মৃত মানুষও জীবন্ত হয়ে ওঠে যে ‘ডিজিটাল ম্যাজিকে’!
ঈদ শপিংয়ে মার্কেটে ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ যদি কোনো দোকানের শোকেসে দেখতে পান- একটা পুতুল শূন্যে নড়ে চড়ে বেড়াচ্ছে। তাহলে কি মনে হবে? ম্যাজিক! জ্বি, হ্যাঁ। সত্যিই ম্যাজিক! যুক্তরাষ্ট্রের নিউইর্য়ক শহরের ইউনিয়ন স্কোয়ারের দোকানগুলোর সামনে এরকম দৃশ্য হর-হামেশা চোখে পড়ে।
তবে এর পেছনে নেই প্রচলিত কোনো ম্যাজিক। এগুলো হলো ডিজিটাল প্রজন্মের জনপ্রিয় ভার্চুয়াল রিয়্যালিটি। এসব হলোগ্রাফি আর কম্পিউটারের ম্যাজিক খেলা। এজন্য থ্রিডি মুভি দেখার মতো করে চোখে বাড়তি কোনো পোলারাইজড চশমা বা অন্য কোনোরূপ ডিভাইস ব্যবহার করতে হয় না। যাকে বলে লাইভ হলোগ্রাফিক থ্রিডি টেলিপ্রেজেন্স।
ভিজ্যুয়াল ডিজিটাল মানবের সঙ্গে সাক্ষাৎ কথাবার্তা বলা যায়। হলোগ্রাফি হলো এমন এক ধরনের ফটোগ্রাফিক প্রযুক্তি যা কোনো বস্তুর ত্রিমাত্রিক ছবি তৈরিতে ব্যবহার করা হয়। লেজার রশ্মির সাহায্যে গড়ে তোলা কোনো বস্তুর ত্রিমাত্রিক প্রতিবিম্ব শূন্যে প্রক্ষেপ করা যায়। এ প্রযুক্তিতে তৈরি করা ত্রিমাত্রিক ছবি হলোগ্রাম নামে পরিচিত।
হলোগ্রাম তৈরির জন্য প্রথমেই দরকার হয় একটা বস্তু- যার হলোগ্রাম বানানো হবে। এরপর একটা লেজার বীমের মাধ্যমে বস্তুটার রশ্মি নিক্ষেপ করা হয়। সবকিছু ঠিকঠাক মতো ধারণ করতে দরকার হয়, একটি রেকর্ডিং মিডিয়ার। রেকর্ডিং মিডিয়া একই সঙ্গে ছবিটা আরও স্পষ্ট ও জীবন্ত করে তোলে।
প্রথমেই একটি লেজার বীমকে দু’টো লেজার বীমে রূপান্তর করা হয় এবং একটা আয়নার মাধ্যমে চালিত করা হয়। এর মধ্যে একটা বীম লক্ষ্যবস্তুর গায়ে নিক্ষেপ করা হয়। আর দ্বিতীয় বীমটা নিক্ষেপ করা হয় রেকর্ডিং মিডিয়ামের উপর। এবার যন্ত্রের মাধ্যমে লক্ষ্যবস্তুর একটি পরিষ্কার ছবি ধারণ করা হয়।
দু’টো লেজার বীম পরবর্তীতে পুনরায় একে অপরের সঙ্গে বাঁধাপ্রাপ্ত হয়। এমনভাবে এগুলো বাঁধাপ্রাপ্ত হয় যেনো সেটা আমাদের সামনে লক্ষ্যবস্তুর একটা ত্রিমাত্রিক ছবি তুলে ধরে। এক কথায়, এ ধরনের ত্রিমাত্রিক ছবি তৈরি করার জন্য লেজার, ইন্টারফারেন্স ডিফ্রাকশন, লাইট ইনটেনসিটি রেকর্ডিং এবং ইলিউমিনেশন অব দ্য রেকর্ডিং- নামে চার প্রকার প্রযুক্তির একটা কার্যকরী সমন্বয় ঘটানো হয়।
হলোগ্রাফি এবং ফটোগ্রাফির মধ্যে মূল পার্থক্য হলো- ফটোগ্রাফি দ্বিমাত্রিক এবং হলোগ্রাফি ত্রিমাত্রিক প্রযুক্তির। দ্বিমাত্রিক ছবিতে মাত্র একটি পয়েন্ট অব ভিউ থাকে। আমাদের চোখে কোনো বস্তুর গভীরতা নির্ণয়ে দু’টো পয়েন্ট অব ভিউ দরকার হয়। যা থাকে হলোগ্রাফি প্রযুক্তির ছবি হলোগ্রামে।
এক সময় হলোগ্রাফিতে শুধু স্থির প্রতিবিম্ব সৃষ্টি করা যেত। বর্তমান রমরমা ডিজিটাল যুগে চলমান হলোগ্রাফ অতি সহজেই তৈরি করা সম্ভব হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইর্য়ক শহরের ইউনিয়ন স্কোয়ারের দোকানগুলোর সামনে ক্রেতা বা কৌতুহলী দর্শকরা ভার্চুয়াল রিয়্যালিটি বা চলমান হলোগ্রাফ দেখে মুগ্ধ হন।
