দর্শন মানুষকে মানবিক করে তোলে
মানুষ জন্মগতভাবেই দার্শনিক। তারা ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠার মধ্যেও দর্শন লালন করেন। আমরা হয়তো তার প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পাই না বা জানি না। প্রত্যেক মানুষের অন্তরেই দর্শন বিরাজ করে। সেই দর্শনের ধারা ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে। যেহেতু প্রত্যেকের দেখার চোখ আলাদা। আলাদা তাদের বোধ ও অনুভূতি। সুতরাং সব মানুষকেই দার্শনিক বলা যায়। তবে প্রাতিষ্ঠানিক দর্শনতত্ত্ব ভিন্ন বিষয়।
দর্শনকে ইংরেজিতে ফিলোসফি (philosophy) বলা হয়। গ্রিক ভাষায় ‘ফিলোসোফিয়া’, যা আক্ষরিকভাবে ‘জ্ঞানের প্রতি ভালবাসা’ বোঝায়। মূল কথা হলো- দর্শন মানে অস্তিত্ব, জ্ঞান, মূল্যবোধ, কারণ, মন এবং ভাষা সম্পর্কে সাধারণ এবং মৌলিক প্রশ্নগুলোর অধ্যয়ন। জগৎ, জীবন, মানুষের সমাজ, তার চেতনা এবং জ্ঞানের প্রক্রিয়া প্রভৃতি মৌল বিধানের আলোচনাকেও দর্শন বলা হয়।
২০১৫ সালের আগ পর্যন্ত দর্শনের সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক ছিল না। তখন পর্যন্ত জানতাম না, দর্শন আসলে কী? অবশ্য প্রত্যেকটা মানুষের মধ্যে দর্শন রয়েছে। আমাদের একেক জনের চিন্তা-ভাবনা একেক ধরনের। আমার মতে, দর্শন অর্থ হলো ‘জানা’। অর্থাৎ কোনো বিষয় সম্পর্কে জানতে চাওয়া, প্রশ্ন করা, অনুসন্ধান করাই হলো দর্শন।
তাহলে সে অর্থে বোঝা যাচ্ছে, আগে থেকেই দর্শন আমার মধ্যে ছিল। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগে ভর্তি হওয়ার পর থেকে জানতে চাওয়ার পরিমাণ বেড়ে গেল শুধু। কোনো কাজ করতে গেলে মনে প্রশ্ন আসে, যে কাজটি করছি; তা ঠিক হচ্ছে কি না? এই মনের মধ্যে প্রশ্ন আসা মানেই হলো দর্শন। এরপর তার অনুসন্ধান করা। দর্শন মানুষকে মানবিক ও নীতিবান হতে শিক্ষা দেয়। বলতে গেলে, দর্শনই আদি জ্ঞানের মূল ভান্ডার। কেননা জগৎ ও জীবনের প্রত্যেকটি সমস্যা মানুষের কাছে প্রশ্নাকারে উত্থাপিত হয়। যে প্রশ্নই উপস্থিত হোক না কেন, মানুষ তার একটা জবাব দিয়ে প্রকৃতিকে বশ করার চেষ্টা করেছে।
২০১৫ সাল থেকে আমার দর্শনের সঙ্গে পথ চলা। সত্যিকার অর্থে, আমাদের পড়াশোনা হচ্ছে একটি সনদ অর্জন করা। আর কিছু প্রশ্ন পড়ে খাতায় উত্তর দিয়ে চলে আসা। ভবিষ্যতে একটি ভালো চাকরি পাওয়া। কিন্তু কেউ যদি দর্শনকে জানার জন্য পড়েন, তাহলে তিনি সত্যিকার অর্থে দর্শনকে ধারণ করতে পারবেন। তা না হলে কখনোই সম্ভব নয়।
