রানি এলিজাবেথ সম্পর্কিত বিস্ময়কর ৯ তথ্য
সাইফুর রহমান তুহিন
বার্ধক্যজনিত বিভিন্ন শারীরিক অসুস্থতায় ভুগে ৯৬ বছর বয়সে পরলোকগমন করেছেন ব্রিটেনের রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ। সাংবিধানিকভাবে অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডসহ মোট ১৪টি দেশের রাষ্ট্রপ্রধান ছিলেন তিনি। এই লেখায় তার দীর্ঘ ও ব্যতিক্রমী জীবনের বিশেষ ৯টি দিক তুলে ধরা হলো যা হয়তো অনেকেরই অজানা-
সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ধরে সিংহাসনে থাকা
চলতি বছরই রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ তার সিংহাসনে আরোহণের ৭০ বছর উদযাপন করেন। ব্রিটেনের ইতিহাসে এতো বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় থাকতে পারেননি আর কেউই। ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে এলিজাবেথ ছাড়িয়ে যান রানি ভিক্টোরিয়াকে যিনি সিংহাসনে ছিলেন ৬৩ বছর ৭ মাস।
২০১৬ সালে থাইল্যান্ডের রাজা ভুমিবল আদুল্যাদেজ মারা গেলে রানি এলিজাবেথ হয়ে যান সবচেয়ে লম্বা সময় ধরে সিংহাসনে থাকা শাসক। চলতি বছর এলিজাবেথ পরিণত হন সপ্তদশ শতাব্দীর ফরাসি সম্রাট চতুর্দশ লুইয়ের (৭২ বছর ১১০ দিন) পর বিশ্ব ইতিহাসে দ্বিতীয় দীর্ঘতম সময় ধরে ক্ষমতায় থাকা শাসকে।
এলিজাবেথ ও ভিক্টোরিয়াকে বাদ দিলে ব্রিটেনের ইতিহাসে আর মাত্র চারজন শাসক পেরেছেন কমপক্ষে ৫০ বছর সিংহাসনে থাকতে। এই চারজন হলেন- তৃতীয় জর্জ (৫৯ বছর), তৃতীয় হেনরি (৫৬ বছর), তৃতীয় এডওয়ার্ড (৫০ বছর) ও স্কটল্যান্ডের ষষ্ঠ জেমস (৫৮ বছর)।
স্বশিক্ষিত
আরও অনেক রাজপরিবারের সদস্যের মতো এলিজাবেথও কোনো পাবলিক স্কুলে পড়েননি ও সহপাঠীদের সঙ্গে মেশেননি। এর পরিবর্তে ছোটবোন মার্গারেটের সঙ্গে বাড়িতেই পড়াশোনা শিখেন তিনি।
বাবার পাশাপাশি ইটন কলেজের একজন সিনিয়র শিক্ষক তাকে শিক্ষাদান করেন। এর পাশাপাশি অনেক ফরাসি ও বেলজিয়ান শিক্ষকের কাছে ফ্রেঞ্চ শেখেন এলিজাবেথ। আর ধর্মীয় শিক্ষা লাভ করেন ক্যান্টারবুরির আর্চবিশপের কাছে।
ভালো অনুকরণকারী
এলিজাবেথ প্রায়ই ইঙ্গিত দিতেন যে, তিনি প্রচলিত রীতিনীতি মেনে চলার বিষয়ে খুবই কঠিন। অনেকেই তাকে ‘তাসের মুখ’ হিসেবে আখ্যায়িত করতেন। তবে যারা তাকে জানতেন তারা বর্ণনা করেছেন, রানির ছিলো দুষ্টুমিভরা রসবোধ ও অনুকরণ করার ক্ষমতার। যা তিনি কাজে লাগাতে পারতেন কোনো প্রাইভেট কোম্পানির জন্য।
ক্যান্টারবুরির সাবেক আর্চবিশপ রোয়ান উইলিয়ামস বলেছেন, ‘নিরিবিলি পরিবেশে রানি হতে পারতেন খুবই মজার মানুষ তবে। এই বিষয়কে সবাই সেভাবে মূল্যায়ন করেনি।
