পা নেই, মাথা দিয়েই ফুটবল খেলেন ঘানিম আল মুফতাহ
গর্ভকালীন কিছু ত্রুটির কারণে শরীরের নিম্নাংশের গঠন হয়নি। জন্ম দুই পা ছাড়া। কোমরের নিচের অংশ ছাড়াই দুই হাতে ভর করে চলছেন তিনি। শুধু চলছেন না বলা যায় অন্যদের থেকে অনেক এগিয়ে তিনি। কাতারের বাসিন্দা ২০ বছর বয়সী কিশোর ঘানিম আল মুফতাহ। গতকাল ফিফা বিশ্বকাপের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের পর সারা বিশ্ব এখন তাকে এক নামে চেনে।
ফিফা বিশ্বকাপের ইতিহাসে প্রথমবারের কোরআন তেলাওয়াতের আয়োজন করে বিশ্বকে তাক লাগিয়েছে কাতার। ৯২ বছরের ইতিহাসে এই ইতিহাস সৃষ্টির সঙ্গে জড়িয়েছে দেশটির ২০ বছর বয়সী যুবক ঘানিম আল মুফতাহর নাম। বিশেষভাবে সক্ষম(শারীরিক প্রতিবন্ধকতা) এ যুবক মানবদরদি হিসেবেই পরিচিত। কাতারে এমনকি পুরো বিশ্বে তিনি অন্যতম একজন মোটিভেশনাল স্পিকার হিসেবে পরিচিত।
জন্ম থেকেই পা নেই ঘানিমের। কডাল রিগ্রেশন সিন্ড্রোমে আক্রান্ত তিনি। মাতৃগর্ভে থাকার সময় আলট্রা-সাউন্ড মেশিনে ধরা পড়ে তার শরীরের অবিকশিত অংশ। চিকিৎসক তার মাকে গর্ভপাত করাতে বলেন। ঘানিমের মা-বাবা এই সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারেননি। কারণ ইসলামে গর্ভপাত হলো চূড়ান্ত অপরাধ। ঘানিমের বাবা মুহাম্মদ-আল-মুফতাহ এবং মা ইমান-উল-আবদেলি তাদের সন্তানকে পৃথিবীর আলো দেখান। ২০০২ সালের ৫ মে ঘানিম আল মুফতাহর জন্ম। চিকিৎসকরা বলেছিলেন যে তার ১৫ বছরের বেশি বেঁচে থাকার সম্ভাবনা নেই। এখন ঘামিনের বয়স ২০ বছর।
ঘানিমের আহমদ আল মুফতাহ নামে জমজ ভাই রয়েছে। বাবা-মার কাছে ভালোবাসা পেলেও ছোট থেকেই পদে পদে সামাজিক বঞ্চনার শিকার হয়েছেন তিনি। স্কুল, খেলার মাঠসহ বিভিন্ন জায়গায় তাকে অপমানিত হতে হয়েছে। প্রথমে তাকে কোনো স্কুলেও ভর্তি নিতে চায়নি। ঘানিমের বাবা-মার অনেক অনুরোধের পর স্থানীয় স্কুলে ভর্তি করানো হয় তাকে। কিন্তু তিনি এসবের কোনো তোয়াক্কা না করেই এগিয়ে যেতেন নিজ পথে, একেবারে নিজস্ব ছন্দে। বন্ধুদের বোঝাতেন, তার অসম্পূর্ণ শরীরের জন্য তিনি মোটেও দোষী নন। সৃষ্টিকর্তা তাকে যে পরিমাণ অঙ্গ-প্রতঙ্গ প্রদান করে পাঠিয়েছেন, এজন্য তিনি কৃতজ্ঞ।
নিজের সহপাঠী, বন্ধুবান্ধবদের এসব বোঝাতে বোঝাতে নিজের অজান্তেই তিনি হয়ে ওঠেন একজন মোটিভেশনাল স্পিকার। একদিন যার ভূমিষ্ঠ হওয়া নিয়েই যথেষ্ট সন্দেহ ছিল, তার হাতে উদ্বোধন হতে চলেছে বিশ্বের সবচেয়ে বিখ্যাত এক প্রতিযোগিতার আসর। গোটা কাতার তথা আরব দুনিয়ার একজন রোল মডেল। আরবের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে রয়েছে তার ভক্ত, সমর্থক।
