ভিডিও EN
  1. Home/
  2. ফিচার

ভিটামিন সি কেন গুরুত্বপূর্ণ?

ডা. হিমেল ঘোষ | প্রকাশিত: ০২:৩৩ পিএম, ১৪ আগস্ট ২০২১

রসায়নের ভাষায় ভিটামিন-সি এর নাম হলো অ্যাসকরবিক অ্যাসিড। এটি একটি অম্লধর্মী জৈব যৌগ ও সাদা দানাদার পদার্থ। যা শাকসবজি ও টক ফলমূলে বেশি পাওয়া যায়। মানুষসহ বিভিন্ন প্রাণী ও উদ্ভিদের জন্য এটি একটি প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান।

‘ভিটামিন-সি’ দ্বারা মূলত এর একাধিক ভিটামারকে বোঝানো হয়। যেগুলো প্রাণী ও উদ্ভিদের দেহে ভিটামিন-সি এর মতোই কাজ করে। এসব ভিটামারের মধ্যে অ্যাসকরবিক অ্যাসিডসহ এর বিভিন্ন লবণ এবং ডিহাইড্রোঅ্যাসকরবিক অ্যাসিডের মতো কিছু জারিত যৌগও বিদ্যমান।

১৯১২ সালে ভিটামিন সি আবিষ্কৃত হয়। এটিই প্রথম ভিটামিন যেটি রাসায়নিকভাবে প্রস্তুত করা হয়েছিলো। ভিটামিনটির আবিষ্কারের পেছনে আছে এক দীর্ঘ ইতিহাস।

এই আবিষ্কারে একজন ব্যক্তির নাম ওতোপ্রোতভাবে জড়িত- তিনি হলেন অ্যালবার্ট জেন্ট গিয়র্গি। ১৯৩৭ সালে এ আবিষ্কারের জন্য তিনি চিকিৎসাবিদ্যায় এবং ওয়াল্টার নরম্যান হাওরথ রসায়নে নোবেল পুরষ্কার লাভ করেন।

শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে ভিটামিন সি এর গুরুত্ব অপরিসীম। বিশেষ করে করোনাভাইরাসের এই মহামারির সময় রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে ভিটামিন সি এর জুড়ি মেলা ভার। পাশাপাশি এটি ব্যাকটেরিয়াল সংক্রমণের বিরুদ্ধেও লড়াই করে।

পাশাপাশি হাড় ও দাঁতের জন্যও ভিটামিন সি অনেক উপকারী। এটি ত্বকের টিস্যুর গঠনেও সরাসরি অংশ নেয়। যেকোনো ক্ষত খুব তাড়াতাড়ি সাড়িয়ে তুলতেও এই ভিটামিনের বিকল্প নেই। অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট হিসাবে ক্ষতিকর ফ্রি-রেডিক্যাল থেকেও রক্ষা করে এটি। ভিটামিন-সি দাঁত ও মাড়ির স্বাস্থ্যকে ভালো রাখে।

প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় ভিটামিন সি’সমৃদ্ধ ফল ও শাকসবজি রাখলে সহজেই এর দৈনিক চাহিদা পূরণ করা সম্ভব। ভিটামিন সি পানিতে দ্রবণীয় বিধায় এটি শরীরে সঞ্চিত থাকে না। এই ভিটামিন প্রয়োজনের অতিরিক্ত গ্রহণ করলে তা প্রস্রাবের মাধ্যমে বেরিয়ে যায়।

তাই প্রতিদিনই নির্দিষ্ট পরিমাণে ভিটামিন সি গ্রহণ করা আবশ্যক। যেমন- শিশুদের ক্ষেত্রে ৩০-৩৫ মিলিগ্রাম, প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে ৪৫ মিলিগ্রাম, গর্ভবতী নারীদের ক্ষেত্রে ৫৫ মিলিগ্রাম ও প্রসূতি মায়েদের ক্ষেত্রে ৭০ মিলিগ্রাম করে ভিটামিন সি প্রতিদিনই দৈনন্দিন খাদ্যের সঙ্গে গ্রহণ করতে হয়।

তবে ধূমপায়ীদের ক্ষেত্রে এই ভিটামিনটি আরও বেশি খাওয়া জরুরি। কারণ ধূমপান করলে শরীরে ভিটামিন সি ক্রমাগত কমতে থাকে। ফল ও সবজি কাঁচা খেলে ভিটামিন সি যথেষ্ট পরিমাণে শরীর গ্রহণ করে থাকে। এ ছাড়াও বিভিন্ন শাকেও প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি থাকে।

তবে বেশিক্ষণ রান্না করার ফলে যেকোনো সবজি তার পুষ্টিগুণ হারিয়ে ফেলে। অতিরিক্ত তাপ ভিটামিনের রাসায়নিক গঠন ভেঙে দেয়। এজন্য ভিটামিন সি এর ঘাটতি পূরণে সবজি যথাসম্ভব কাঁচা অবস্থাতেই খাওয়া উচিত।

নিতান্ত তা সম্ভব না হলে শাকসবজি উচ্চতাপে দীর্ঘ সময় ধরে রান্না করা থেকে বিরত থাকতে হবে। এজন্য ঢাকনা দেওয়া পাত্রে যথাসম্ভব অল্প পানি ব্যবহার করে দ্রুত রান্না করুন। খাবারে সর্বোচ্চ পরিমাণ ভিটামিন সি ধরে রাখতে ভাঁপে অথবা প্রেসার কুকারে রান্না করাই উত্তম।