রানির নিজস্ব ধর্মযাজক বিশপ মাইকেল ম্যান একবার বলেছিলেন, ‘রানি যেভাবে কনকর্ড বিমান অবতরণের বিষয়টি নকল করে দেখাতে পারেন তা হয়তো আপনি দেখলে মুগ্ধ হয়ে যেতেন।’
নর্দার্ন আইরিশ ধর্মযাজক ও রাজনীতিক ইয়ান পেইসলিও এলিজাবেথের অনুকরণ প্রতিভার দারুণ প্রশংসা করেছেন।
রাজকীয় করদাতা
হতে পারেন রানি, কিন্তু তিনিও একজন করদাতা ছিলেন সেই ১৯৯২ সাল থেকেই। ১৯৯২ সালে যখন রানির সপ্তাহান্তের আবাস উইন্ডসর ক্যাসল আগুনে পুড়ে গিয়েছিলো তখন দেশের জনগণ এটির মেরামতের জন্য মিলিয়ন মিলিয়ন পাউন্ড ব্যয় করার বিপক্ষে প্রতিবাদ জানায়।
তবে রানি স্বেচ্ছায় তার নিজের আয় থেকে কর প্রদান করতে রাজি হন। রানি বলেন, তিনি পুনঃনির্মাণ ব্যয়ের ৭০ শতাংশ বহন করবেন। এছাড়া তিনি নিজের আবাসস্থল বাকিংহাম প্যালেস দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত করে দেন যাতে সেখানকার প্রবেশ ফি দিয়ে বাড়তি তহবিলের ব্যবস্থা করা যায়।
ছোট্ট লিলিবেট
নিজের মা, দাদি ও দাদির মা’র সম্মানে রানি এলিজাবেথের অভিষেক হয় ‘এলিজাবেথ আলেকসান্দ্রা মেরি উইন্ডসর অব ইয়র্ক’ হিসেবে। তবে শিশুকালে পরিবারের কাছে তার আদুরে নাম ছিলো ‘লিলিবেট’।
কারণ তিনি এলিজাবেথ শব্দটি ঠিকভাবে উচ্চারণ করতে পারতেন না। দাদি কুইন মেরির কাছে পাঠানো এক চিঠিতে অল্পবয়সী রাজকন্যা লিখেছিলেন, ‘দাদি, ছোট্ট জার্সিটার জন্য তোমাকে অনেক ধন্যবাদ। স্যান্ডরিংহামে তোমার সঙ্গে থাকতে খুব ভালো লেগেছিল। গতকাল সকালে আমার সামনের পাটির একটি দাঁত পড়ে গেছে। লিলিবেটের কাছ থেকে ভালোবাসা।’
এই ডাকনামটি আরও ব্যাপকভাবে পরিচিতি পায় যখন ২০২১ সালে ডাচেস অব সাসেক্স প্রিন্স হ্যারি ও মেগান মেরকেল তাদের মেয়ের নাম রাখেন লিলিবেট ডায়ানা।
একটি অবিচল ভালোবাসা
রানি এলিজাবেথ ও প্রিন্স ফিলিপের ও সুখময় দাম্পত্য জীবন ৭০ বছরের আর এই ভালোবাসার ফসল হিসেবে তারা তাদের জীবনে পেয়েছেন তিন সন্তান চার্লস, অ্যান ও অ্যান্ড্রুকে। নিজেদের ৫০তম বিবাহ বার্ষিকীতে রানি বলেছিলেন, ‘সে (প্রিন্স ফিলিপ) ছিল আমার সবচেয়ে বড় শক্তি।’
গল্পের শুরু হয়েছিল ১৯৩৯ সালে, যখন ১৮ বছর বয়সী হ্যান্ডসাম নেভাল ক্যাডেট ফিলিপ মুগ্ধ হয়েছিলেন ১৩ বছরের কিশোরী এলিজাবেথকে দেখে। অনেক বছর পরে কোনো এক ক্রিসমাসে (বড়দিন) ফিলিপকে উইন্ডসর ক্যাসেলে আমন্ত্রণ জানানো হয় রাজপরিবারের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য।
এরপর খুব সতর্কতার সঙ্গে অনুসন্ধান করা হয়, ফিলিপ এলিজাবেথের জন্য যোগ্য বর হবেন কি না। ১৯৪৭ সালে ওয়েস্টমিনিস্টার অ্যাবেতে বিয়ে হয় এই যুগলের। তাদের ছেলে অ্যান্ড্রু জানিয়েছেন, ২০২১ সালে প্রিন্স ফিলিপের মৃত্যুর পর রানি এলিজাবেথের জীবনে বিশাল শূন্যতা নেমেআসে।