আমাদের সমাজে দর্শন নিয়ে একটি ভুল ধারণা আছে, তা হলো—দর্শন যারা পড়েন, তারা নাস্তিক। সত্যিকার অর্থে এমনটি কখনো আমি হতে দেখিনি। আসলে নাস্তিকতা হচ্ছে ব্যক্তির একান্ত নিজস্ব ব্যাপার। দর্শন না পড়েও, না জেনেও নাস্তিক হওয়া যায়। কেননা তিনি কী বিশ্বাস করবেন, কী বিশ্বাস করবেন না; সেটি তাকেই ভাবতে দেওয়া উচিত। কেউ দর্শন নিয়ে পড়লে নাস্তিক হয়ে যাবেন, এমনটা বলা উচিত নয়। দর্শন মানুষকে চিন্তা করতে শেখায়। দর্শন বলতে বোঝায় জগৎ ও জীবনের মৌলিক সমস্যাবলির যৌক্তিক অনুসন্ধান করা। কোনো কিছু অনুসন্ধানে তো দোষ নেই।
দর্শন বিভাগে ভর্তি হওয়ার পর আমি যখন গ্রামের বাড়ি যেতাম; তখন কেউ জিজ্ঞাসা করলে বলতাম না, আমি কোন বিষয় নিয়ে পড়ছি। কারণ হলো একবার একজন জিজ্ঞাসা করলেন, আমি কী বিষয় পড়ছি। তখন দর্শন বলার পর তিনি আমাকে অন্যভাবে দেখলেন। আমি কষ্ট পেয়েছিলাম তার আচরণে। তবে এখন আর কষ্ট পাই না। কারণ দর্শনের প্রতি আছে আমার ভালো লাগা ও ভালোবাসা। যদিও তখন থেকে দর্শন না বলে ‘ফিলোসফি’ বলি। আমরা তো বাংলা থেকে ইংরেজিকে বেশি গুরুত্ব দেই। ফিলোসফি বললে গুরুত্ব বেড়ে যায়। আর যারা দর্শন সম্পর্কে জানেন, তাদের বিষয় আলাদা। অনেককেই দেখেছি, যারা দর্শনের শিক্ষার্থী না হয়েও দর্শন চর্চা করছেন, দর্শনকে লালন ও ধারণ করছেন।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১৪-২০১৫ শিক্ষাবর্ষে দশম ব্যাচের শিক্ষার্থী হিসেবে ভর্তি হয়েছিলাম। তখন হতাশ হয়েছিলাম, সেই হতাশা এখন আর নেই। কারণ এখানে সততা আছে, প্রকৃত মানুষ হওয়ার পথ খোলা আছে। সক্রেটিসের একটি উক্তি আছে—‘নিজেকে জানো’। বাক্যটি অনেক গুরুত্ব বহন করে। বাউল লালন ফকিরও বলেছেন, ‘একবার আপনারে চিনতে পারলে রে যাবে অচেনারে চেনা।’সত্যিকার অর্থে নিজেকে জানতে পারলে সবাইকে জানা যায়। আমরা আসলে নিজেকেই জানি না, তাহলে কীভাবে অন্যকে জানতে পারবো বা বুঝতে পারবো? তাই আগে নিজেকে জানাই জরুরি।
অপরদিকে, দর্শনকে গুরুত্ব দিয়ে ইউনেস্কো নভেম্বর মাসের তৃতীয় বৃহস্পতিবার ‘বিশ্ব দর্শন দিবস’ ঘোষণা করেছে। দিবসটি সর্বপ্রথম ২০০২ সালে ২১ নভেম্বর উদযাপিত হয়েছিল। সে অনুসারে এ বছর ১৭ নভেম্বর বিশ্ব দর্শন দিবস পালিত হচ্ছে। সুতরাং বুঝতেই পারছেন, দর্শন গুরুত্বহীন কোনো বিষয় নয়। প্রত্যেক মানুষের জীবনেই দর্শন গুরুত্ব বহন করে। তাই সবশেষে বলব, মানুষ নিজেকে জানুক, ভালোভাবে চলুক, পৃথিবী শান্ত হোক।
লেখক: সাবেক শিক্ষার্থী, দর্শন বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।
এসইউ/এএসএম