বিষাক্ত নগরে প্রাণছোঁয়া হাতিরঝিল
ইট-পাথরের এই নগরীতে প্রাণ-প্রকৃতি থেকে ক্রমশই দূরত্ব বাড়ছে মানুষের। শেষ কবে প্রাণখুলে নিশ্বাস নিতে পেরেছেন, তার ইয়ত্তা নেই। জলের ঢেউয়ে মন নাচিয়েছেন কোন ক্ষণে তাও হয়তো মনে করতে পারছেন না ঠিক। আর নির্বিঘ্নে রাস্তা পাড়ি দেওয়া বোধহয় কোনো বড় ছুটি ছাড়া সম্ভবই না!
তবে চাইলেই মন মজিয়ে জলের ঢেউ দেখতে পারবেন। শিশির কিংবা বৃষ্টিভেজা ঘাসে মাড়াতে পারবেন পা। সবুজে দৃষ্টি রেখে উপভোগ করতে পারবেন সজীবতা। কোনো বাহনে বসে থাকতে হবে না ঘণ্টার পর ঘণ্টা। পাড়ি দিতে পারবেন নিমিষে। আর রাত হলে তো অন্য এক রূপের হাতছানি।
বলছি রাজধানীর হাতিরঝিলের কথা। এ যেন অপরূপ এক সংযোজন নগরে। চিরচেনা রাজধানী থেকে বিচ্ছিন্ন এক সবুজে ঘেরা জলাধার। যেখানে মানুষ মিলছে প্রকৃতির রঙে রং মিলিয়ে।
নগর পরিকল্পনাবিদ ও স্থপতি ইকবাল হাবিব। যিনি হাতিরঝিল প্রকল্পের একজন অন্যতম রূপকার। তার মতে, ‘প্রথমত, হাতিরঝিল রাজধানী ঢাকার দ্বার উন্মোচন করেছে বলে মনে করি। জনভিত্তিক এই নগরে জনবান্ধব প্রকল্প হতে পারে তার প্রমাণ এটি। শুধু কল্পনা নয়, এই নগরীকে ঢেলে সাজানো সম্ভব, তার বাস্তব রূপ জাগ্রত করেছে। দ্বিতীয়ত, ঢাকা ঐতিহ্যগতভাবে নৌ চলাচলের একটি নগরী। এই ঐতিহ্য এখনো বিলীন হয়ে যায়নি, তার প্রমাণ এটি। এই জনবহুল নগরে নতুন চিন্তার অবকাশ হতে পারে হাতিরঝিল। তৃতীয়ত, গণপরিসর ও তার উন্নয়ন ঢাকার উন্নয়ন ভাবনায় যে গুরুত্ব পাওয়া দরকার, সেই ধারণাটাও তৈরি করেছে নগরবাসীর এবং নগর পরিচালানকারীদের মধ্যে।’
২০১৩ সালে উন্মুক্ত করা হয় হাতিরঝিল। দশ বছরে যেন অচেনা হয়ে গেছে এই ঝিলপাড়। দেশীয় গাছের সমাহার নেই বটে, তবে গাছ-গাছালির কমতি নেই। বিদেশি সব দামি গাছের পসরায় ঝিলের সব দিক মনোমুগ্ধকর পরিবেশ দাঁড়িয়েছে। ঘাটতি রয়েছে ফলদ গাছের। তবে বনজ আর নানা রঙের ফুলে বছরজুড়েই ঝিলপাড়ে যেন বসে রঙের মেলা। কোনো না কোনো দিকে ফুল ফুটছেই। প্রকৃতির প্রেমে যারা মন মজিয়ে বড় হয়েছেন, তাদের কাছে ঝিলপাড় ঠিক আশ্রমের মতো। প্রশান্তির ছায়া আর আড্ডায় কেটে যায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা। এ আড্ডা ফুরায় না রাতেও।
আলভী নামে এক তরুণী মোহাম্মদপুর থেকে ঘুরতে এসেছেন বান্ধবী রতিকে নিয়ে। বলেন, ‘এই শহরে অন্য কোথাও আপনি মন খুলে আড্ডা দিতে পারবেন না। এত গাছ, এত ফুল কোথায় পাবো আর! আমরা মন চাইলেই চলে আসি। ছবি তুলি। পানির দুর্গন্ধ না থাকলে আর নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করতে পারলে সবার মন টানবে এখানে।’
বৃষ্টির রূপ নগরে ঠিক ফলে না। কিন্তু হাতিরঝিলের বৃষ্টিবেলা যেন জলকেলির মধুমেলা। মুষলধারে হোক আর গুঁড়ি গুঁড়িই হোক, বৃষ্টি এখানে উন্মাদনা ছড়াবেই। গাছের পাতা নিংড়ানো বৃষ্টির ফোঁটায় মনও নাচিয়ে তুলবে আপনার।
