজের অস্তিত্বের জানান দেয় বাংলাদেশ। নয় মাস রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতা সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর অর্জিত হয় আমাদের কাঙ্ক্ষিত বিজয়। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দ্বারা রচিত ৭১ এর গণহত্যা নাড়া দিয়েছিল বিশ্ব বিবেককে। মুক্তিযুদ্ধকালীন মুজিবনগর সরকার, দেশীয় পত্রপত্রিকা-সংবাদমাধ্যম, প্রবাসী বাঙালি এবং বিশ্বের একাধিক দেশ থেকে বিভিন্ন ভাষায় প্রকাশিত নিয়মিত-অনিয়মিত পত্রপত্রিকায় পাকিস্তান বাহিনীর গণহত্যা-বর্বরতা, সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ-দুর্দশা, মুক্তিযুদ্ধের ঘটনা গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরা হয়। বৈদেশিক ও অভ্যন্তরীণ অসংখ্য পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ-সম্পাদকীয়, কবিতা-গান, প্রবন্ধ-কার্টুন প্রভৃতির মাধ্যমে পাকিস্তানিদের নির্মম-নৃশংসতার নিন্দা-ক্ষোভ এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রতি সমর্থন তুলে ধরা হয়। এতে বীর মুক্তিযোদ্ধারা উদ্বুদ্ধ-অনুপ্রাণিত হয় ও জনমনের প্রত্যাশা বৃদ্ধি এবং বিশ্ব জনমত গঠনে সহায়ক হয়।

১৯৭১ সালের শুরু থেকেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা ও নয় মাসব্যাপী চলা স্বাধীনতা সংগ্রামের খবর গুরুত্ব সহকারে প্রচারিত হয় আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অন্যতম সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করেছে বিদেশি গণমাধ্যম। বিশেষ করে বিদেশি প্রিন্ট মিডিয়া তখন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পাশে ছিল। এ ছাড়া বিদেশি সাংবাদিকরা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পাকিস্তানি বাহিনীর ধ্বংসযজ্ঞ, নির্মমতা এবং বর্বরতার কাহিনি ছড়িয়ে দেন। এতে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর অপপ্রচারে বিশ্ববাসী বিশ্বাস করেনি। একাত্তরের ২৫ মার্চের গণহত্যার চিত্র যাতে বিশ্ববাসী জানতে না পারে, সে জন্য পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বিশেষ ব্যবস্থা নিয়েছিল। কিন্তু ব্রিটিশ সাংবাদিক সাইমন ড্রিংয়ের জন্য তাদের সে পরিকল্পনা সফল হয়নি। সাইমন ড্রিংই সর্বপ্রথম বিশ্ববাসীকে জানান, পূর্ব পাকিস্তানে গণহত্যা হয়েছে। তিনি লন্ডনের ডেইলি টেলিগ্রাফে লেখেন, ‘ট্যাংকস ক্রাশ রিভোল্ট ইন ইস্ট পাকিস্তান’। ১৯৭১ সালের ৩০ মার্চ লন্ডনের ডেইলি টেলিগ্রাফের সাংবাদিক সাইমন ড্রিংয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘পাকিস্তান সেনাবাহিনী ঠান্ডা মাথায় ২৪ ঘণ্টা অবিরাম গোলাবর্ষণ করে প্রায় ১৫ হাজার মানুষকে হত্যা করে। পুলিশ সদরদপ্তর, ছাত্রাবাস, দোকানপাটে নির্বিচারে হত্যা ও আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। বাঙালি জনগণ যে স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিল, তা গত সপ্তাহে বেদনাদায়ক এক গণহত্যার মাধ্যমে শেষ হয়ে গেছে। এই দুঃস্বপ্ন ভুলতে তাদের কয়েক প্রজন্ম লেগে যাবে।’

মুক্তিযুদ্ধে বিদেশি গণমাধ্যমের ভূমিকাবিষয়ক তথ্যানুসন্ধানে দেখা যায়, ‘১৯৭১ সালে যুদ্ধের শুরু থেকেই বিদেশি সাংবাদিকরা পাকিস্তানি বাহিনীর ধ্বংসলীলা, নির্মম হত্যাযজ্ঞ, ধর্ষণ ও নিপীড়নের বর্বরতার কাহিনি খুব দ্রুত আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ছড়িয়ে দিতে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। আশ্চর্যজনক ব্যাপারটি হলো, বাংলাদেশের স্বাধীনতার ব্যাপারে বিশ্বের বেশ কিছু দেশের সমর্থন না থাকার পরও বাংলাদেশে অবস্থানকারী সেসব দেশের সাংবাদিকরা এ যুদ্ধের অমানবিকতার বিপক্ষে এবং সর্বোতভাবে বাংলাদেশের মানুষের পক্ষে ঝুঁকিপূর্ণ ও দায়িত্বশীল ভূমিকা নিতেও পিছু হটেননি।

