ভিডিও EN
  1. Home/
  2. ফিচার

চতুর্থ শিল্প বিপ্লব উপযোগী মানুষ তৈরির দায়িত্ব শিক্ষকদের

ফিচার ডেস্ক | প্রকাশিত: ১২:২৯ পিএম, ০৫ অক্টোবর ২০২২

খুরশীদুজ্জামান আহমেদ

মানবসভ্যতা পূর্বে যেমন ছিল আর বর্তমানে যা আছে, তা এ সভ্যতারই পরিবর্তিত রূপ। এ পরিবর্তন বা ক্রমবিকাশের মূলে রয়েছে শিক্ষা। মানবসভ্যতার বিবর্তনের মূলে যেমন শিক্ষার ভূমিকা রয়েছে; তেমনই শিক্ষার বিবর্তনেও মানব জাতির চাহিদার ভূমিকা রয়েছে। মানুষ নিজের প্রয়োজনেই শিক্ষা গ্রহণ করে এবং শিক্ষাব্যবস্থার উন্নতি ঘটায়, ফলে সমাজ এগিয়ে যায়।

আজ ৫ অক্টোবর। বিশ্ব শিক্ষক দিবস। বাংলাদেশসহ বিশ্বের শতাধিক দেশ আজ যথাযোগ্য মর্যাদায় দিনটি পালন করছে। এবারের প্রতিপাদ্য ‘শিক্ষার রূপান্তর শুরু হয় শিক্ষকদের দিয়ে’। ১৯৯৪ সালের ৫ অক্টোবর প্রথম বিশ্ব শিক্ষক দিবস অনুষ্ঠিত হয় আইএলও ও ইউনেসকোর উদ্যোগে। শিক্ষকবৃন্দের অবদানের স্বীকৃতির প্রতিফলন হিসেবে প্রতিবছর বিশ্ব শিক্ষক দিবস পালিত হয়ে আসছে। এটি অনিবার্য সত্য যে, মানবসম্পদ সৃষ্টি ও সমাজের উন্নয়নে শিক্ষকদের ভূমিকাই সবার আগে। যে কোনো জাতির আলোকবর্তিকা ও প্রেরণার বাতিঘর আমাদের শিক্ষকরাই। একজন শিক্ষক আজীবন দায়িত্ব পালন করেন নিবেদিত হয়ে মানবজাতির সমৃদ্ধ ভবিষ্যত তৈরির জন্য। শিক্ষার সূচনা পরিবার থেকে হলেও পূর্ণতা পায় শিক্ষকের ছোঁয়ায়।

চতুর্থ শিল্প বিপ্লবে প্রবেশ করেছি আমরা। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের অন্যতম প্রধান প্রভাব হলো মানুষের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি। এআই, রোবোটিক্স, আইসিটি, থ্রি-ডি প্রিন্টিং এবং কোয়ান্টাম কম্পিউটিং অটোমেশনের মতো প্রযুক্তি আমাদের পেশাগত জীবনকে করে তুলেছে গতিময় এবং চ্যালেঞ্জিং। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ দূরদর্শী উদ্যোগ নিতে হবে এখনই। মনে রাখতে হবে, অতি আধুনিক যন্ত্র ও প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে মানুষ যখন মানুষের বিকল্প উদ্ভাবন করে; তখন একঘেয়ে, অলস, নির্বোধ মানুষ কর্মক্ষেত্র থেকে ছিটকে পড়ে কর্মহীন হয়ে যায়। এ সময়ই স্বল্পপুঁজির দেশগুলোর জনগোষ্ঠীর বিশাল অংশ চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়ে যায়। চতুর্থ শিল্প বিপ্লব প্রযুক্তিগতভাবে দক্ষ জনশক্তিসম্পন্ন দেশের জন্য বিশাল সম্ভাবনা। তাই দক্ষতার মাধ্যমে উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার অপার সুযোগ।

