ভিডিও EN
  1. Home/
  2. ফিচার

দেশে দেশে চকলেটের ইতিহাস

ফিচার ডেস্ক | প্রকাশিত: ১২:১০ পিএম, ০৭ জুলাই ২০২২

বয়স আপনার যাই হোক না কেন, চকলেট খাওয়াতে মানা নেই। ছোট বড় সবার কাছেই চকলেট মানে বাড়তি এক ভালোলাগা। প্রিয় সঙ্গীর রাগ ভাঙাতে কিংবা নতুন কাউকে সঙ্গী করার প্রস্তাব দিতে চকলেট আপনাকে সফল করবে শতভাগ। জানেন কি? আজ বিশ্ব চকলেট দিবস।

বিশ্বের একেক দেশে একেকদিন পালিত হয় চকলেট দিবস। তবে বিশ্ব স্বীকৃত চকলেট দিবস ৭ জুলাই। ইউরোপে ১৫৫০ সাল থেকে এ দিনে চকলেট দিবস পালিত হয়ে আসছে। যুক্তরাষ্ট্রে জাতীয় চকলেট দিবস পালিত হয় ২৮ অক্টোবর। ঘানাতে কোকো সেলিব্রেটস চকলেট দিবস পালিত হয় ১৪ ফেব্রুয়ারি। তেতো মিষ্টি চকলেট দিবস ১০ জানুয়ারি, মিল্ক চকলেট দিবস ২৮ জুলাই, সাদা চকলেট দিবস ২২ সেপ্টেম্বর এবং চকলেট কভারিং দিবস ১৬ ডিসেম্বর।

এই দিনটি নিয়ে রয়েছে নানান ইতিহাস। কেউ কেউ বলেন, ১৫৫০ সালে ইউরোপে চকোলেটের প্রবর্তনকে স্মরণ করতেই দিনটি পালিত হয়। ১৬ শতকে মিষ্টি হয়ে ওঠে অনেক পরিবারের জনপ্রিয় খাবার। সে সময় বেকারস চকলেট ছিল আমেরিকার প্রথম চকলেট কোম্পানি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল কনফেকশনার্স অ্যাসোসিয়াশন চিনিযুক্ত খাবার উদযাপনের জন্য এখটি বিশেষ দিন মনোনীত করে। কিছু সূত্র মনে করেন, ২০০৯ সালে প্রথম বিশ্ব চকোলেট দিবস অনুষ্ঠিত হয়েছিল। দিনটি রয়েছে একাধিক মাহাত্ম্য রয়েছে বিস্তর।

চকলেট কিন্তু শরীরের জন্য খুবই উপকারী। ডার্ক চকলেট অ্যান্টি অক্সিডেন্ট পূর্ণ। যা রক্ত চাপ কমাতে ও কার্ডিওভাসকুলার স্বাস্থ্যের উন্নতি করে। তাই শারীরিক সুস্থতা বজায় রাখতে খেতে পারেন ডার্ক চকলেট। চকলেট খেলে ভালো থাকবে আপনার হার্ট এবং ব্রেইনও।

jagonews24

চকলেট তৈরির প্রধান কাঁচামাল কোকোর বীজ। এই কোকো গাছটিকে গ্রীক ভাষায় বলা হয় থিওব্রোমা ক্যাকাও। এর অর্থ হল দেবতাদের জন্য খাদ্য। ৫০০ গ্রাম চকোলেট তৈরিতে ৪০০ পর্যন্ত কোকো বীজ প্রয়োজন হয়। জানেন কি? চকলেটের এই বিশাল চাহিদা পূরণ করতে বেশিরভাগ কোকো উৎপাদন হয় আইভরি ও ঘানাতে। শুধু ইউরোপ-আমেরিকাতেই বছরে প্রায় ৩ মিলিয়ন টনেরও বেশি কোকোয়া বীজ কেনা-বেচা হয়ে থাকে।

বিজ্ঞানীদের মতে, ৪০০০ বছর আগেই মেক্সিকোতে প্রথম কাকো গাছের সন্ধান পাওয়া যায়। তবে অ্যাজটেকরা প্রথম চকলেট পানীয় হিসেবে খাওয়া শুরু করেন ২৫০০ বছর আগে থেকে। সে হিসেবে চকলেটের ইতিহাস আড়াই হাজার বছর পুরোনো। ‘চকলেটের সত্য ইতিহাস’ (থেমস এবং হাডসন, ২০১৩) বইয়ের লেখক ইতিহাসবিদ সোফি এবং মাইকেল কো এর মতে, চকলেট শব্দটি এসেছে অ্যাজটেক শব্দ জোকোয়াটল থেকে।