ভিটামিন সমৃদ্ধ যত খাবার

আমলকি, পেয়ারা, করমচা, জাম্বুর, আমড়া, কাগজি লেবু, পাকা পেঁপে, কালোজাম, মাল্টা, বরই, লেবু, পাকা আম, কমলা, জলপাই, আতা, পাকা তাল, আনারস, লিচু, বেদানা, বাঙ্গি, জামরুল ইত্যাদি ফল।

এ ছাড়াও সজনেপাতা, ধনেপাতা, গাজরপাতা, করল্লাশাক, পুঁইশাক, কালো কচুশাক, সরিষাশাক, বরবটিপাতা, সবুজ কচুশাক, হেলেঞ্চাশাক, লালশাক, মিষ্টিকুমড়াশাক, কলমিশাক, পালংশাকেও থাকে ভিটামিন সি।
সেইসঙ্গে কাঁচা মরিচ, উচ্ছে, করল্লা, কাঁচা আম, ফুলকপি, শজনে, কাঁচা টমেটো, চালকুমড়া, পাকা টমেটো, কাঁচা কলা, কাঁচা পেঁপে, শুকনা মরিচ, পুদিনাপাতা, থানকুনিপাতা ইত্যাদি শাকসবজিতেও প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি বিদ্যমান থাকে।

ভিটামিন সি এর অভাবে কী হয়?

এর ঘাটতি হলে দেখা দিতে পারে স্কার্ভি এর মতো রোগ। স্কার্ভি এর প্রাথমিক উপসর্গের মধ্যে আছে অসুস্থতা বোধ, ক্লান্তিবোধ, অবসন্নতা ও তন্দ্রা। এক থেকে তিন মাস পরে রোগীর অস্থিব্যথা ও শ্বাসকষ্ট হতে পারে। কারনিটিন উৎপাদন কমে যাওয়ার জন্য মানংসপেশিতে ব্যথাও হতে পারে।

স্কার্ভির অন্যান্য লক্ষণের মধ্যে অন্যতম হলো ত্বক খসখসে হয়ে যাওয়া, ত্বকে সহজে কালশিটে পড়া ও লাল বিন্দুর মতো ফুসকুড়ি দেখা দেওয়া, মাড়ি থেকে রক্তপাত, দাঁত ঢিলা হয়ে যাওয়া, শরীরে লৌহের শোষণ কমিয়ে রক্তশূণ্যতা তৈরি করা, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে বিপর্যস্ত করে ফেলা, ক্ষত নিরাময়ে বিলম্ব হওয়া, বিরক্তিভাব ও মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাওয়া, চোখ ও মুখ শুষ্ক হয়ে যাওয়া প্রভৃতি।

শেষ পর্যায়ে জন্ডিস, সমস্ত শরীর ফুলে যাওয়া, প্রস্রাবের পরিমাণ কমে যাওয়া, স্নায়ুরোগ, জ্বর, খিঁচুনি এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। বিগত কয়েক শতাব্দী পূর্বেই জাহাজে অবস্থানরত নাবিকেরা মুখে ঘা, ত্বকের রক্তক্ষরণ, ক্ষতস্থানের ধীরগতিতে নিরাময়সহ বিভিন্ন উপসর্গে ভুগেছিলেন। এর ফলে অনেকের মৃত্যু ঘটে।

মধ্যযুগীয় ইউরোপীয় ধর্মযুদ্ধের ইতিহাসে নাবিকদের এ রোগে ভোগার ও মৃত্যুর হার ছিল ব্যাপক। কুলম্বের আটলান্টিক সমুদ্রযাত্রা ও স্টিম ইঞ্জিন উৎপত্তির মাঝামাঝি সময়ে প্রায় ২ মিলিয়ন নাবিক এ রোগে ভুগেছিলেন বলে প্রমাণ আছে। বিশ্ববিখ্যাত পর্যটক ভাস্কো- ডা-গামা, ম্যাগালান, জর্জ অ্যানসন প্রমুখও এ রোগের কবল থেকে রেহাই পাননি।

আবার প্রয়োজনের অতিরিক্ত ভিটামিন সি গ্রহণ করলে ক্ষেত্রবিশেষে ডায়রিয়া, বমি বমি ভাব হওয়া বা বমি হওয়া, বুক জ্বালাপোড়া করা, তলপেটে অতিমাত্রায় ব্যথা হওয়া, মাথাব্যথা, অনিদ্রা প্রভৃতিও দেখা দিতে পারে।

এজন্য চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ভিটামিন সি সহ অন্য যেকোনো সাপ্লিমেন্ট কোনোভাবেই সেবন করা উচিত না। তাই করোনা মহামারির এই সময়ে চিকিৎসক বা পুষ্টিবিদের পরামর্শ নিন এবং প্রয়োজনে ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ করে নিজেকে ও পরিবারকে সুরক্ষিত রাখুন।

লেখক: এমবিবিএস (ঢাকা মেডিকেল কলেজ), বিসিএস (স্বাস্থ্য), মেডিকেল অফিসার, উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্র, ডুমুরিয়া, খুলনা।

জেএমএস/এমএস

আরও পড়ুন