চতুর্থ শিল্প বিপ্লব উপযোগী শিক্ষার মাধ্যমে জনগণের কী কী দক্ষতা অর্জন করা প্রয়োজন, তা নিয়ে আন্তর্জাতিক ফোরামে নানা আলোচনা চলমান রয়েছে। ২০১৬ সালে বিশ্ব অর্থনীতি ফোরামের ৪৬তম সভায় বিশ্বের অন্যতম বিচক্ষণ ও ভিশনারি নেতা বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা চতুর্থ শিল্প বিপ্লব সম্পর্কিত তাৎপর্যপূর্ণ প্রস্তাবনা উপস্থাপন করেন। তাঁর চিন্তা-দর্শন নিয়ে আন্তর্জাতিক ফোরামে আলোচনা চলছে। বিশ্ব অর্থনীতি ফোরামের প্রধান প্রফেসর ক্লস সোয়াব তাঁর লেখা The Fourth Indrustrial Revulation গ্রন্থে প্রকাশ করেছেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চিন্তা-দর্শন। স্বাভাবিকভাবেই ধরে নিতে হবে চলমান চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আমাদের অভিভাবক তৎপর রয়েছেন। যে অভিভাবক ভিশন-৪১ দেখতে পারেন এবং রূপরেখা তৈরি করেন; সে অভিভাবক কতটা যুগোপযোগী, আধুনিক ও শক্তিশালী তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

একুশ শতকে তথ্য ও প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে যোগ্য নাগরিক তৈরিতে হিমশিম খাচ্ছে সনাতনী পদ্ধতির শিক্ষাব্যবস্থা। গতানুগতিক শিক্ষার ধারা পরিবর্তন করে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা ও সম্ভাবনার লক্ষ্য স্থির করে ২০২৩ সাল থেকে সমগ্র দেশে নতুন শিক্ষাক্রম চালু হতে যাচ্ছে। যাতে শিক্ষার্থীকে টেকসই, কার্যকর সমাধান ও সম্ভাবনাপূর্ণ জ্ঞান, দক্ষতা ও ইতিবাচক দৃষ্টি সম্পন্ন, দূরদর্শী, সংবেদনশীল, অভিযোজন-সক্ষম মানবিক এবং যোগ্য বিশ্ব-নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা যায়। সেজন্য আমাদের শিক্ষা মন্ত্রণালয় শক্তিশালী প্রস্তুতি গ্রহণ করতে যাচ্ছে। এতে দেশের শিক্ষক সমাজ একনিষ্ঠ ও নিবেদিত হয়ে কাজ করে যাবেন।

শিক্ষার্থীকে সফল মানবসম্পদে পরিণত করতে জ্ঞান অর্জনের জন্য জ্ঞানগত দক্ষতার প্রয়োজন আবার মূল্যবোধ চর্চার জন্য মনোসামাজিক আবেগীয় দক্ষতার প্রয়োজন। একই সঙ্গে ব্যবহারিক ও আবেগীয় দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য জ্ঞানার্জন এবং মূল্যবোধের চর্চা খুবই জরুরি। অতএব এসব দক্ষতার বিষয়ে শিক্ষকবৃন্দকে সর্বদাই নিরলস ভূমিকা পালন করতে হবে। শিক্ষক ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিশ্রুতিশীল হলেই শিক্ষার্থীদের সৃজনশীল চিন্তন, সমস্যা সমাধান, সিদ্ধান্ত গ্রহণ, স্ব-ব্যবস্থাপনা, সহযোগিতামূলক, যোগাযোগ, জীবিকায়ন এবং ডিজিটাল লিটারেসির মতো দক্ষতা অর্জন সহজ হবে। শিক্ষার্থীরা হয়ে উঠবে বিশ্ব নাগরিক। তবে উল্লিখিত সব দক্ষতা অর্জনে পর্যাপ্ত সংখ্যক নেতৃত্বগুণসম্পন্ন, পেশাদার, দায়িত্বশীল ও নিবেদিত শিক্ষক দরকার। কেননা শিক্ষাব্যবস্থা পরিচালনার অগ্রে থাকেন শিক্ষক। এ কারণে শিক্ষককেই আধুনিক, যুগোপযোগী শিখন-শেখানো পদ্ধতির সঙ্গে পরিচয় ঘটাতে হবে। পাশাপাশি শিক্ষকদের স্বপ্রণোদিত হয়ে দায়িত্বজ্ঞান ও সততার সঙ্গে অর্পিত কার্যাবলী তৃপ্তির সঙ্গে এগিয়ে নিতে পারার পরিবেশ সৃষ্টি, শিক্ষকের আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করাসহ শিক্ষক যেন সামাজিক দুর্বলতার প্রভাবমুক্ত থাকতে পারে, তা কর্তৃপক্ষের নিশ্চিত করা দরকার। গবেষণায় শিক্ষকদের বৃত্তির ব্যবস্থা, ক্যাডারভিত্তিক পদায়ন এবং সর্বোপরি শিক্ষা জাতীয়করণের মাধ্যমে সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষকদের আর্থিক ও সামাজিক ব্যবধানকে বিসর্জন দেওয়া অনিবার্য।

