‘করোনার বাজারে’ ফেরিওয়ালা ও কিশোরীর গল্প
সাজেদুর আবেদীন শান্ত
সেদিন গিয়েছিলাম গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার বাইগুনি গ্রামে ‘করোনার বাজার’ দেখতে। করোনার বাজার নামের কারণেই মূলত গিয়েছিলাম। পরে সেখানকার এক লোকের মুখে জানতে পারলাম, গতবছর লকডাউনের কারণে স্থানীয়ভাবে একটি বাজার স্থাপন করেছে লোকজন। যাতে তারা স্বাস্থ্যবিধি মেনে গ্রামেই বাজার করতে পারেন। যেহেতু করোনার সময় বাজারের সৃষ্টি, তাই বাজারের নাম ‘করোনার বাজার’।
লোকজনের সঙ্গে কথা বলতেই হঠাৎ লক্ষ্য করলাম, বাজারের একটু সামনেই একজন বয়স্ক লোক ‘এই চুড়ি, ফিতা, লেইস’ বলে হাক দিচ্ছেন। কাঁধে ছিল ভার। একপাশে কাচের বাক্স। আরেক পাশে বড় বাজারের ব্যাগ। তার সামনে হরেকরকম সাজ-সজ্জার জিনিস। আধা-পাকা চুল দেখে মনে হয়, বয়স আনুমানিক ৫০ এর কাছাকাছি।
তার হাক শুনে কাছে ছুটে এল এক কিশোরী। দৃশ্যটি দেখেই ফিরে গেলাম অতীতে। এক মুহূর্তের জন্য মনে হলো, আমি ফিরে গেছি আমার হারানো শৈশবে। মায়ের মুখে শুনেছিলাম, আমি না-কি এরকম এক ফেরিওয়ালার পেছনে পেছনে চলে গিয়েছিলাম অন্য গ্রামে। পরে অনেক খোঁজাখুঁজি সন্ধান পেয়েছিলেন। এসব কথা ভাবতে ভাবতে অতীত থেকে বর্তমানে ফিরি।
মেয়েটি ফেরিওয়ালার কাছে নূপুর দেখতে চাচ্ছে। দৃশ্যটি ক্যামেরাবন্দি করার লোভ সামলাতে পারলাম না। কাছে গিয়ে লোকটির মুখ থেকে জানতে পারলাম, তার নাম আব্দুল বারী। গ্রামের বাড়ি দিনাজপুরের পার্বতীপুর উপজেলায়। স্ত্রী আর তিন মেয়েকে নিয়েই তার সংসার। ভিটা ছাড়া কিছুই নেই। কিশোর বয়সেই এ পেশা বেছে নেন। সেই থেকেই দেশের বিভিন্ন প্রান্ত ঘুরে বেড়ান। ঘুরতে ঘুরতে রাত কাটান গ্রামের কোনো স্কুল-কলেজে।
গত রাতে তিনি ছিলেন হরিখালী স্কুলের বারান্দায়। সেখানেই রান্না-বান্না করে সকালে খেয়ে বের হয়েছেন। এভাবেই দিন কাটে। এক দিনে হাজার-বারোশ টাকা বিক্রি করেন। তা থেকে লাভ হয় চার-পাঁচশ টাকার মতো। বাড়ি ছেড়ে এরকম ঘুরতে ঘুরতে দুই-তিন মাস পর দেখা হয় স্ত্রী-মেয়েদের সাথে। আব্দুল বারী ও আমার কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনছে সেই কিশোরী।
এবার কিশোরীর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘তোমার নাম কী?’ কিশোরী উত্তর দিলো, ‘আমার নাম সুমাইয়া।’ এরপর জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কিসে পড় তুমি? কোন স্কুলে?’ কিশোরী বললো, ‘আমি আমার পাশের এলাকা সোনাতলার গার্লস স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ি।’ তাদের সঙ্গে কথা বলে চলে এলাম করোনার বাজারে। করোনার বাজার ঘুরে চলে এলাম গন্তব্যে।
বাসায় এসে হঠাৎ মনে পড়লো সেই কিশোরী ও ফেরিওয়ালার কথা। মনে মনে ভাবতে লাগলাম, আব্দুল বারীর কাছ থেকে কিশোরীটি নূপুর নিয়েছিল কি-না? আবার মনে হলো, যদিও নিয়েও থাকে। তাহলে কি দাম চুকিয়েছিল? না-কি আব্দুল বারী বলেছিল, ‘না মা, আজ তোমার কাছ থেকে নূপুরের দাম নেব না।’
আরও জানতে ইচ্ছা করছে, আব্দুল বারী কি কিশোরীর মধ্যে তার মেয়ের প্রতিচ্ছবি দেখতে পেয়েছিলেন? কিশোরীকে দেখে তার মেয়ের স্মৃতি মনে করে চোখ মুছতে মুছতে সেখান থেকে চলে গেলেন কি-না? ইচ্ছা করলেই তো আর জানতে পারবো না। কারণ আব্দুল বারী তো আর এক জায়গায় থাকার লোক নন। তিনি ঘুরে ঘুরে ফেরি করেন গ্রাম থেকে গ্রামে।
লেখক: ফিচার লেখক ও গণমাধ্যমকর্মী।
এসইউ/জিকেএস