তারা তখনকার সময় কোকোয়া বীজ থেকে এক ধরণের তেঁতো স্বাদযুক্ত পানীয় তৈরি করতেন। স্পেনীয় বিজয়ীদের মধ্য আমেরিকায় আসার আগ পর্যন্ত এভাবেই চকলেট খাওয়ার প্রচলন ছিল। ১১০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে মধ্য আমেরিকায় কোকো গাছ ও এই গাছের বীজ অত্যন্ত মূল্যবান বস্তু হিসেবে বিবেচিত হয়।

সে সময় তারা কোকো গাছের বীজ থেকে গাজন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ঘ্রাণ উৎপন্ন করতো। তারপর তা শুকিয়ে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে রোস্টের মতো তৈরি করে তাপ দিয়ে বীজের খোসা ছাড়িয়ে ফেলে দিতো। খোসা ছড়ানোর পর যা অবশিষ্ট থাকতো তাকে বলা হতো নিব। আর এই নিবের সঙ্গেই বিভিন্ন মসলার সংমিশ্রণে তৈরি করা হত চকলেট।

jagonews24

তবে আমেরিকান-ইন্ডিয়ান স্মিথসোনিয়ান জাদুঘরের সাংস্কৃতিক আর্টস কিউরেটর, হেইস ল্যাভিসের মতে, ১৫০০ খৃষ্টপূর্বাব্দে গড়ে ওঠা প্রাচীন ওলমেক সভ্যতায় চকলেটকে চায়ের সঙ্গে একটি উত্তেজক যৌগ হিসেবে ব্যবহার করা হতো।

মনে করা হয় যে, ওলমেকসরা একটি আনুষ্ঠানের পানীয় তৈরি করতে কোকো বিন ব্যবহার করতো। যেহেতু তাদের কোনো লিখিত ইতিহাস পাওয়া যায়নি, তাই তারা তাদের তালিকায় কোকো কীভাবে ব্যবহার হতো, বা আদৌ ব্যবহার হতো কি না সে বিষয়ে ধোঁয়াশা থেকেই যায়। অনেক ঐতিহাসিক নিশ্চিতভাবে বলেছেন ওলমেকসরা কোকো বিনস ব্যবহার করতো এবং সেখান থেকেই পরবর্তীতে কোকোকে চকলেট হিসেবে ব্যবহার করা শুরু হয়েছে।

যদি ওলমেকসদের কোকো বিনস ব্যবহারের ইতিহাস সত্যি হয়। তাহলে ধরে নেওয়া যায়, তারা তাদের কোকো সম্পর্কিত জ্ঞান মধ্য আমেরিকায় ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিল, যার থেকে পরবর্তীতে মায়ানরা তাদের নিজেদের সংস্কৃতিতে কোকো চকলেট হিসেবে ব্যবহার শুরু করে। মায়ানরা কোকো বিনস শুধু খাবার হিসেবেই ব্যবহার করতো না, তারা এটিকে রীতিমতো শ্রদ্ধা করতো। মায়ানদের লিখিত ইতিহাস থেকে জানা যায়, বিভিন্ন অনুষ্ঠান উদযাপনে এবং গুরুত্বপূর্ণ লেনদেন চূড়ান্ত করতে চকলেটকে পানীয় হিসেবে ব্যবহার করতো।

মায়ান সংস্কৃতিতে চকোলেটের এরকম গুরুত্ব থাকা সত্ত্বেও, এটি শুধু মাত্র ধনী ও অভিজাত শ্রেণীর জন্য সংরক্ষিত ছিল না। প্রায় সব ধরনেরমানুষের জন্য এটি সহজলভ্য ছিল। মায়ানদের অনেক পরিবারে প্রতিটি খাবারের সাথে চকোলেটের ব্যাবহার ছিল বাধ্যতামুলক। মায়ান চকোলেট অনেক ঘন এবং সাদা হতো এবং প্রায়শই মরিচ, মধু বা জলের সাথে মিলিয়ে তারা এটাকে পানীয় হিসেবে ব্যাবহার করতো।

jagonews24

অ্যাজটেকস সভ্যতায় চকলেটের ব্যবহার অনেক প্রশংসিত স্তরে পৌঁছেছিল। অ্যাজটেক জনগণ বিশ্বাস করত, কোকো বিনস দেবতাদের পক্ষ থেকে পাওয়া এক পরম উপহার। মায়ানদের মতো তারাও অলঙ্কৃত পাত্রে গরম বা ঠান্ডা, মসলাদার চকলেট পানীয় হিসেবে গ্রহণ করতো। ক্যাফেইনের গন্ধ তাদের কাছে বেশ উপভোগ্য ছিল, তবে তারা খাদ্য এবং অন্যান্য পণ্য কিনতে মুদ্রা হিসাবে ক্যাকো বিনস ব্যবহার করত।

