একবছর পর আব্বাকে ডেকেছিলাম
সাকি সোহাগ
জন্ম দিলে হয় জন্মদাতা, বাবা একটি দায়িত্বের নাম। আব্বু, বাবা, ড্যাড যে যাই বলুক না কেন! আমি ‘আব্বা’ ডেকে সুখ পাই। আমার ছোট্ট জীবনে যদি কোনো ছোট সাফল্যও থেকে থাকে, তার পেছনে আব্বার ভূমিকা আছে। হয়তো সেটি ভিন্নভাবে। আমি ঢাকায় পোশাক কারখানায় চাকরি করতাম। একবার কী একটা কারণে চাকরি ছেড়ে বাড়িতে এসেছি। আসার পর আব্বা বেশ ক্ষ্যাপা। মূল কারণ দরিদ্রতা।
অভাবের সংসার, তার ওপর একটি জোয়ান ছেলে বাপের কাঁধে বসে খাচ্ছে। একপর্যায়ে আব্বা বেশ রেগে গেলেন, অনেক বকাঝকা করলেন। আমি রাগ করে চলে আসি। সারাদিন এদিক-সেদিক করে রাতে নিরুপায় হয়ে ঘরে ফিরতে হয়। কারণ থাকার কোনো জায়গা ছিল না। যা হোক, না খেয়েই শুয়ে পড়তাম। মা দরজায় এসে ডাকতেন। হয়তো উঠে মাথা নিচু করে খেয়ে নিতে হতো। কারণ ছোটবেলা থেকে খুব বাজে একটা অভ্যাস জমিয়ে রেখেছিলাম, ক্ষুধা সহ্য করতে না পারা।
সকালে উঠে আবার বের হতাম। বের হওয়ার মূল কারণ কর্ম খোঁজা। আব্বার ওপর খুব ক্ষোভ ছিল। একটি কাজের ব্যবস্থা করবো, যেভাবেই হোক। প্রায় এক সপ্তাহ নানা কাজ করে কিছু টাকা জমালাম। এর মধ্যেই হঠাৎ এক বড় ভাই একটি চাকরির ব্যবস্থা করে দেন। বেশ ভালো একটি চাকরি। যা আমার সাথে বেশ মানানসই। আসলে স্রষ্টা কাউকেই ঠেকিয়ে রাখেন না। কোনো না কোনোভাবে ব্যবস্থা করে দেন।
চলে যাই কর্মস্থলে। চলতে থাকে নিয়মিত। শুক্রবার বাড়ি থাকি। আব্বার সামনে দিয়ে চলাফেরা করি, খাই, গোসল করি, ঘুমাই, কিন্তু আব্বার সাথে কোনো কথা বলি না। রাগে, না লজ্জায় ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না। এরকম বেশ কিছুদিন যেতেই আমি লজ্জা পেতে শুরু করলাম। আব্বাকে না ডেকে ডেকে আর ডাকতে পারি না। লজ্জা লাগে।
প্রায় একবছর আব্বাকে ডাকিনি। তার সামনে কখনো দাঁড়াইনি। অনেক সময় লক্ষ্য করেছি, আব্বা হয়তো বলছেন, ‘যা গোসল কর। কোথায় থাকিস ছুটির দিনটা? শুয়ে তো একটু রেস্ট নিতেও পারিস?’ আমি কোনো কথা বলতে পারিনি। ইচ্ছে ছিল আব্বাকে ডাক দেব। কিন্তু বেশ লজ্জা পাচ্ছিলাম। একসময় আব্বা-মা বিষয়টি খেয়াল করেন। এর-ওর মাধ্যমে আমাকে বলতে থাকেন যে, আমি আব্বাকে ডাকি না কেন? আমার প্রচুর লজ্জা করতো।
একবছর পর আব্বাকে ডেকেছিলাম। সে রাতে নাকি আব্বা প্রচুর কান্না করেছিলেন, মা বলেছেন। আসলে দরিদ্রতার কারণে আব্বার সাথে তেমন মিশতে পারিনি। অভাবের কারণে আব্বার সামনে কখনো মন খুলে হাসিনি। জেনে অবাক হবেন, আমার চব্বিশ বছর বয়সের জীবনে আব্বার সাথে ২০২২ সালে এসে একটি ছবি তুলেছি। আব্বার সাথে এটিই আমার প্রথম ছবি।
একবছর আব্বাকে ডাকিনি। এই একবছর আর কখনো ফিরে আসবে না। বাবা-মা যে কী? তা টের পেয়েছি নিজের বিপদে। সন্তানের জন্য পৃথিবীর প্রতিটি বাবাই হয়তো এমন করেন। বাবারা কখনো খারাপ হন না। পৃথিবীর প্রতিটি বাবাই বীরপুরুষ। আব্বাও তার ব্যতিক্রম নন।
আমি জানি, লেখাটি হয়তো আপনার চোখে পড়বে না। কিন্তু আজ এ লেখার মাধ্যমে শুধু একটি কথা বলতে চাই, আপনার আর মায়ের পা দুটো যেন আমার শ্রদ্ধার জায়গা হয়। ভালোবাসি আব্বা আপনাকে। ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা পৃথিবীর সব বাবাকে।
লেখক: কবি ও কথাশিল্পী।
এসইউ/জেআইএম