অটিজম কেন হয়? শনাক্তকরণের উপায়
ডা. সেলিনা সুলতানা
অটিজম মানসিক বিকাশজনিত একটি সমস্যা। যা শিশুর জন্মের প্রথম তিন বছরের মধ্যে পরিলক্ষিত হয়। অটিজম সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রতিবছর ২ এপ্রিল অটিজম সচেতনতা দিবস পালন করা হয়। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে- ‘এমন বিশ্ব গড়ি, অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ব্যক্তির প্রতিভা বিকশিত করি’।
অটিজমে আক্রান্ত শিশুর স্বাভাবিক যোগাযোগ ও সামাজিক সম্পর্ক স্থাপনে সীমাবদ্ধতা থাকে। অটিজম কেন হয় এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ এখনো পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে অটিজমের কারণ হিসেবে বিশেষ কিছু বিষয়ের উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
বংশে যদি কারো অটিজমের সমস্যা থাকে, গর্ভাবস্থায় মানসিক দুশ্চিন্তা, পর্যাপ্ত ঘুম না হওয়া, মায়ের ধূমপান ও মদ্যপানের অভ্যাস, বেশি বয়সে বাচ্চা নেওয়াও হতে পারে অটিজমের কারণ।
এমনকি গর্ভকালীন বিভিন্ন রোগের সংক্রমণ যেমন- মামস, রুবেলা, মিজেলস, কম ওজন নিয়ে জন্ম নেওয়া শিশু, গর্ভাবস্থায় বিষাক্ত বাতাস শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে নেওয়া, মা ও শিশুর অপুষ্টি ও প্রসবকালীন জটিলতাকেও অটিজমের কারণ হিসেবে ধরে নেওয়া হয়।
শিশুরা সাধারণত তার চারপাশের পরিবেশ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে। আশেপাশের সব কিছু দেখে ও শুনে তার ভাষার বিকাশ ঘটে। অটিজম আক্রান্ত শিশুটির মধ্যে এখানে সীমাবদ্ধতা থাকে।
এক্ষেত্রে শিশু ঠিকমতো সামাজিক যোগাযোগ করতে পারে না। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো একে অন্যের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনে এ ধরনের শিশুদের মধ্যে সীমাবদ্ধতা পরিলক্ষিত হয়।
কোনো শিশু কথা বলা শুরু করলেও পরে আবার ভুলে যায়, অনেক সময় শিশুটি দু’বছরের মধ্যে অর্থপূর্ণ দুটি শব্দ দিয়ে কথা বলতে পারে না, চোখের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘসময় মনোযোগ দিয়ে কথা শুনতে সমস্যা হয়, নাম ধরে ডাকলে খুব একটা সাড়া পাওয়া যায় না।
এসব কারণে শিশুটি মধ্যে মাঝেমধ্যেই মানসিক অস্থিরতায় ভোগে। তাদের মনোযোগেও ঘাটতি দেখা যায়। এ ধরনের শিশুদের মধ্যে দেখা, শোনা, গন্ধ, স্বাদ, স্পর্শ, আলোর প্রতি অতি সংবেদনশীল বা একদমই প্রতিক্রিয়াহীন অবস্থা পরিলক্ষিত হয়।
সাধারণত শিশুটি একা, নিজের মতো থাকতে পছন্দ করে। সমবয়সী শিশু বা বড়দের সঙ্গে সামাজিক আদান-প্রদানে সমস্যা তৈরি হয়। একই কাজ বারবার করা বা একই আচরণের পুনরাবৃতি দেখা যায়। নিজস্ব রুটিনের বাইরে চলাফেরা করতে সমস্যা পরিলক্ষিত হয়।
অটিজম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডার আক্রান্ত শিশুদের মধ্যে খিচুনি, হাইপার একটিভিটি, বুদ্ধির ঘাটতি, খাবার চিবিয়ে না খেতে পারা, পেটের সমস্যা, দাঁত ও চোখ সমস্যা থাকতে পারে।
২০২২ সালের অটিজম সচেতনতা দিবসের মূল প্রতিপাদ্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অটিজম আক্রান্ত শিশুদের পরীক্ষা করে সে অনুযায়ী সুনির্দিষ্ট অ্যাসেসমেন্ট, থেরাপি ও শিক্ষার উপযুক্ত পরিবেশ দিয়ে তাদের প্রতিভাগুলোকে বিকশিত করতে হবে ও সমাজে ও রাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।
ধীরে ধীরে তারাও যাতে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করতে পারে সেই পরিবেশ শুরু করার জন্যই এই প্রচেষ্টা। প্রয়োজন পরিবারের সুন্দর মনোভাব তাদের সন্তানদের প্রতি। প্রয়োজন জোরালো সচেতনতা, পজিটিভ সামাজিক অবস্থান অটিজমে আক্রান্ত শিশুর অভিভাবকদের প্রতি।
পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের সহযোগিতায় সম্পূর্ণ প্রশিক্ষণ দিতে পারলে তারাও হয়ে উঠতে পারে সমাজ ও দেশের সম্পদ। বিভিন্ন প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা জরুরি।
সমাজের মূলধারায় মিশে একজন উপার্জনক্ষম ব্যক্তি হিসেবে নিজেকে পরিণত করার চেষ্টা এখন থেকেই শুরু করতে হবে, ভবিষ্যতে পরিবার, সমাজ ও দেশের জন্য তা হবে বড় পাওয়া।
এ ধরনের কাজে বাঁধা বা প্রতিবন্ধকতা থাকলেও সবার একান্ত চেষ্টা থাকলে অবশ্যই সফলতা আসবে ও এসব শিশুরা ও দেশের সম্পদ হবে। বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবসে আমরা সবাই সচেতন হবো।
গর্ভবতী মায়ের প্রতি যত্নবান হতে হবে সবাইকে। যেসব কারণে অটিজমে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে সে সম্পর্কে সবাইকে সচেতন করা উচিত।
অটিজমে আক্রান্ত শিশুটির প্রতি সহমর্মিতা ও ভালোবাসার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। যাতে তারা তাদের সুপ্ত প্রতিভা বিকশিত করে, স্বাবলম্বী হয়ে, চাহিদা অনুযায়ী কর্মক্ষেত্রে যোগ দিতে পারে।
যত দ্রুত অটিজম শনাক্তকরণ করা যাবে ও শিশুর চাহিদা অনুযায়ী চিকিৎসার ব্যবস্থা দেওয়া যাবে, তত দ্রুতই অন্যান্য শিশুর মতো সেও সমাজের মূলধারায় প্রবেশ করতে পারবে।
সঠিক পরিচর্যা, শিক্ষা, প্রশিক্ষণই দিতে পারে তাদের পরিপূর্ণ মেধার বিকাশ, দিতে পারে একটি কর্মক্ষেত্র ও সুন্দর জীবন।
লেখক: কনসালটেন্ট, নিউরোডেভলপমেন্টাল ডিজঅর্ডার ও চাইল্ড ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড পেডিয়াট্রিক ডিপার্টমেন্ট, বেটার লাইফ হসপিটাল; প্রাক্তন অটিজম বিশেষজ্ঞ, ঢাকা কমিউনিটি মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতাল।
জেএমএস/এমএস