সব প্রতিকূলতাকে পাশ কাটিয়ে ঘানিম কাতারের জনপ্রিয় ইউটিউবার, একজন জনপ্রিয় মোটিভেশনাল স্পিকার ও মানবসেবী। আল মুফতাহ প্রথমবার বিশ্ববাসীর সামনে হাজির হন ২০১৮ সালে। তখন তার বয়স মাত্র ১৬ বছর। কাতার বিশ্ববিদ্যালয়ে আয়োজিত টেডএক্সের অনুপ্রেরণামূলক অনুষ্ঠানে তিনি তার কডাল রিগ্রেশন সিনড্রোম নিয়ে কথা বলেন। যে রোগে আক্রান্ত হলে মানুষের শরীরের নিচের অংশ বৃদ্ধি পায় না।
কোরআন তেলাওয়াতের অংশ ছাড়াও ঘানিম এবারের বিশ্বকাপে ফিফার শুভেচ্ছাদূত মনোনীত হন। ঘানিম তার পরিবারের সাহায্যে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা গঠন করেছেন। তার মতো যারা পায়ে চলাচল করতে পারেন না, এ সংস্থা থেকে তাদের হুইলচেয়ার উপহার দেওয়া হয়। মানবদরদী কাজের জন্য তিনি সারা পৃথিবীতেই পরিচিত। ২০১৪ সালে কুয়েতের আমির শেখ শাবাহ আল আহমদে আল শাবাহ তাকে ‘শান্তির দূত’ নামে অভিহিত করেন।
মোটিভেশনাল স্পিকার ছাড়াও তিনি একজন কবি, সাহিত্যিক। এছাড়া খেলাধুলায়ও পিছিয়ে নেই ঘানিম। ফুটবল তার পছন্দের খেলা। স্কুল জীবন থেকেই হাতে ভর দিয়ে মাথা দিয়ে ফুটবল খেলে আসছেন। মাঝে মাঝে হাতে বুট লাগিয়ে খেলতেন ফুটবল। তার ইচ্ছে প্যারালিম্পিয়ানে খেলা। সে লক্ষ্য নিয়ে তিনি ফুটবল খেলা চালিয়ে যাচ্ছেন। এছাড়া সাঁতার, স্কেটিং, বক্সিং সার্ভিং, স্কুবা ডাইভিংসহ বিভিন্ন খেলাধুলায় অংশ নেন। আরবের সবচেয়ে বড় পাহাড় জাবেল শামসের চূড়ায় উঠেছেন।
ইংল্যান্ডের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী ঘানিম। ঘারসিয়া আইসক্রিম নামের একটি নিজস্ব কোম্পানি আছে মুফতাহর। কাতারে এটির আছে ছয়টি শাখা। এর মাধ্যমে কাতারের সর্বকনিষ্ঠ উদ্যোক্তা হন তিনি। ঘানিম দেশের প্রধানমন্ত্রী হতে চান। এজন্য ছোটবেলা থেকেই রাষ্ট্রবিজ্ঞান নিয়ে পড়ার ইচ্ছা ছিল। বর্তমানে তিনি ইংল্যান্ডের লফবরো বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী।
ঘানিম ইউটিউব এবং ইনস্টাগ্রামে বেশ সরব থাকেন। তার রয়েছে অসংখ্য ফলোয়ার। ঘানিমের ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্টে তিনি বিভিন্ন ছবি এবং ভিডিও শেয়ার করেন। ৩.২ মিলিয়ন বা ৩২ লাখের বেশি ফলোয়ার রয়েছে তার ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্টে। ইউটিউবে রয়েছে ৮ লাখ সাবস্ক্রাইবার। ঘানিম আল-মুফতাহের আনুমানিক সম্পদ ১.৫ মিলিয়ন ডলার।
সূত্র: দ্য এপিক টাইমস, গালফ টাইমস
কেএসকে/জেআইএম