গ্রন্থাগার যেন স্মারকের আধার
ছুটির দিনের বিকেল। ইট-কাঠের নগরে ঘোরাঘুরির জায়গা মেলা ভার। দুপুরের কড়া রোদ যে তাপ ছড়িয়ে গেছে, তা থেকে গা শীতল করতে আইসক্রিম নিয়ে সড়কের এক পাশে চলছিল আড্ডা। এক পর্যায়ে ফরিদুল ইসলাম নির্জন বললেন, একটা গ্রন্থাগার ঘুরে আসি।
ঘুরতে বেরিয়ে গ্রন্থাগারে ঢোকার প্রস্তাবে মন তেমন একটা সায় না দিলেও পা বাড়ালাম। ভাটারার জগন্নাথ বাড়ী রোডের (বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার প্রবেশদ্বার) হাভেলি কমপ্লেক্সের দোতলায় উঠতেই চোখে পড়লো ‘বুকল্যান্ড লাইব্রেরি’। ফটকটা সাধারণ একটা অফিসের মতো। ভেতরে ঢুকতেই সালাম দিয়ে অভ্যর্থনা জানালেন ফারহানা হাসনা তুলি। তিনি এই গ্রন্থাগারের সহ-প্রতিষ্ঠাতা। এক শিশুকে পড়াচ্ছিলেন তখন। একটু সময় চেয়ে নিয়ে বসতে বললেন।
ঢুকলাম যেন মুদ্রার জগতে
গ্রন্থাগারের ডান দিকে এগোতেই চোখে পড়ে বিরল কিছু। গ্রন্থাগারের দেওয়ালজুড়ে মুদ্রা সাঁটানো। বিভিন্ন দেশের মুদ্রা, একটি দুটি কিংবা পাঁচ দশটি দেশের নয়, বিশ্বের মানচিত্রে থাকা প্রায় সব দেশেরই মুদ্রা। যুক্তরাষ্ট্র বা কানাডা, সৌদি আরব বা সিরিয়া, তুরস্ক বা রাশিয়া, মেসিডোনিয়া বা মলদোভা, লিথুনিয়া বা লাটভিয়া, বসনিয়া ও হার্জেগোভিনা বা আইসল্যান্ড। কোন দেশের মুদ্রা নেই? একেক মুদ্রার একেক রং, কোনো কোনো মুদ্রায় সে দেশের জাতির পিতা বা শীর্ষ নেতার ছবি, কোনো কোনো মুদ্রায় শোভা যাচ্ছে জাতীয় গৌরব বা ঐতিহ্যের কোনো স্থাপনার ছবি বা প্রতীক।
দেখা মিললো হাজার বছর আগের ধাতব মুদ্রা
বর্তমান বিশ্বের মুদ্রার জগৎ থেকে বাঁ দিকে এগোতেই যেন পা পড়লো প্রাচীন জগতে। হাজার বছর আগে বিভিন্ন সাম্রাজ্যে লেনদেনে প্রচলিত ধাতব মুদ্রার বিপুল সংগ্রহ।
ইতিহাস থেকে যতটুকু জানা যায়, এখন থেকে দুই হাজার বছরেরও বেশি আগে খ্রিস্টপূর্ব ৩২২ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ১৮৭ সাল পর্যন্ত ভারতবর্ষ ছিল মৌর্য সাম্রাজ্যের শাসনে। ভারতের পশ্চিমাংশ, পাকিস্তান, আফগানিস্তানসহ মধ্য এশিয়ায় প্রথম শতকের মধ্যভাগ থেকে তৃতীয় শতকের প্রথমভাগ পর্যন্ত ছিল কুশন রাজবংশের শাসন। চতুর্থ শতকের শুরুর দিক থেকে ষষ্ঠ শতকের শেষভাগ পর্যন্ত প্রাচীন ভারতে ছিল গুপ্ত সাম্রাজ্য। এভাবে বিভিন্ন সময়ে ভারতবর্ষে ছিল বিভিন্ন সাম্রাজ্য বা সুলতানাত। নেতৃত্বে ছিলেন সিকান্দার লোদী, জালাল উদ্দিন আকবর বা জাহান্দার শাহরা। এসব সাম্রাজ্য বা সুলতানাতের দুর্লভ ধাতব মুদ্রার সংগ্রহ দেখে যেন ঘোর কাটছিল না।
