৪০ মিনিট নিশ্বাস ছাড়াই বাঁচে যে প্রাণী
পৃথিবীতে প্রায় এক ট্রিলিয়ন বা এক লাখ কোটির বেশি প্রাণীর বাস। আর এদের কেউ কেউ আছে এতটাই উদ্ভট প্রকৃতির যে কারণে জায়গা করে নিয়েছে মানুষের মনে। জঙ্গলে বাস হলেও সেটাই তাদের নিজেদের স্বর্গ। সেখানে বাস করে নিজেদের মতো করে পরিবার-পরিজন নিয়ে। তবে স্বভাবজাত দিক থেকে মানুষের সঙ্গে মিল আছে অনেক প্রাণীরই।
যেমন ধরুন গরিলা, শিম্পাঞ্জি, টামারিয়ান, ফ্ল্যামিঙ্গো ছাড়াও আরও অনেক প্রাণী। তবে স্লথের কথা বলতে গেলে এদের মানুষের সঙ্গে মিল রয়েছে অনেক জায়গায়। অনেকটা অলস প্রকৃতির প্রাণী এরা। শুয়ে-বসেই দিন কাটে এদের। কিছু না করে সারাদিন অলসভাবে কাটাতে পারলেই খুশি থাকে স্লথ নামের এই প্রাণী।
স্লথদের পূর্বপুরুষ প্রায় ছয় কোটি বছর আগে পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়। প্রাণিজগতের অন্য প্রাণীদের সঙ্গে তার তেমন কোন মিল নেই। প্রাণিজগতের বাকি প্রাণীর ব্যাপার কিন্তু আলাদা। তাদের ভাব-ভঙ্গি হচ্ছে, ‘দাঁড়াবার সময় তো নাই’।
তবে স্লথের ব্যাপারে সবচেয়ে মজার এবং অবাক করা বিষয় জানেন কি? একবারে ৪০ মিনিট নিশ্বাস না নিয়েই বাঁচতে পারে এরা। এতটাই অলস যে নিশ্বাস নেওয়ার মতো প্রয়োজনীয় কাজটুকুতেও আলসেমি। আসলে তেমন কিছু না।
মাঝে মাঝে পানিতে নেমে সময় কাটায় এরা। মাছ ধরা সহ এমনিতেই ঘুরে বেড়ানো এদের কিছু না করার মধ্যে একটি কাজ বলা যায়। ডাঙার তুলনায় পানিতে চলতে কিন্তু এই স্লথরা ওস্তাদ। পানিতে খুব তাড়াতাড়ি সাঁতার কাটতে পারে এরা। ডাঙার তুলনায় পানির তলায় তাদের গতি তিন গুণ দ্রুত হয়। তবে পানির নিচে শ্বাসকার্য চালানোর মতো শারীরিক গঠন ওদের নেই।
এজন্যই দম আটকে রাখে পানির নিচে। অন্তত ৪০ মিনিট পর্যন্ত দম বন্ধ করে থাকতে পারে স্লথ। নিশ্বাস নেয় না। শুধু তাই নয়, সেই সময় তাদের হৃদস্পন্দন কমতে কমতে প্রায় তলানিতে এসে ঠেকে। স্বাভাবিকের তুলনায় এক তৃতীয়াংশ কমে যায় স্লথের হৃদস্পন্দনের গতি।
ছয় কোটি বছর আগে পৃথিবীতে আসা এই প্রাণীর প্রজাতি ছয়টি। সেটি আবার দুইভাগে বিভিক্ত। দুই আঙুল বিশিষ্ট শ্লথ ও তিন আঙুল বিশিষ্ট শ্লথ। তবে বেশির ভাগ শ্লথের পায়ে তিনটি করে আঙুল দেখা যায়। দুই প্রজাতির স্লথের চেহারা প্রায় একই। স্লথ ২৪ থেকে ৩১ ইঞ্চি লম্বা হতে পারে এবং প্রজাতির উপর নির্ভর করে, ওজনে ৩ থেকে ৮ কেজি হতে পারে। মুখের উপরে ১০টি এবং নিচের পাটিতে ৮টি দাঁত থাকে এদের।