এপ্রিল মাসে ঢাকার ‘স্বাভাবিক’ অবস্থা বিশ্ববাসীকে জানানোর উদ্দেশ্যে পাকিস্তান সামরিক সরকার ৮ জন সাংবাদিককে ঢাকায় নিয়ে আসে। কিন্তু আমন্ত্রিত সাংবাদিকদের মধ্যে করাচির সাংবাদিক অ্যান্থনি মাসকারেনহাস প্রোপাগান্ডা ছড়াতে সহযোগিতার বদলে তুলে ধরেন প্রকৃত চিত্র। তিনি পূর্ব বাংলায় ১০ দিন অবস্থান করে যুদ্ধাপরাধের নানা তথ্য নিয়ে ‘জেনোসাইড’ শিরোনামে দ্য সানডে টাইমসে ১৩ জুন ১৯৭১ প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেন। সানডে টাইমসে অ্যান্থনি মাসকারেনহাসের দুই পৃষ্ঠাজুড়ে সেই রিপোর্ট ও হেডিং এখন এক ইতিহাস হয়ে উঠেছে। এ ছাড়া দ্য নিউইয়র্ক টাইমসের সিডনি শনবার্গ, ইতালির সাংবাদিক ওরিয়ানা ফালাচি, ফরাসি সাংবাদিক বার্নার্ড হেনরি লেভিসহ অনেক বিদেশি সাংবাদিক বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সরাসরি প্রতিবেদন প্রকাশ করে বাংলার মুক্তির পক্ষে বিশ্ব জনমত সৃষ্টিতে দায়িত্বশীল ভূমিকা নেন। ভারতীয় গণমাধ্যমের প্রতিবেদকরা সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে এসে মুক্তিযুদ্ধের তথ্য প্রকাশ করেন। এভাবে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ফ্রান্স, জার্মানি, জাপান ছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিখ্যাত গণমাধ্যমের প্রতিবেদকরা সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে মুক্তিযুদ্ধের সংবাদ প্রকাশ করেন।

১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ লন্ডন থেকে প্রকাশিত দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকার প্রথম পাতায় নতুন দিল্লি থেকে তাদের সাংবাদিক ডেভিড লোমাকের পাঠানো সংবাদের ভিত্তিতে ‘সিভিল ওয়ার ইন ইস্ট পাকিস্তান/শেখ আ ট্রেইটর, সেইস প্রেসিডেন্ট’ শিরোনামে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণার কথা লেখা হয়। ২৫-২৬ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধুর ‘স্বাধীনতা ঘোষণা’ বিশ্বের বিভিন্ন পত্রপত্রিকা ২৭ মার্চ ১৯৭১ প্রকাশ করে। ‘ডিক্লেয়ার ইনডিপেনডেন্স’ শিরোনামের নিচে লেখা হয়েছে, ‘শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ হিসেবে ঘোষণা দিলে সেখানে গৃহযুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে।’

সিঙ্গাপুরের জাতীয় পত্রিকা দ্য নিউ নেশনে বাংলাদেশে পাকিস্তানিদের হত্যাকাণ্ডের খবর তুলে ধরে বলা হয়, ‘পূর্ব পাকিস্তানে নৃশংস হত্যাকাণ্ড বন্ধ করতেই হবে–অভ্যন্তরীণ সার্বভৌমত্বের পাণ্ডিত্যপূর্ণ ব্যাখ্যা শুনিয়ে বিশ্ব বিবেকের কণ্ঠ রোধ করা যাবে না।’ ভারতীয় গণমাধ্যমে প্রতিবেদকরা সবার আগে সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে এসে মুক্তিযুদ্ধের তথ্য প্রকাশ করে। এরপর যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ফ্রান্স, জার্মানি, জাপান ছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিখ্যাত গণমাধ্যমের প্রতিবেদকরা সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশ প্রবেশ করে মুক্তিযুদ্ধের সংবাদ প্রকাশ করেছেন।