স্মৃতি জাগালো চিত্রা হরিণের ছবির এক টাকার নোট
এই ঘোর সেতু তৈরি করে নিয়ে গেলো শৈশবের স্মৃতিতে। পাশেই দেওয়ালে বাঁধাই করা দেশের পুরোনো সব নোট ও মুদ্রার সংগ্রহ। চিত্রা হরিণ আর জাতীয় প্রতীকের এক টাকার নোট দেখে বুকের ভেতরটা কেমন যেন করে উঠলো। শৈশবে বাবার কাছ থেকে পেলে এই এক টাকার নোট কত যত্ন করে বইয়ের ভাঁজে রাখতাম, স্কুলের অবকাশ সময়ে তা দিয়ে আচার কিনতাম।
এই সংগ্রহের দেওয়ালে দেখা গেলো দেশের প্রথম নীল-কালো রঙের এক টাকার নোটও, যেখানে শোভা পাচ্ছে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের মানচিত্র, অর্থ সচিব কে এ জামানের স্বাক্ষর। এমন ভিন্ন চারটি পুরোনো এক টাকার নোটের পাশাপাশি দেখা গেলো দোয়েল পাখির ছবি সম্বলিত দুই টাকার নোট, বঙ্গবন্ধুর ছবি সম্বলিত পাঁচ টাকার লালচে নোট, ১০ টাকার সবুজাভ কয়েক রকমের নোট। বাজার থেকে উঠে যাওয়া প্লাস্টিকের ১০ টাকার নোটেরও দেখা মিললো এই বিরল সংগ্রহের দেওয়ালে। জাতীয় স্মৃতিসৌধের ছবি সম্বলিত পঞ্চাশ টাকার নোট দেখে মনে হলো যেন কত বছর পর। দেখা মিললো একশ, পাঁচশ টাকারও ভিন্ন ভিন্ন নোট।
গ্রন্থাগারে ঢুকলে একঘেঁয়েমি পেয়ে বসতে পারে বলে যে ধারণা ছিল, তা উবে গেছে বহু আগে, এতক্ষণে মন ফুরফুরে। গ্রন্থাগারের বাঁ দিকটাতেই বইয়ের তাক। মাঝে চেয়ার-টেবিল পাতা।
আছে গ্রামোফোন-টেলেক্স, আছে হুক্কাও
পাশেই ইতিহাস-ঐতিহ্যের আরও নানান স্মারক সাজানো। এর মধ্যে আছে গ্রামোফোন (আধুনিক রেকর্ড প্লেয়ার, স্টেরিও এবং সিডির পূর্বরূপ), পিতলের হুক্কা, সুলেখা কালি, কয়লার ইস্ত্রি, চল্লিশের দশকের টাইপ রাইটার ও ক্যামেরা, ষাটের দশকের রেডিও, বিভিন্ন সময়ের ল্যান্ডফোন, পোস্ট অফিসের পাল্লা, টেলেক্স (এক বিশেষ ধরনের টেলিফোন ব্যবস্থা যার সাহায্যে সংবাদ বা বার্তা টেলিপ্রিন্টারের সাহায্যে টাইপ হয়ে প্রাপকের কাছে পৌঁছে যায়), কয়েক দশক আগের তালা-চাবিসহ নানা রকম প্রাচীন সামগ্রী।
এত সংগ্রহ, কীভাবে সম্ভব? বিস্ময়ের এই প্রশ্নের উত্তর যেন ফরিদুল ইসলাম নির্জনও দিতে পারছিলেন না। এর মধ্যেই শিষ্যকে বিদায় দিয়ে সবিনয়ে ডাক দিলেন ফারহানা হাসনা।
প্রশ্নটা তাকেও করা হলো, এত সংগ্রহ কীভাবে করলেন? চেয়ারে বসতে বসতেই বললেন, মানুষ দেশ-বিদেশে গেলে পোশাক-আশাক, প্রসাধনী-অলঙ্কার কেনার চিন্তা করে, শপিংয়ের সুযোগ খোঁজে। আমি কোথাও গেলে এসব স্মারক বা উপকরণ খুঁজতে থাকি। দীর্ঘদিনের শ্রমে আজকের এই সংগ্রহশালা।
