ভাষার অপব্যবহার বন্ধ হোক একুশের মূল চেতনা
শাদমান ইয়াসার
ভাষা একটি জাতির নিজস্ব সংস্কৃতির অন্যতম বাহন। ভাষাভাষী জাতিগোষ্ঠীর যথাযথ ব্যবহার ও চর্চার ওপর নির্ভর করে সেই ভাষার সমৃদ্ধি। ভাষার বিকৃতি ও মিশ্রণের ফলে উদ্দিষ্ট ভাষা একসময় দুর্বল হয়ে বিলুপ্তির পথে এগিয়ে যায়। ভাষার রূপান্তর, ভাষা ব্যবহারে অসচেতনতা ও অপব্যবহারের কারণে ভাষার প্রবহমানতা বিনষ্ট হয়। একসময় বিলুপ্তি ঘটে।
চর্চা ও যথাযথ ব্যবহার না হওয়া ও ভাষা-বিকৃতির মধ্য দিয়ে বিশ্বের অনেক ভাষার বিলুপ্তি ঘটেছে, এমনও উদাহরণ আছে। আর এই আশঙ্কা থেকে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভাষার দূষণ, মিশ্রণ ও বিকৃতি নিয়ে নানা আলোচনা হচ্ছে। বিশেষ করে ভাষার মাস ফেব্রুয়ারি এলে বিষয়টি সামনে আসে।
যদিও ‘বাংলা ভাষা বিপদগ্রস্ত’ এমন উদ্বেগ বেশ পুরোনো। তৎকালীন সময়ে ইংরেজি ভাষার আধিক্য নিয়ে সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বলেছিলেন, ‘বাঙালি ভদ্রলোক সন্তানরা পরস্পর কথা বলে ইংরেজিতে, চিঠিপত্র লেখে ইংরেজিতে, হয়তো সেদিন বেশি দূরে নয়, যখন লোকে দুর্গাপূজার আমন্ত্রণপত্রও ইংরেজিতে লিখবে।’
অস্বীকার করা যাবে না, ঔপনিবেশিক ভাষা হিসেবে সে সময় ইংরেজি খুব প্রতাপশালী ছিল। দেশীয় অভিজাত শ্রেণি সে প্রতাপ মেনে নিয়েছিলেন। তবে বর্তমান সময়ে সেই প্রতাপ নিশ্চয়ই অনেক কম। স্বাধীন জাতি আমরা, বাংলা আমাদের মাতৃভাষা-রাষ্ট্রীয় ভাষা। ফলে প্রশ্ন হতে পারে, এখন কেন বাংলা ভাষা দূষণ-বিকৃতির শিকার হবে?
ইংরেজ শাসন শেষ হয়ে, পাকিস্তান শাসন এসেছিলো এদেশে। পূর্ব পাকিস্তানের উপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল উর্দু ভাষা। সেটা মানতে না পেরে হয়েছিল তীব্র ভাষা আন্দোলন। শফিক, রফিক, জব্বার, বরকতদের রক্তত্যাগের বিনিময়ে বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তবে বর্তমানেও কী বাংলা ভাষার সঠিক ব্যবহার হচ্ছে? যথাযথ সম্মান পাচ্ছে বাংলা ভাষা? খেয়াল করে দেখুন।
একটু কান খোলা রাখলেই শোনা যায়, বেতার-টিভিতে বলা হচ্ছে ‘হ্যালো লিসেনার্স’, ‘হ্যালো ভিউয়ার্স’ ইত্যাদি। অভিযোগ এমন যে, গণমাধ্যমে ভাষার বিকৃতি ঘটে থাকে। এটা ঠিক যে, গণমাধ্যমের নিজস্ব ভাষারীতি থাকে। তবে তা অবশ্যই প্রমিত বাংলাকে পাশ কাটিয়ে হতে পারে না। তাছাড়া অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় আমাদের গণমাধ্যম এখন যথেষ্ট সমৃদ্ধ।
তথ্যপ্রযুক্তির উন্নয়নের ধারায় উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে গণমাধ্যমের সংখ্যা। বেতার শিল্পে নতুন ধারা যুক্ত করেছে প্রাইভেট এফএম রেডিও চ্যানেলগুলো। এসব রেডিওতে অনুষ্ঠান উপস্থাপকগণ (তাদের ভাষায় রেডিও জকি) শ্রোতাদের মনোরঞ্জনের জন্য বাংলা, ইংরেজি, হিন্দি ও বাংলাকে ইংরেজির মতো করে ‘বাংলিশ’ কায়দায় কথাবার্তা বলেন।
