পদ্মা সেতু বাংলাদেশের অগ্রগতির নিদর্শন
ঔপন্যাসিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত জনপ্রিয় একটি উপন্যাস ‘পদ্মানদীর মাঝি’। পদ্মানদীর মাঝি উপন্যাসের পটভূমি বাংলাদেশের বিক্রমপুর-ফরিদপুর অঞ্চল। এ উপন্যাসে পদ্মার তীর সংলগ্ন কেতুপুর ও পার্শ্ববর্তী গ্রামের পদ্মার মাঝি ও জেলেদের বিশ্বস্ত জীবনালেখ্য চিত্রিত হয়েছে। পদ্মা নদীর ভাঙন প্রবণতা ও প্রলয়ংকরী স্বভাবের কারণে একে বলা হয় ‘কীর্তিনাশা’ বা ‘রাক্ষুসী পদ্মা’। এ নদীর তীরের নির্দিষ্ট কোনো সীমারেখা নেই। শহর থেকে দূরে এ নদী এলাকার কয়েকটি গ্রামের দীন-দরিদ্র জেলে ও মাঝিদের জীবনচিত্র উপন্যাসে অঙ্কিত হয়েছে। জেলেপাড়ার মাঝি ও জেলেদের জীবনের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, অভাব-অভিযোগ যা কি না প্রকৃতিগতভাবে সেই জীবনধারায় অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ; তা উপন্যাসে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বিশ্বস্ততার সাথে ফুটিয়ে তুলেছেন।
পদ্মানদীর মাঝি উপন্যাস আমরা অনেকেই পড়েছি এবং এ উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত চলচ্চিত্রও আমরা দেখেছি। সে সব ঘটনাপ্রবাহ যেমন আমাদের আকৃষ্ট করেছে, একইভাবে আমাদের আকৃষ্ট করছে পদ্মা নদীর ওপর নির্মিত পদ্মা সেতু। সব ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নের ঘটনাপ্রবাহ একটি উপন্যাসের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। পদ্মা সেতুর কারণে দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের ভাগ্য খুলে যাবে। সেতুকে ঘিরেই মানুষের জীবনযাত্রার মানও বদলে যাবে। সেখানে বিশ্বমানের অলিম্পিক ভিলেজ, বেনারসি তাঁতপল্লি, রাজউকের উদ্যোগে আইকন টাওয়ার, সেতুর উভয় পাড়ে অর্থনৈতিক অঞ্চল, হাইটেক পার্ক ও প্রাইভেট শিল্পনগরী গড়ে উঠবে। দেশের মধ্যে একমাত্র ন্যাশনাল জুডিশিয়াল একাডেমিসহ বড় বড় প্রকল্প নির্মিত হচ্ছে। বিনিয়োগ বাড়বে এবং বাড়বে কর্মসংস্থান। ফলে পদ্মানদীর মাঝি উপন্যাসের চরিত্রদের কষ্ট লাঘব হবে। এ সব কিছু যার কল্যাণে সম্ভব হচ্ছে, তিনি বঙ্গবন্ধুকন্যা বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা।
বিশ্ব নেতৃত্বে শেখ হাসিনা এখন একটি অনুকরণীয় নাম। ১৭ কোটি মানুষের এই দেশে দুর্যোগ-দুর্বিপাক যেখানে নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার, সেখানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের মানুষকে নতুন দিনের সূর্যালোকে নিয়ে আসতে নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হওয়ার পর পদ্মায় সেতু নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সেতু নির্মাণের জন্য প্রাক-সম্ভাব্যতা যাচাই শুরু হয় ১৯৯৮ সালে। ২০০১ সাল থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত জাপানি অর্থ সহায়ক সংস্থা (জাইকা) সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ করে। ওই সময়েই ২০০১ সালের ৪ জুলাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদ্মা নদীর ওপর সেতু নির্মাণের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। যার মধ্য দিয়ে সেতু নির্মাণের বীজ বপন করা হয়।
নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে, সব দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে, দুর্নীতি-অনিয়মের অভিযোগকে পেছনে ফেলে ২০১৪ সালের ১২ ডিসেম্বর যে স্বপ্নের বীজ বোনা হয়েছিল পদ্মার পাড়ে; সেই স্বপ্ন এখন একেবারে তীরে ভেড়ার অপেক্ষায়। আর মাত্র কয়েকটা দিন অপেক্ষা। তার পরই জুনের ২৫ তারিখ স্বপ্ন উড়বে পদ্মার এপার-ওপার। উল্লাস আর উচ্ছ্বাসে মেতে উঠবে গোটা জাতি। দূরত্ব কমে যাবে দেশের এক অঞ্চলের সঙ্গে অন্য অঞ্চলের। অর্থনীতির চাকাও ঘুরবে দ্রুত বেগে। অর্থনীতির ভীত শক্তিশালী করতে ভূমিকা রাখবে দেশের দুই ভাগকে এক করা পদ্মা সেতু। বাড়বে জীবনযাত্রার মান। পদ্মা সেতু নতুন বার্তা পৌঁছে দেবে দেশ এবং দেশের বাইরে।