শুরুটা যেভাবে
বই এবং স্মারকের এই সংগ্রহশালার মূল পরিচয় গ্রন্থাগার। বুকল্যান্ড লাইব্রেরি নামে এই প্রতিষ্ঠান ২০১৭ সালে শিল্প-সংস্কৃতিপ্রেমী স্বামী মাসুমুজ্জামানের সঙ্গে গড়ে তোলেন ফারহানা হাসনা। তার স্বামী ট্রাভেল অ্যান্ড ট্যুরিজমের ব্যবসা করেন। আর ফারহানা নিজে পড়ে থাকেন এই গ্রন্থাগারে।
ফারহানা হাসনার বাবা মো. আবদুর রাজ্জাক পেশায় ছিলেন সরকারি কর্মকর্তা। নেশায় ছিলেন বইপ্রেমী। খুলনার শতবর্ষী উমেশচন্দ্র লাইব্রেরির সহ-সভাপতি ছিলেন। তার বাবাও অর্থাৎ ফারহানা হাসনার দাদাও ছিলেন বইপ্রেমী। বই পড়ে সে গল্প করতেন সন্তানদের সঙ্গে। আর আবদুর রাজ্জাক এই বই-সাধনায় উৎসাহী করেন তার সন্তানদের।
ফলে তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ার সময় থেকেই পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি বিভিন্ন রকমের গল্প-সাহিত্যের বইয়ে ঝোঁকেন ফারহানা হাসনা। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর করা ফারহানা একটা সময় সিদ্ধান্ত নেন বইয়েই পড়ে থাকবেন, গড়ে তুলবেন গ্রন্থাগার। সেই ভাবনা এখন বাস্তব।
গ্রন্থাগারে ২৫ হাজার বই
ফারহানা হাসনার ১৪শ বর্গফুট আয়তনের গ্রন্থাগারে এখন ২৫ হাজারের বেশি বই আছে। আছে কবিতা, গল্প, উপন্যাস থেকে শুরু করে অনুবাদ, গবেষণা, ইতিহাস-ঐতিহ্যের বই। শিশু, কিশোর, যুব, বয়স্ক সব বয়সীর জন্য বই আছে এই গ্রন্থাগারে। আছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে রচিত বা সংকলিত বইয়ের সংগ্রহ নিয়ে ‘বঙ্গবন্ধু কর্নার’ও।
ফারহানা হাসনা বলেন, ‘বাবা বলে গেছেন, যে শিক্ষাটা পাই, সেটা যেন ছড়িয়ে দেই। তার সেই উপদেশ অনুসারেই জীবনে চলার চেষ্টা করছি। এই গ্রন্থাগার গড়ে তুলেছি।’
গ্রন্থাগারের শুরুর দিকে এখানকার বই নেওয়া এবং পড়া ফ্রি ছিল। কিন্তু এতে পড়ুয়াদের কোনো আগ্রহ না দেখে সদস্যপদ চালু করা হয়। নামমাত্র একটা অংকের অর্থ দিয়ে সদস্যপদ নিলে যে কেউ এই গ্রন্থাগার থেকে বই নিয়ে পড়তে পারবেন। সেটি ফেরত দিয়ে পরে আরেকটি নিতে পারবেন। যদিও এই পদক্ষেপেও আশাব্যঞ্জক সাড়া মিলছে না।
ফারহানা আক্ষেপ করে বলেন, ‘এখন ফেসবুক-ইনস্টাগ্রামের যুগ, এখানে-ওখানে ঘুরে, রেস্টুরেন্টে খেতে বসে দু-চারটা ছবি তুলে পোস্ট না করলে ভালো লাগে না, বই পড়ার সময় হবে কার?’
