শিশুর জ্বর সাধারণ নাকি ডেঙ্গু বুঝবেন যেভাবে
ডা. সেলিনা সুলতানা
করোনাভাইরাস পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতেই ডেঙ্গু আতঙ্ক সবার মনে বিরাজমান। বড়দের চেয়ে ডেঙ্গুতে শিশুরাই বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য অনুসারে, চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ২২ অক্টোবর পর্যন্ত বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা সর্বমোট ২২ হাজার ১৩০ জন।
একই সময়ে তাদের মধ্য থেকে হাসপাতাল থেকে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ২১ হাজার ২৬৬ জন রোগী। ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়ে এ পর্যন্ত মৃত্যুবরণ করেছে ৮৪ জন। অনেক সময় ডেঙ্গু রোগীকে দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি না করার ফলে মৃত্যু ঘটতে পারে।
ডেঙ্গু জ্বর গ্রীষ্মমন্ডলীয় বা ট্রপিকাল এবং উপ-ক্রান্তীয় বা গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলে একটি সাধারণ ভাইরাল সংক্রমণ। যা মশাবাহিত একটি রোগ। বিশ্বব্যাপী ক্রান্তীয় বা গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলে ডেঙ্গুর মহামারি নাটকীয়ভাবে পুনরুজ্জীবিত হয়েছে।
শহরাঞ্চলে ডেঙ্গু জ্বর বেশি দেখা যায়। বিশ্বজুড়ে মানুষ ও মশার চলমান ভ্রমণের ফলে শহুরে ডেঙ্গু জ্বর ৩০ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ১৯৬০-২০২১ সালের মধ্যে শহুরে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব ঘটেছে বেশি।
ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণগুলো সাধারণত সংক্রমণের ৩-১৪ দিন পরে শুরু হয়। এক্ষেত্রে উচ্চমাত্রার জ্বর, মাথাব্যথা, বমি, পেশী, জয়েন্টের ব্যথাও ত্বকে ফুসকুড়ি হতে পারে। ডেঙ্গুর লক্ষণগুলো সাধারণত ২-৭ দিন স্থায়ী হয়। বেশিরভাগ রোগীই প্রায় এক সপ্তাহ পরে সুস্থ হয়ে ওঠেন।
তবে গুরুতর ডেঙ্গু হলে প্লাজমা লিক, তরল জমা, শ্বাসকষ্ট, মারাত্মক রক্তপাত বা রক্তচাপ বিপজ্জনক মাত্রায় কসে যেতে পারে। যার ফলে ডেঙ্গু শক হয়। যা অনেক সময় মৃত্যুর কারণ হতে পারে। তাই ডেঙ্গু রোগীর তীব্র পেটে ব্যথা, ক্রমাগত বমি, শ্বাসকষ্ট ও অস্থিরতা হলে দ্রুত হাসপাতালে নিতে হবে।
সাধারণ ডেঙ্গু এক শতাংশেরও কম ক্ষেত্রে মারাত্মক হয়। ডেঙ্গু হেমোরেজিক জ্বর ২.৫ শতাংশ ক্ষেত্রে মারাত্মক হয়। যদি ডেঙ্গু হেমোরেজিক জ্বরের চিকিৎসা না করা হয় তাহলে মৃত্যুহার ২০-৫০ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে।
ডেঙ্গু ভাইরাসের চারটি সেরোটাইপ আছে, যা ডিইএনভি-১, ডিইএনভি-২, ডিইএনভি-৩ ও ডিইএনভি-৪ হিসেবে মনোনীত। নির্দিষ্ট কিছু মশার কামড়ের মাধ্যমে এটি মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমিত হয়। এরা এডিস মশার প্রজাতি, প্রাথমিকভাবে এ ই ইজিপ্টি, এ ই এলবো পিকটাস বলা হয়।
ডেঙ্গু মশা রাতের বেলায়ও কামড় দিতে পারে তা অনেকেই জানেন না। তবে দিনের বেলায় মশার বিস্তার বেশি হয়, তাই এ সময় সংক্রমণ ও বেশি ঘটাতে পারে। ডেঙ্গু ভাইরাস শরীরে প্রবেশের পর চলার পথে আরও কোষকে সংক্রামিত করে।
ডেঙ্গু মারাত্মক ক্ষেত্রে লিভার আক্রান্ত করে। এক্ষেত্রে দুর্বলতা, খেতে না পারা, বমি বমি ভাব ও লিভারের জায়গায় ব্যথা অনুভব হতে পারে। এগুলো সাধারণত জ্বর কমার পরপর অনুভূত হয় ও ৫-৭ দিন থাকে।
ডেঙ্গু জ্বরের ফেইজগুলো সাধারণত তিন ভাগে থাকে। প্রথম হলো ফেব্রাইল বা জ্বরের ফেইস, যা ২-৭ দিন স্থায়ী হয়। ডেঙ্গু জ্বর হঠাৎ উচ্চ জ্বর দিয়ে শুরু হয়, প্রায়শই ১০৫° F (৪০.৫ ° C) পর্যন্ত উচ্চ হয়।