বিশ্বের সর্বাধিক প্রভাবশালী গণমাধ্যম বিবিসি ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ প্রচার করে, ‘পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষের হুলিয়া সত্ত্বেও আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের সমর্থকরা এখনো যশোর, চট্টগ্রাম ও কুমিল্লা নিয়ন্ত্রণ করছে।’ ১৮ এপ্রিল, লন্ডনের দ্য অবজারভার গণমাধ্যমে ‘স্বপ্নভঙ্গের পথে বাংলাদেশ’ শিরোনামে এক সংবাদ প্রকাশ করে। এতে পাকিস্তানি বাহিনীর নির্মম হত্যাযজ্ঞ, ধর্ষণ, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ, ছাত্রহত্যা এবং লেখক ও সাংবাদিক হত্যার খবর ছাপে। ১২ এপ্রিল, নিউজউইক ‘একটি আদর্শের মৃত্যু’ শিরোনামে সংবাদ ছাপে। এ ছাড়া ১৩ জুন, দি সানডে টাইমস ‘গণহত্যা’ নামে ১৪ পৃষ্ঠার এক প্রতিবেদন ছাপে যার লেখক ছিলেন প্রত্যক্ষদর্শী সাংবাদিক অ্যান্থনি মাসকারেনহাস। ভারতের নয়াদিল্লি থেকে ‘দি উইকলি নিউএজ’ পত্রিকা ২৬ সেপ্টেম্বর ‘বিজয় নিশ্চিত’ শিরোনামে এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে।

মুক্তিযুদ্ধকালে রিপোর্টিংয়ে অনেক ধরনের উদাহরণ তৈরি করেছেন বেশ কিছু সাংবাদিক। ৭ মার্চের ভাষণের পর বঙ্গবন্ধুকে ঘিরে নিউজউইকের বক্স আইটেম ‘পোয়েট অব পলিটিকস’ এমনই এক উদাহরণ, যেখানে চলমান ঘটনার ভাষ্য তাৎপর্যে ছাপিয়ে যায় সমসাময়িকতা। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের মহান মুক্তিযুদ্ধে দেশীয় গণমাধ্যমের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের ভূমিকা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। গণমাধ্যমের কারণে বিশ্ববাসী মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ঘটনা জানতে পেরেছে। এতে একদিকে পাকিস্তানি বর্বরতা-নৃশংসতার প্রতি ঘৃণার উদ্রেক হয়েছে, অন্যদিকে বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি সহানুভূতি-সমর্থন বৃদ্ধি পেয়েছে। অধিকন্তু আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের সাহস-মনোবল-শক্তি সঞ্চার করেছে; ফলশ্রুতিতে আমাদের স্বাধীনতা অর্জন ত্বরান্বিত হয়েছে এটি স্বীকার্য সত্য।

৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বিজয় অর্জিত হওয়ার পর বিখ্যাত ব্রিটিশ পত্রিকা লন্ডন টাইমস বলেছিল, ‘If blood is the price of independence then Bangladesh has paid the highest price in history’ (London Times, 1971). লন্ডন টাইমসের এই উক্তির মাধ্যমে আসলে সহজেই অনুমেয় কী পরিমাণ আত্মত্যাগের মাধ্যমে অর্জিত হয়েছে আমাদের স্বাধীনতা। মুক্তিযুদ্ধ সংক্রান্ত বুদ্ধিদীপ্ত ও সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আমাদের ঋণী করেছে। ইতিহাসের সঙ্গে গণমাধ্যমের সম্পর্ক অতি নিবিড় এবং ঘনিষ্ঠ। ইতিহাসচর্চা কিংবা রচনা দুটি ক্ষেত্রেই গণমাধ্যম গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানা কিংবা বোঝার জন্য তৎকালীন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের ভূমিকা আমাদের ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করেছে। এ দেশের স্বাধীনতা অর্জনের মহান মুক্তিযুদ্ধে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম জনমত গঠনের পাশাপাশি আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের সাহস-মনোবল-শক্তি সঞ্চার করেছে। সুতরাং গণমাধ্যমের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ সমর্থন ও সহযোগিতা মুক্তিযুদ্ধে শক্তি সঞ্চারের পাশাপাশি বিজয়কে ত্বরান্বিত করেছে এটি সহজে অনুমেয়।

লেখক: সাবেক সহ-সম্পাদক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ ও সাবেক সাধারণ সম্পাদক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় সাংস্কৃতিক কেন্দ্র।

এসইউ/এএসএম

আরও পড়ুন