অ্যাজটেক সংস্কৃতিতে কোকো বিনস সোনার চেয়ে মূল্যবান বলে মনে করা হত। অ্যাজটেক চকলেট বেশিরভাগ ক্ষেত্রে একটি উচ্চ-শ্রেণির মানুষের ব্যবহারের জিনিস ছিল। যদিও নিম্নবিত্তরা মাঝে মধ্যে বিবাহ বা অন্যান্য অনুষ্ঠানগুলোতে এটি উপভোগ করত। অ্যাজটেক শাসক দ্বিতীয় মন্টেজুমা ছিলেন কোকোর অনেক বড় ভক্ত। এটি ছিল তার কাছে অনেকটা মাদকের মতোই। তিনি নিজের শক্তি বৃদ্ধি এবং একটি অ্যাফ্রোডিসিয়াক হিসেবে প্রতিদিন প্রচুর পরিমাণে চকলেট পান করতেন। এমনকি তিনি কোকো বিনস তার সামরিক বাহিনীর জন্য সংরক্ষণও করে রাখতেন।

তবে চকলেট কখন, কীভাবে ইউরোপে পৌঁছেছিল সে সম্পর্কে নানান বিতর্ক আছে। যদিও এটি প্রথমে স্পেনে পৌঁছেছিল বলেই ধারণা করা হয়। একটি প্রচলিত গল্প অনুযায়ী, ক্রিস্টোফার কলম্বাস আমেরিকা ভ্রমণের সময় একটি বাণিজ্য জাহাজকে আটকে দেওয়ার পরে, সেখানে কোকো বিনস আবিষ্কার করেছিলেন এবং তিনি কৌতুহুল বশত, শিমগুলো তার সঙ্গে স্পেনে ফিরিয়ে আনেন ১৫০২ সালে।

আরেকটি প্রচলিত গল্পে বলা হয়েছে স্প্যানিশ বিজয়ী হার্নান কর্টেস, অ্যাজটেক সম্রাট মন্টেজুমার কাছ থেকে চকলেটের সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলেন। স্পেন ফিরে আসার পরে, কোকো বিনস এর জ্ঞান গোপন রাখেন। আরেকটি গল্পে দাবি করা হয়, ১৫৪৪ সালে গুয়াতেমালার এক মায়ান, স্পেনের রাজা দ্বিতীয় ফিলিপের সামনে কোকো বিন উপস্থাপন করেছিলেন।সে থেকে স্পেনের মানুষ কোকো বিনসের সঙ্গে পরিচিত হয়।

jagonews24

এসব গল্পের কোনটি থেকেই স্পেন চকলেট কীভাবে পেল তা স্পষ্ট নয়। স্পেনীয়রা প্রথম থেকেই এটি খুবই পছন্দ করা শুরু করে এবং ১৫৮৫ সালে স্পেন চকলেট আমদানি করতে শুরু করে। সেই সময় ইতালি এবং ফ্রান্সের মতো অন্যান্য ইউরোপীয় দেশ মধ্য আমেরিকার কিছু অংশ দখল করেছিল স্পেন। একচেটিয়া ব্যবসা করেছিল স্পেন। ইউরোপীয় অঞ্চলে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করে চকলেট।

খুব দ্রুতই চকলেট ম্যানিয়া ইউরোপজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। চকলেটের উচ্চ চাহিদা থাকার ফলে, সেখানে কোকো বাগান তৈরি করা হয় এবং এসব বাগানে হাজার হাজার দাস কাজ করতো। ১৬৪১ সালে একটি স্পেনীয় জাহাজে কোকো বিনস প্রথম ফ্লোরিডায় পৌঁছায়। ধারণা করা হয়, বোস্টনে ১৬৮২ সালে প্রথম আমেরিকান চকলেট হাউজ খোলা হয়েছিল। ১৭৭৩ সালের মধ্যে কোকো শুটি আমেরিকান উপনিবেশের একটি বড় আমদানি পণ্য হিসেবে পরিচিতি লাভ করে এবং সব শ্রেণির লোকেরা চকলেট উপভোগ করা শুরু করেছিল।

আমেরিকান রেভুলশনারি যুদ্ধের সময়, চকলেট সামরিক বাহিনীকে রেশন হিসেবে সরবরাহ করা হত। কখনো কখনো অর্থের পরিবর্তে সৈন্যদের কোকো বিনস প্রদান করা হত।

সূত্র: লাইভ সায়েন্স, স্মিথসোনিয়ান

কেএসকে/এএসএম

আরও পড়ুন