আর আমাদের নতুন প্রজন্ম নিজেদের স্মার্ট প্রমাণ করার জন্য এগুলো অন্ধভাবে অনুকরণ করে থাকে।এরূপ মিশ্রণকে অনেকে ‘বাংলিশ’ বলেও আখ্যা দেন। ফলে বিকৃতির প্রভাব দ্রুত ছড়াচ্ছে। মূলত তরুণ প্রজন্মের অনেকে বর্তমানে যে ভাষা ব্যবহার করছে তা আঞ্চলিকও নয়, প্রমিতও নয়।
এটাকে ‘জগাখিচুড়ি’ ভাষা বলা যেতে পারে। ভাষার আঞ্চলিকতা থাকবে সত্য কিন্তু ব্যবহারিক ক্ষেত্রে প্রমিত বা শুদ্ধরূপ বজায় থাকা সঙ্গত। একজন তরুণ যখন কোনো রিকশাওয়ালা বা দোকানদারকে ‘মাম্মা’ সম্বোধন করে তখন তা অত্যন্ত বেদনাবহ হয়ে ওঠে।
যে বাঙালি জাতি নিজস্ব ভাষা রক্ষার জন্য আত্মত্যাগ করে বিশ্বে মহান দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে, সেই জাতির নিজস্ব ভাষার এমন অপপ্রয়োগ শুধু লজ্জার নয়, এক ধরনের অপরাধও বটে। আমাদের এখন ঔপনিবেশিক শাসন নেই, তাহলে উপনিবেশিত মন কেন থাকবে! এটা ঠিক বিদেশি ভাষার আগ্রাসন সব ভাষায়ই থাকে, আমাদেরও আছে।
প্রয়োজনে বিদেশি ভাষা প্রয়োগ-ব্যবহারেও দোষের কিছু নাই। বিদেশি ভাষা শিক্ষার ব্যাপারে বিরোধও নেই। তবে তা শুদ্ধরূপে হওয়া বাঞ্ছনীয়। ২০১২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি একটি জাতীয় দৈনিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের ‘ভাষা দূষণ নদীদূষণের মতোই বিধ্বংসী’ শীর্ষক একটি লেখা প্রকাশিত হয়। এতে বলা হয়- ‘ভাষার মাসে বাংলা ভাষার সাম্প্রতিক চর্চা আমাদের ভাবায়।
শুদ্ধবাদীরা শঙ্কিত হন, বাংলা ভাষা তার রূপ হারিয়ে কোনো শংকর ভাষায় রূপ নেয়, তা ভেবে। অন্যদিকে শুদ্ধবাদীদের অবস্থানকে যারা রক্ষণশীল ও পরিবর্তনবিরোধী বলে চিহ্নিত করেন তারা বলেন, এত ভাবাভাবির কী আছে, ভাষা চলবে ভাষার মতো। এর ব্যবহার-প্রয়োগে পরিবর্তন আসবে ভাষা ব্যবহারকারীদের প্রকাশের প্রয়োজনেই। দুপক্ষের ভাবনাতেই সত্যতা আছে- বাংলা ভাষা যে সত্যি সত্যি একটি মিশ্র ভাষা হয়ে যাচ্ছে ও এর নানা স্থানচ্যুতি ঘটছে।’
তৎকালীন হাইকোর্টের বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ লেখাটি আমলে নিয়ে স্বতঃপ্রণোদিতভাবে বেশ কয়েক দফা নির্দেশনা দেন। একই সঙ্গে রেডিও ও টেলিভিশনে ‘বিকৃত উচ্চারণে’ ও ‘ভাষা ব্যঙ্গ’ করে কোনো ধরনের অনুষ্ঠান প্রচার না করতে নির্দেশ দেওয়া হয়। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন স্থানের ইংরেজি সাইনবোর্ডের জায়গায় বাংলায় লেখা সাইনবোর্ড বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। তবে এসব পদক্ষেপ খুবই নগণ্য।
দেশে বাংলা ভাষার অপপ্রয়োগ রোধে আরও অনেক জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে ভাষার অপপ্রয়োগের বিষয়ে সচেতন থাকতে হবে। ভাষার অপপ্রয়োগের বিষয়ে সবাইকে সচেতন করতে হবে। দরকার হলে আইন করে ভাষার অপপ্রয়োগ রুখে দিতে হবে। তবেই রক্তের বিনিময়ে পাওয়া বাংলা ভাষা তার হারিয়ে যাওয়া মর্যাদা ফেরত পাবে।
লেখক: আইন ও বিচার বিভাগ, বাংলাদেশ আর্মি ইউনিভার্সিটি অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি।
জেএমএস/জেআইএম