অনেকগুলো জন্মদিন
১৯২৬ সালের ২১ এপ্রিল জন্মগ্রহণ করেন রানি এলিজাবেথ। তবে তার জন্মদিন নিয়ে দেশের নাগরিকদের মধ্যে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ছিল যে, রানির জন্মদিন তারা কখন উদযাপন করবে? অফিসিয়াল জন্মদিনটা কিন্তু বিশ্বজুড়ে তেমন কেউই জানে না।
বৃটিশ সরকার জানায়, এটি হতে পারে জুন মাসের প্রথম অথবা দ্বিতীয় অথবা তৃতীয় শনিবার। অস্ট্রেলিয়ায় রানির জন্মদিন উদযাপিত হয় জুন মাসের দ্বিতীয় সোমবার।
কানাডার ক্ষেত্রে এটি মে মাসের ২৪ তারিখ কিংবা তার আগে যেটি আবার রানি ভিক্টোরিয়ার জন্মদিন। শুধু রানি অথবা তার সবচেয়ে কাছের মানুষরাই ব্যক্তিগত অথবা পারিবারিক আয়োজনে তার সত্যিকারের জন্মদিন পালন করেছেন।
কতোগুলো কুকুর পালতেন রানি?
এটি কমবেশি সবাই জানেন, রানি এলিজাবেথ কুকুর ভালোবাসতেন। প্রয়াত প্রিন্সেস ডায়ানা প্রায়ই জোর দিয়ে বলতেন, রানির কুকুরগুলো হচ্ছে ‘মুভিং কার্পেট’ কারণ এগুলো তাকে সব জায়গায় সঙ্গ দিত। সাম্প্রতিককালে তার মালিকানায় ৩০টির মতো কুকুর ছিল। শংকর প্রজনন করা দুটি ডর্গি জাতের কুকুরও পালতেন রানি যাদের নাম ছিল- ক্যান্ডি ও ভালকান।
১৯৩৬ সালে মাত্র ১০ বছর বয়সে কুকুরের সঙ্গে তার একটি ছবি প্রকাশিত হয়। অষ্টাদশ জন্মদিনে তিনি সুসান নামের একটি কর্গি উপহার পান। ১৯৩৩ সালে এই প্রজাতিটিকে রাজপরিবারের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন এলিজাবেথের বাবা রাজা ষষ্ঠ জর্জ। যখন তিনি একটি স্থানীয় কুকুর পরিচর্যা কেন্দ্র থেকে ডুকি নামের একটি পুরুষ কর্গি নিয়ে আসেন।
১৩২৪ সালে জারি হওয়া এক ডিক্রির মাধ্যমে রানি হিসেবে এলিজাবেথ উন্মুক্ত বৃটিশ জলাশয়ের হাজার হাজার নির্বাক রাজহাঁস, স্টার্জন মাছ, তিমি ও ডলফিনের একক মালিকানা ভোগ করতেন।
একজন আকর্ষণীয় নারী
রানি এলিজাবেথ যে পপ সংগীতের বিষয়বস্তু হতে পারতেন তা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। বিখ্যাত ব্যান্ডদল দ্য বিটলস রানিকে অমরত্ব দিয়েছে তাকে নিবেদিত সংগীতের মাধ্যমে। ১৯৬৯ সালে রেকর্ড হওয়া পল ম্যাকার্টনির একটি গান ছিলো ‘অ্যাবে রোড’ অ্যালবামে।
তবে অন্যান্য গানে অবশ্য এতোটা রানিপ্রীতি ছিলো না। রাজতন্ত্রবিরোধী ‘গড সেভ দ্য কুইন’ মুক্তি পায় ১৯৭৭ সালে রানির সিলভার জুবিলির ঠিক আগে ও যদিও ব্রিটিশ টেলিভিশন এটিকে নিষিদ্ধ করে।
লেখক: ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক ও ফিচার লেখক।
জেএমএস/এমএস