সকাল-সন্ধ্যা ঘুম ভাঙে শত বছরের পুরোনো মমির!
মমির কথা শুনলেই চোখে ভেসে ওঠে মিশরের পিরামিড ও কারুকাজ করা নানা কফিনে থাকা কোনো মৃতদেহ। যারা হাজার হাজার বছর ধরে মমি হয়ে আছে কফিনের ভেতর। বিশ্বে সবচেয়ে বেশি মমির খোঁজ পাওয়া যায় মিশরে। এখন পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ের ফারাওদের মমি খুঁজে পাওয়া গেছে সেখানে। যেখান থেকে পাওয়া গেছে নানা অজানা তথ্য।
তবে শুধু মিশরেই নয় মমি করার চল ছিল ইউরোপের বিভিন্ন দেশেও। যেমন দক্ষিণ ইতালির সিসিলিতে ছিল প্রিয়জনদের মমি করে রাখার প্রথা। সিসিলির পালেরমো শহরে আছে আস্ত একটি ক্যাটাকম্ব, অর্থাৎ ভূগর্ভস্থ সমাধিক্ষেত্র। সেখানে থরে থরে সাজানো মমি। বিভিন্ন বয়সী নারী-পুরুষ, শিশুর মমি আছে এখানে। এমনকি জীবন্ত মমির বাসও এই সমাধিক্ষেত্র।
না জীবন্ত বলে সে হাঁটাচলা বা খাবার খায় না। তবে এটি কখনো চোখ বন্ধ করে ঘুমায়, আবার কখনো চোখ খুলে দেখে আশেপাশের মমিদের। এখানে আসা দর্শনার্থীদের আধ খোলা চোখে খানিকক্ষণ দেখে। তারপর আবার ঘুমিয়ে পড়ে। এটি কোনো ব্যাটারি চালিত পুতুল নয়। সত্যিকারের একটি মমি।
মমিটি একটি ২ বছরের শিশুর। শিশুটির নাম রোজালিয়া লম্বার্ডো। যদিও মৃত্যুর সময় তার বয়স ২ বছর পূর্তি হয়নি। সেজন্য তার দরকার হতো আরও একটি সপ্তাহ বেঁচে থাকার। কিন্তু ব্রঙ্কোপনিউমোনিয়া নামের মারণ নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যায় রোজালিয়া।
সময়টা তখন ১৯২০ সাল। রোজালিয়ার বাবা এর আগে স্প্যানিশ ফ্লু-তে হারিয়েছিলেন তার পুত্রকে। এর ঠিক ৩ বছর পর হারান রোজালিয়াকে। কন্যার শোকে পাগল প্রায় অবস্থা রোজালিয়ার বাবা-মায়ের। তখন সিদ্ধান্ত নেন, মেয়ে বেঁচে থাকুক আর না থাকুক তাকে সব সময় চোখের সামনে দেখতে চান।
সেসময় ইতালিতে মৃতদেহ মমি করার খুব চল। তবে তার জন্য খরচাও হয় অনেক বেশি। একজন বাবার কাছে সন্তানের চেয়ে টাকা তো বড় হতে পারে না। তাই রোজালিয়ার বাবা মারিও সিদ্ধান্ত নেন যে করেই হোক মেয়ের ছোট্ট শরীরটিকে মমি করে রাখবেন।
এখানে বাঁধে আরেক বিপত্তি। মৃতদেহ মমি করতে হলে সিসিলিতেই আসতে হবে সবাইকে। কারণ এখানেই ১৯ শতকের দিকে মমি করার জন্য বেশ কয়েকজন নামকরা বিশেষজ্ঞ ছিলেন। রোজালিয়ার মৃতদেহ মমি করার জন্য আনা হয় ইতালির সুপরিচিত ফার্মাসিস্ট ও দেহ-সংরক্ষণ বিশেষজ্ঞ অ্যালফ্রেডো সালাফিয়ার। মোটা অঙ্কের টাকার পারিশ্রমিক দিয়েই তাকে নিয়ে এসেছিলেন রোজালিয়ার বাবা।
তবে সন্তান হারানো পিতার কাছ থেকে অ্যালফ্রেডো কোনো পারিশ্রমিকই নেননি। তার সর্বোচ্চ জ্ঞান কাছে লাগিয়েছিলেন তিনি। ‘জীবন্ত করে’ তোলেন রোজালিয়ার মৃতদেহ। তার মমিকরনের কৌশলেই যেন প্রাণ ফিরে আসে রোজালিয়ার চোখে। ছোট্ট রোজালিয়া কখনো চোখের পাতা খুলছে আবার কখনো বন্ধ করছে। যা দেখে খুশি সেই সঙ্গে রাজ্যের বিস্ময় ফুটে উঠেছিল মারিওর মুখে।
তবে কীভাবে এই কাজটি করেছিলেন অ্যালফ্রেডো সালাফিয়ার। সেই রহস্য ভেদ করতে বিজ্ঞানীদের লেগেছে ৯০ বছর। যা বের করেছিলেন ইতালির জৈবিক নৃবিজ্ঞানী দারিও পিওম্বিনো মাস্কালি। মাস্কালির গবেষণায় দেখা যায় আবিষ্কার করেন, আদতে চোখের পাতা খোলা বা বন্ধ হচ্ছে না রোজালিয়ার।
মমি করার সময় ইচ্ছাকৃতভাবেই রোজালিয়ার চোখ আধবোজা করে রেখেছিলেন অ্যালফ্রেডো। তার ওপরে প্রলেপ দিয়েছিলেন ইথারে দ্রবীভূত প্যারাফিন এবং রেজিনের। যা কাজ করে অনেকটা লেন্সের মতোই। তাই একেক কোণ থেকে দেখলে মনে হবে কখনো চোখ খোলা, আবার কখনো আবার বন্ধ। আসলে এটিকে বলা হয় অপটিক্যাল ইলিউশন।
আক্ষরিক অর্থেই রোজালিয়ার মমিকে বলা হয় জীবন্ত মমি। কেউ আবার নাম দিয়েছেন ‘সিল্পিং বিউটি অফ ক্যাপুচিন ক্যাটাকম্ব’। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এই ক্যাটাকম্বের তাপমাত্রা ও আর্দ্রতায় বদল আসছে। যে কারণে পচন শুরু হয় রোজালিয়ার দেহে। এজন্য ক্যাটাকম্বের থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে রোজালিয়ার মমি। কাচের পাত্রে নাইট্রোজেন গ্যাস ভরে বন্ধ রাখা হয় তাকে। রোজালিয়া ছাড়াও ক্যাপুচিন ক্যাটাকম্বে প্রায় ৮ হাজার মৃতদেহ সংরক্ষণ করা হয়েছে। আরও আছে ১ হাজার ২৮৪টি মমি।
সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান
কেএসকে/এএসএম