এদের মাথা গোলাকার, চোখ বিষাদ মাখা, ছোট কান এবং লেজ ছোট ও মোটা। স্লথ তাদের মাথা ২৭০ ডিগ্রি পর্যন্ত ঘোরাতে সক্ষম। তাই তারা চতুর্দিকে নজর রাখতে পারে। দুই আঙুল ওয়ালা স্লথ সামান্য বড় হয়, কিন্তু এদের প্রকৃতি তিন আঙুল ওয়ালা স্লথের মতোই, যারা গাছের বিভিন্ন খাঁজে বসে থাকে। তিন আঙুল ওয়ালা স্লথের মুখের বর্ণ এমনভাবে সাজানো যে দেখে মনে হয় এরা সবসময় হাসছে। তাদের ঘাড়ে দুটি বাড়তি কশেরুকা থাকে যা তাদের মাথা প্রায় বৃত্তাকারে ঘোরাতে সাহায্য করে।
স্লথ ধীরগতি হওয়ার কারণ হলো, এদের বিপাক ক্রিয়া খুব ধীরগতিতে হয়। বাজ জাতীয় শিকারি পাখির হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য এরা সবুজ পাতার আড়ালে লুকিয়ে থাকে ও নড়াচড়া করে না বললেই চলে। এই গেছো প্রাণীটি এতোই ঘুম প্রিয় ও এতই অলস, যে এরা দিনে ২০ ঘণ্টা পর্যন্ত ঘুমায়।
এদের দেহ ঘন লোমে আবৃত থাকে এই কারণে ক্রান্তীয় বর্ষাবনের ভেজা আবহাওয়ার ফলে এদের শরীরে মথ, গুবরে পোকা, কৃমি, ফাংগি এবং উকুন বাসা বাঁধে। এরা লতা পাতা এবং কচি ডালপালা খেয়ে অভ্যস্ত, তবে এগুলো হজম করে শক্তির উৎপাদন করা অত্যন্ত জটিল প্রক্রিয়া এবং এই সমস্ত তৃণ জাতীয় খাদ্য থেকে খুবই কম শক্তি পাওয়া যায় ফলে স্লথরা অত্যন্ত ধীরে নড়াচড়া ও চলাফেরা করে শক্তির অপচয় রোধ করে।
স্লথ গাছেই বাস করে এবং গাছ থেকে সহজে নিচে নামে না। সপ্তাহে মাত্র একবার এরা প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে নিচে নামে। স্লথরা সচরাচর তৃণভোজী হয়ে থাকে এবং গাছের কচি পাতা, কুড়ি, কচি ডাল এবং ফল খেয়ে বেঁচে থাকে তবে কিছু কিছু প্রজাতির স্লথ ছোট ছোট পোকামাকড় এবং ছোট আকারের সরীসৃপ খেয়ে থাকে। একবার খাদ্য গ্রহণ করার পর হজম হতে প্রায় ৩-১৫ দিন লেগে যায়। এই পরিপাক প্রণালীর জন্য এদের পাকস্থলী শরীরের দুই তৃতীয়াংশ জায়গা দখল করে থাকে।
শিকারির আক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য তীব্রভাবে কামড়িয়ে, চিৎকার করে, থাবা দিয়ে সজোরে আঘাত করে এবং তীক্ষ্ণ চিৎকার করে। স্লথ মায়েরা তাদের বাচ্চার প্রতি যত্নবান। জন্মের পর ৬ মাস তারা মায়ের সঙ্গে লেগে থাকে। গাছের মধ্যে চলাচলের সময় তারা মায়ের পেট আঁকরে ধরে রাখে।
সূত্র: ট্রাভেল অ্যান্ড লেজার
কেএসকে/জেআইএম/জিকেএস