পৃথিবীর দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই, চীন, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স এবং জার্মানিতে শিক্ষকদের রাখা হয় সবচেয়ে মর্যাদার আসনে। এ ছাড়াও দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান, মালয়েশিয়ায়, রাশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, তুরস্ক, ভারত, নিউজিল্যান্ড ও সিঙ্গাপুরে শিক্ষকদের সামাজিক মর্যাদা অনেক উপরে। এসব দেশের উদাহারণ ও আর্থসামজিক কাঠামো পর্যালোচনা করে বলা যায়, যেসব সমাজে শিক্ষকের মর্যাদা বেশি; সেখানে সমৃদ্ধ শিক্ষার্থীও বেশি।

মহান আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ‘পড়, তোমার প্রতিপালকের নামে, যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন।’ আমাদের প্রাণপ্রিয় নবী মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা জ্ঞান অর্জন করো এবং জ্ঞান অর্জনের জন্য আদব-শিষ্টাচার শেখো। যার কাছ থেকে তোমরা জ্ঞান অর্জন করো তাকে সম্মান করো।’ অর্থাৎ প্রিয়নবী শিক্ষককেই সবচেয়ে মর্যাদাবান ব্যক্তি হিসেবে মনোনীত করেছেন।

কোভিড-১৯ এর সংকট স্পষ্ট করেছে, শিক্ষকরা হলেন আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার ইঞ্জিন। যাঁদের ছাড়া প্রতিটি শিক্ষার্থীকে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, ন্যায়সঙ্গত ও মানসম্পন্ন শিক্ষা প্রদান করা অসম্ভব। এ অতিমারি কেবল শিক্ষা খাতের জন্যই নয় বরং আমাদের সামগ্রিক ভঙ্গুরতা ও আন্তঃসংযুক্ততা সম্পর্কে সচেতন করেছে। এটি সত্য যে, সম্মিলিত চিন্তা ও কর্ম উদ্যোগে জলবায়ু পরিবর্তন, ক্রমবর্ধমান বৈষম্য ও দ্রুত প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের মতো চ্যালেঞ্জগুলো আমরা মোকাবিলা করতে পারি। পরিবর্তন, উন্নয়ন ও একটি সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ তৈরির জন্য আজকের এ মহান শিক্ষক দিবসে ঐক্যবদ্ধ হওয়া অনিবার্য। সফল হোক বিশ্ব শিক্ষক দিবস।

লেখক: প্রধান শিক্ষক, কালিগঞ্জ করিম উদ্দীন পাবলিক পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়, লালমনিরহাট ও সভাপতি, বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি, লালমনিরহাট জেলা শাখা।

এসইউ/জেআইএম

আরও পড়ুন