ঝিলের নিয়মিত ছবি তোলেন ফটোগ্রাফার মাহবুব আলম। বলছিলেন, ঝিলপাড়ের বৃষ্টি নিয়ে। ‘এ শহরে মনের মৃত্যু ঘটে ক্রমশই। দূষণ, যানজট আর অব্যবস্থাপনা যখন আপনার জীবনকে বিষময় করে তুলবে, ঠিক তখনই হাতিরঝিলে এলে আপনি প্রাণ ফিরে পাবেন। এখানকার বৃষ্টি নগরের অন্য জায়গার বৃষ্টি থেকে আলাদা। বিস্তর পানির মধ্যে বৃষ্টির ফোঁটা পড়ার দৃশ্য অন্য কোথাও খুব একটা চোখে পড়বে না। সবুজ, ছায়া, বৃষ্টি, ঢেউ সবই তো মিলছে এখানে। অন্তত নিশ্বাস নিতে পারি প্রাণ খুলে।’
জনসাধারণের চলাচলের জন্য হাতিরঝিল প্রকল্প গ্রহণ করা হয় ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে। এ প্রকল্পের মধ্য দিয়ে ঢাকার তেজগাঁও, গুলশান, বাড্ডা, রামপুরা, মৌচাক, ফার্মগেট, কারওয়ান বাজার ও মগবাজার এলাকার বাসিন্দাসহ এ পথে চলাচলকারী যাত্রীরা বিশেষ সুবিধা পাচ্ছেন।
প্রকল্পের অন্যতম লক্ষ্য বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ, জলাবদ্ধতা ও বন্যা প্রতিরোধ, ময়লা পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নয়ন, রাজধানীর যানজট নিরসন এবং শ্রীবৃদ্ধি।
নগরের উন্নয়নে বিশেষ অবদান রাখলেও এর ব্যবস্থাপনা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, ‘এখানে বেশ কিছু দুর্বলতা প্রকাশিত। প্রথমত, ঢাকা শহরের দূষিত পানি ব্যবস্থাপনা কতটা দুর্বিষহ বা হ-য-ব-র-ল হতে পারে তা এখন হাতিরঝিলে দেখতে পাবেন। দূষিত আর বৃষ্টির পানি পৃথকীকরণের মধ্য দিয়ে এ শহরের জলধারগুলো সংরক্ষণের সব সম্ভাবনা গলা টিপে হত্যা করা হয়েছে। এতকিছুর পরেও হাতিরঝিল জনস্বাস্থ্য উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারছে না শুধু দূষিত পানির কারণে।’
অব্যবস্থাপনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘প্রকল্প তৈরি নিয়ে আমাদের এখানে ব্যাপক উদ্যমী ভাব দেখা যায়। কিন্তু পরবর্তীসময়ে যে এর ব্যবস্থাপনা বা রক্ষণাবেক্ষণের প্রয়োজন, তা আর ভাবনায় গুরুত্ব পায় না। হাতিরঝিল প্রকল্পে এই দুবর্লতা ব্যাপক। ট্রাফিক ব্যবস্থা, পরিচ্ছন্নতা, নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে আপনি প্রশ্ন তুলতে পারেন। দুই পাড়ের যে চরিত্র তা সংরক্ষণেও আমরা ব্যর্থতার প্রমাণ দিয়েছি। গোটা ঝিলপাড়ে অবৈধ খাবারের দোকান বসানো হলো। এটি মূল নকশার মধ্যে ছিল না। উচ্চ আদালত দোকান সরানোর নির্দেশনা দিয়েছে। তবু রাজউক এগুলো অপসারণ করছে না।’
‘নানা ত্রুটির পরেও হাতিরঝিল আমাদের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। আমাদের সক্ষমতার পরিচয় বহন করছে। হাতিরঝিল হওয়ার আগে নগরবাসীর ধারণা ছিল না, ট্রাফিক সিগন্যাল ছাড়া একটানা ১১ কিলোমিটার রাস্তা অতিক্রম করা যায়। আপনি ১১ মিনিটে ১১ কিলোমিটার পাড়ি দিতে পারছেন। তার মানে পরিকল্পিতভাবে ট্রাফিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব। একইভাবে দেশি প্রকৌশলী, নৈসর্গিক স্থাপতি, কারিগরি ব্যবস্থার মাধ্যমে এটি বাস্তবায়ন করে নিজেদের সক্ষমতা জানান দিতে পেরেছি যে, বিদেশিদের ছাড়াও এমন প্রকল্প করা সম্ভব। এই সক্ষমতার মধ্য দিয়ে আমরা আরেকটি বিষয় জানান দিয়েছি, ওয়াসার মতো অথর্ব প্রতিষ্ঠানের ব্যর্থতা কী? হাতিরঝিলের শিক্ষা অনেক বড় ও সম্ভাবনার শিক্ষা।’ বলছিলেন ইকবাল হাবিব।
এএসএস/এএসএ/এএসএম