তার সঙ্গে আড্ডার ফাঁকেই ফটক লাগোয়া তথ্য কক্ষ থেকে এগিয়ে এলেন মাসুমুজ্জামান। শুভেচ্ছা বিনিময়ের ফাঁকে তিনি বলছিলেন, বই সবাই পড়বে না, যদি অল্প কয়েকজনও এখান থেকে কিছুটা শিক্ষালাভ করতে পারে, সেটাও কম কীসে?
গ্রন্থাগারেই নাচ-গান-আবৃত্তি শিক্ষা
বুকল্যান্ড লাইব্রেরি গড়ে তোলার পর মাসুমুজ্জামান-ফারহানা দম্পতি বুকল্যান্ড ইনস্টিটিউট অব আর্ট অ্যান্ড কালচার নামে একটি সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানও তৈরি করেছেন। এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে শিল্প ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। আয়োজন করা হয় ছবি আঁকা, পাঠ প্রতিযোগিতা ইত্যাদির। পাশাপাশি ‘বুকল্যান্ড জার্নাল’ নামে একটি মাসিক পত্রিকাও বের করা হয় এখান থেকে।
এই গ্রন্থাগারে শেখানো হয় গান, নাচ, ছবি আঁকা, আবৃত্তি। গিটার বাজানো, ইয়োগার পাশাপাশি রিপোর্টিং-প্রেজেন্টেশনও শেখানো হয় এখানে।
ফারহানা হাসনা তুলি বলেন, আমাদের মোটাদাগে কার্যক্রম স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সংস্কৃতিকেন্দ্রিক। গ্রন্থাগারে শিক্ষা-সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের পাশাপাশি দেশের দুর্গম অঞ্চলে কিছু নারী স্বাস্থ্য নিয়ে কিছু কাজ করি। কিশোরীদের মধ্যে স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার সচেতনতা বাড়াতে উঠোন বৈঠক করি। ব্যক্তিগত অর্থায়নে কিশোরীদের মাঝে ন্যাপকিন বিতরণও করি। গাজীপুর-জামালপুর-খুলনার বিভিন্ন এলাকায় আমরা এ ধরনের কার্যক্রম ইতোমধ্যে চালিয়েছি। সেখানে স্বাস্থ্য সচেতনতা চালিয়ে আসার পর প্রয়োজনে কেউ যেন অনলাইনে পরামর্শ চাইতে পারে, সেজন্য ঢাকার ডাক্তারের সঙ্গে যোগাযোগের সুযোগও রেখেছি আমরা। এর বাইরে মহামারিকালে কিছু ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রমও চালিয়েছি। এই কাজগুলো একেবারেই মানবিক তাড়না থেকে করেছি।
পৃষ্ঠপোষকতায় আলো ছড়াতে পারে গ্রন্থাগার
বুকল্যান্ড লাইব্রেরি একটা সময় সারাদেশে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেবে, এই স্বপ্ন নিয়ে কাজ করছেন ফারহানা-মাসুমুজ্জামান দম্পতি। তবে নিজেদের অর্থে এমন জায়গায় এই লাইব্রেরি কতদিন তারা চালাতে পারবেন সেই সংশয়ও লুকালেন না।
ফারহানা হাসনা বলেন, এখানে একজন লাইব্রেরিয়ান লাগে, একজন ক্লিনার লাগে, তাদের তো বেতন দেওয়া লাগে। সরকারিভাবে যদি কোনো সহায়তা-পৃষ্ঠপোষকতা আসে, তাহলে গ্রন্থাগারটির পথচলা সাবলীল-সহজ হয়।
সরকারি ছুটির দিন ছাড়া প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত খোলা থাকে ‘বুকল্যান্ড লাইব্রেরি’। বইয়ের খোঁজে ইতিহাসের খোঁজে ঐতিহ্যের খোঁজে এই লাইব্রেরিতে যাওয়া যাবে ঢাকার যে কোনো প্রান্ত থেকেই। এজন্য যেতে হবে প্রগতি সরণিতে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার ফটকে, সেখান থেকে তিন মিনিট হাঁটলেই হাভেলি কমপ্লেক্সের দোতলায় ‘বুকল্যান্ড লাইব্রেরি’।
এইচএ/এএসএ/এএসএম