অর্থনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতার জন্য পদ্মা সেতু বাংলাদেশের গর্ব। বিশ্বব্যাংক এবং তার সঙ্গে আরও কয়েকটি দাতা গোষ্ঠী যখন পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন করল না; তখন এ দেশের সাহসী রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা সুচিন্তিতভাবে দেশের নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ করেন। এটি ছিল তার নেতৃত্বের দৃঢ়তা। একই সঙ্গে তিনি পদ্মা সেতুতে রেল ব্যবস্থাপনাও যুক্ত করেন, যা আরও একটি মাইলফলক বলা যায়। পদ্মা বহুমুখী সেতু শুধু দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের নয়, পুরো বাংলাদেশের অর্থনীতিই বদলে দেবে। আরও বিশদভাবে বলতে গেলে, এই সেতু দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার যোগাযোগ, বাণিজ্য, পর্যটনসহ অনেক ক্ষেত্রেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। সব মিলিয়ে এই সেতু দেশের মানুষের স্বপ্নের সেতু, যা বাস্তবায়ন হতে যাচ্ছে। এ ছাড়া এই সেতুটি ভবিষ্যতে ট্রান্স-এশীয় রেলপথের অংশ হবে। তখন যাত্রীবাহী ট্রেন যত চলবে, তার চেয়ে অনেক অনেক বেশি চলবে মালবোঝাই ট্রেন। ডাবল কন্টেইনার নিয়ে ছুটে চলবে ট্রেন। ঢাকা ও চট্টগ্রামের সঙ্গে যুক্ত হবে মোংলা ও পায়রা বন্দর। অর্থনীতিতে যুক্ত হবে নতুন সোনালি স্বপ্ন এবং দেশের প্রবৃদ্ধিতে এ সেতু ব্যাপক ভূমিকা পালন করবে।
পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের প্রথম কোনো সমন্বিত যোগাযোগব্যবস্থা গড়ে উঠবে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল এমনিতেই কৃষিতে উন্নত। এই সেতু হয়ে গেলে তাদের কৃষিপণ্য খুব সহজেই ঢাকায় চলে আসবে। মোংলা ও পায়রা বন্দর এবং বেনাপোল স্থলবন্দরের সঙ্গে রাজধানী এবং বন্দরনগর চট্টগ্রামের সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হবে। পুরো দেশের অর্থনীতিতে এর প্রভাব পড়বে। কোনো বিনিয়োগের ১২ শতাংশ রেট অব রিটার্ন হলে সেটি আদর্শ বিবেচনা করা হয়। পদ্মা সেতু নির্মাণের ফলে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে ট্রান্স-এশিয়ান হাইওয়ে (এন-৮) ও ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ের সঙ্গে যুক্ত হবে। ভারত, ভুটান ও নেপালের সঙ্গে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক সংযোগ স্থাপিত হবে। পর্যটনশিল্পের প্রসার ঘটবে এবং দক্ষিণ বাংলার কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকত, সুন্দরবন, ষাট গম্বুজ মসজিদ, টুঙ্গীপাড়ার বঙ্গবন্ধু মাজার, মাওয়া ও জাজিরা পাড়ের রিসোর্টসহ, নতুন পুরোনো পর্যটনকেন্দ্র দেশি-বিদেশি পর্যটকদের পদভারে মুখরিত হবে। বর্তমানে ২০১০ সালের হিসাব অনুযায়ী, পদ্মা নদী পার হয়ে যেখানে ১২ হাজার যান চলাচল করে, সেখানে সেতু খুলে দিলেই যান চলাচল দ্বিগুণ হতে পারে এবং প্রতিবছর যানবাহন ৭-৮ শতাংশ বেড়ে ২০৫০ সালে ৬৭ হাজার যানবাহন চলবে। এ ধরনের পর্যবেক্ষণ আমরা বিশ্বাসযোগ্য ধরে নিতে পারি। কারণ আমাদের অভিজ্ঞতায় দেখেছি, যমুনা বঙ্গবন্ধু সেতুর অর্থনৈতিক বিশ্লেষণে যানবাহন বৃদ্ধি, শিল্পায়ন, ব্যবসা-বাণিজ্য ও ভোগ-চাহিদা বৃদ্ধির যে প্রাক্কলন করা হয়েছিল, বাস্তবে প্রসার ঘটেছে এর চেয়ে আরও বেশি।
জুন মাসের ২৫ তারিখ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা পদ্মা সেতুর উদ্বোধন করবেন। পদ্মা সেতু উদ্বোধন হলে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অর্থনীতির চাকা ঘুরে যাবে দ্রুত বেগে। বাড়বে জীবনযাত্রার মান ও কর্মসংস্থান, এটি চিরন্তন সত্য। সেতুর এক প্রান্ত ছুঁয়ে থাকবে মুন্সীগঞ্জের মাওয়া, অন্য প্রান্ত শরীয়তপুরের জাজিরা। পদ্মার বুকে যে স্বপ্নের যাত্রা হয়েছিল, তা এখন বাস্তবে রূপ পেয়েছে বলা যায়। এ সেতু নির্মাণের সুফল হিসেবে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল অন্যতম প্রধান উৎপাদন কেন্দ্রে পরিণত হবে। দেশের অর্থনীতির জন্য বয়ে আনবে সুবাতাস। আমাদের দেশের অগ্রগতি এবং দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের স্বপ্নপূরণে পদ্মা সেতু একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে। একইসাথে পদ্মা সেতুর কেন্দ্রীয় চরিত্র হয়ে ইতিহাসে অমর হয়ে থাকবেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বঙ্গবন্ধুর যোগ্য উত্তরসুরী হিসেবে তার নেতৃত্বের দক্ষতা যে কোনো উপন্যাসের চরিত্রকে হার মানাবে। পদ্মা সেতুর ল্যাম্পপোস্টের আলো যে দ্যুতি ছড়িয়েছে, তা বাংলাদেশের অগ্রগতি ও অগ্রযাত্রার নিদর্শন বলা যায়। স্বপ্নের পদ্মা সেতু আজ স্বপ্ন নয় বরং দেশের জনগণ প্রহর গুনছে পদ্মা সেতু পাড়ি দেওয়ার।
এসইউ/জেআইএম