২-৫ দিনের মধ্যে শরীরের বেশিরভাগ অংশে একটি সমতল, লাল ফুসকুড়ি দেখা দিতে পারে। ছোট ও লাল পিনহেডের মতো ফুসকুড়ি যা ত্বকে গভীরভাবে আবদ্ধ বলে মনে হয়। ত্বকে হাত বুলালে এই ফুসকুড়ি অনুভব করা যায় না। দ্বিতীয় ফুসকুড়ি, যা হাম এর মতো দেখায়। এটি ৪৮-৭২ ঘণ্টা পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে।
এমন ডেঙ্গু রোগীর শরীরে জ্বর খুব বেশি থাকে না। তবে রোগী ক্লান্ত হয়ে পড়ে, রক্ত কণিকার মধ্যে শ্বেত কণিকা বা অনুচক্রিকা কমে যায় ও হেমাটোক্রিট (রক্তের হিমোগ্লোবিনের ঘনত্ব) বেড়ে যায়। তৃতীয় বা শেষ হলো কনভালোসেন্ট বা রোগ থেকে উন্নতি হওয়ার পর্যায়।
সাধারণ বা ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গু জ্বর থাকে ২-৭ দিন পর্যন্ত। উপসর্গের মধ্যে বমি বমি ভাব, খাওয়ার অরুচি, শরীরের বিভিন্ন জায়গার অস্থিসন্ধি ও মাংসপেশিতে তীব্র ব্যথা, মাথাব্যথা অনুভূত হয়। মাঝারি অবস্থায় অর্থাৎ চতুর্থ দিনে শরীরে ফুসকড়ি দেখা যায়।
এক্ষেত্রে তীব্র পেটে ব্যথা, বমি করতে করতে ক্লান্ত হয়ে যাওয়া, হাত পা ছেড়ে দেয়া, রক্তের অনুচক্রিকা মাত্রা অতিরিক্ত মাত্রায় কমে যাওয়া, রক্ত বমি হওয়ার সম্ভাবনা, দাঁতের মাড়ি থেকে রক্ত পাত, কালো পায়খানা এগুলোই তীব্র ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ বলে গণ্য হয়।
এক সময় রক্তপাত বেশি মাত্রায় হয়, প্লাজমা লিকেস বা রক্ত রস বেরিয়ে পেটের মধ্যে জমে। ফুসফুসে পানি জমে যার ফলে শ্বাসকষ্ট হয়। মারাত্মক ডেঙ্গু জ্বর অভ্যন্তরীণ রক্তপাত ও অঙ্গ যেমন- লিভার ও কিডনির ক্ষতি করতে পারে। রক্তচাপ বিপজ্জনক মাত্রায় নেমে যেতে পারে, যার ফলে শক হয়।
আসন্ন শকের সাধারণ লক্ষণগুলোর মধ্যে আছে পেটে ব্যথা, বমি ও অস্থিরতা। কিছু ক্ষেত্রে মারাত্মক ডেঙ্গু জ্বরে মৃত্যু হতে পারে। যেসব নারীরা গর্ভাবস্থায় ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়, প্রসবের সময় শিশুর মধ্যেও ভাইরাস ছড়াতে পারে।
সাধারণ ভাইরাস জ্বরে আক্রান্ত হলে ২-৩ দিন অপেক্ষা করা প্রয়োজন। তবে এখন জ্বর আসার ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়ার কথা বলা হয়। সাধারণ ডেঙ্গু জ্বরে চিকিৎসক বাড়িতে বিশ্রামে থাকার পরামর্শ দেন। সঙ্গে জ্বর কমানোর জন্য প্যারাসিটামল সিরাপ দেওয়া হয় বয়স ও ওজন অনুযায়ী। প্রচুর পরিমাণে তরল খাবার খাওয়ানোর জন্য বলা হয় শিশুটিকে।
এরপর চিকিৎসক রক্ত পরীক্ষার জন্য উপদেশ দেন ও তিন দিন পর আসতে বলেন যদি না অন্য কোন উপসর্গ দেখা দেয়। মাঝারি বা তীব্র ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্তদের হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এক্ষেত্রে রক্তচাপের পরিমাণ কমে যায়, প্লাজমা লিকেজ হয়, বাচ্চার মধ্যে অস্থিরতা ও খেতে না পারা লক্ষণগুলো চলে আসে।
যথাযথ ওষুধ ও পরিচর্যার মাধ্যমে সাধারণ ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত শিশুরা ১০-১৫ দিনের মধ্যে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যায়। স্বাস্থ্যের উপর এর প্রভাব সুস্থ হওয়ার পরে আরও দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে। সাধারণত অস্থিসন্ধি ও মাংসপেশিতে ব্যথা থাকে বেশ অনেকদিন। শিশুদের মধ্যে দুর্বলতা থাকে ও খাবারের রুচি থাকে না।
ডেঙ্গু জ্বরে একবার আক্রান্ত হলে আবারও হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। ডাক্তাররা রক্ত পরীক্ষা করে ডেঙ্গু সংক্রমণ নির্ণয় করতে পারেন, যাতে ভাইরাস বা অ্যান্টিবডি পরীক্ষা করা হয়।
শিশুরা যেন ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত না হয় তার প্রতিরোধে আসলে আমাদের করণীয় দুটি উপায় আছে। একটি হলো টিকা দেওয়া ও অন্যটি বাহকের বিস্তার রোধ করা। টিকা বা ভ্যাকসিন বহির্বিশ্বে চলে এসেছে। এদেশে এখনো সহজলভ্য হয়ে ওঠেনি। এজন্য আমাদের বাহক মশার বিস্তার রোধে প্রথম গুরুত্ব দেয়া উচিত।
জেএমএস/এমএস