এই হলোগ্রাফি প্রযুক্তি এখন সিনেমা, ম্যাজিক, জাদুবিদ্যার স্থান দখন করে নিয়েছে। মানুষের মাথার ত্রিমাত্রিক প্রতিবিম্ব দিব্যি শূন্যে পায়চারি করে বেড়ায়। মানুষের দেহ থেকে মাথাটা আলাদা করে অ্যানিমেশন দেওয়া যায়। সেই মাথা শূন্যে ভেসে ভেসে অন্য মানুষের সঙ্গে জীবন্ত মানুষের মতো সব কথা বলতে পারে।
এমনকি মানুষের মাথার তলায় হাতের তালু পেতে দিলে মনে হবে যেনো ম্যাজিশিয়ান জুয়েল আইচের হাতে ধরা গলাকাটা মাথা। আর ভাসমান মাথাটা যখন নড়েচড়ে, কথা বলে, তখন মনে হয় ওটা সত্যি সত্যিই জাদুর ক্যারিশমা। অথবা দেখা যায়, জমকালো দর্শক অনুষ্ঠানে হাতির সার্কাস খেলা, ঘোড় দৌড় খলা ইত্যাদি।
উল্লেখ্য, কিছুদিন আগে খবর শোনা যায়, ‘ফিরে এলেন মাইকেল।’ খবর দেখে অনেকেই চমকে উঠেন। তবে খবরের থেকে বেশি অবাক হয়ে যান, যখন দেখা যায়, বিলবোর্ড মিউজিক অ্যাওয়ার্ডে মাইকেলের বিখ্যাত মুনওয়াক ভিডিও। অনেকেই মনে করেছিলেন সত্যিই মাইকেল জ্যাকসন। কারণ সেখানে মাইকেলকে দেখাচ্ছিলো একদমই জীবন্ত।
এসব কীভাবে সম্ভব? যে পদ্ধতিতে এই অদ্ভূত ব্যাপার-স্যাপার ঘটানো হয়, তার নাম অগমেন্ট রিয়্যালিটি। এটাও এক ধরনের ভার্চুয়াল রিয়্যাালিটি বা কল্পনার বাস্তব। লেজার ডিস্ক থেকে সংগৃহীত রশ্মির সংকেত কম্পিউটারে ফেলে সেগুলোর মধ্যে কম্পিউটারের সফটওয়্যারের সাহায্যে গাণিতিক সংহতি বিধান করতে হয়।
এরপর সেই রশ্মি, একটি বিশেষ অপটিকেল সিস্টেমের ভেতর দিয়ে চালান করে কোনো বস্তুর যে প্রতিবিম্ব মিলছে তা শূন্যেই প্রক্ষেপ করা যায়। প্রক্ষিপ্ত ত্রিমাত্রিক প্রতিবিম্বকেই আমরা দেখতে পাই শূন্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে, কথা বলছে। মানুষের প্রশ্নের উত্তরও দিচ্ছে। হলোগ্রাফির এই কারিকুরি প্রযুক্তিকে বলে হলোগ্রাম।
এটি প্রথম তৈরি করেন ইংরেজ পদার্থবিজ্ঞানী ডেনিশ গ্যাবর ১৯৪৭ সালে। প্রযুক্তির সীমাবদ্ধতার কারণে পুরোপুরি ত্রিমাত্রিক রূপ দেওয়া যায়নি সেই হলোগ্রামে। পরবর্তীতে ১৯৬০ সালে লেজার প্রযুক্তি আবিষ্কৃত হলে হলোগ্রাফির গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন ঘটে। হলোগ্রাফির মূলতত্ত্ব আবিষ্কারের জন্য গ্যাবরকে ১৯৭১ সালে নোবেল পুরষ্কার প্রদান করা হয়।
আধুনিক তরুণ বিজ্ঞানীদের হাত ধরে হলোগ্রাফি প্রযুক্তি পূর্ণতা পায়। যুক্তরাষ্ট্রের ডাইমেনশন মিডিয়া অ্যাসোসিয়টেস্ নামে এক সংস্থার উদ্ভাবিত হলোগ্রাফি প্রযুক্তির মুভি, বিজ্ঞাপন শিল্পে ব্যাপক ব্যবহৃত হচ্ছে। ডিজিটাল তরুণ প্রজন্মের হাতে হাতে প্রযুক্তির ছোঁয়ায় এখন উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে হলোগ্রাফি।
আজকাল বিভিন্ন উৎসব, কনসার্ট, অনুষ্ঠানে ত্রিমাত্রিক হলোগ্রাফির ভার্চুয়াল রিয়্যালিটি ছবি প্রদর্শন মূল আকর্ষণ। মজার ব্যাপার হচ্ছে, তরুণ প্রজন্মের ব্যাপক চাহিদার কারণে হলোগ্রাফিক গেম তৈরিতে এরই মধ্যে উঠে পড়ে লেগেছে বিজ্ঞানীরা। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে বলা যেতে পারে, সামনে আসছে হলোগ্রাফি বিপ্লবের যুগ।
বর্তমান বিশ্বের ডিজিটাল প্রযুক্তি পরিমণ্ডলের উৎকর্ষতার নানাদিক, চোখ ধাঁধানো উন্নয়ন দেখে ধারণা করাই যায়- আগামীতে ডিজিটাল বাংলাদেশের সর্বত্র বিরাজ করবে ভাচুর্য়াল রিয়্যালিটি বা কল্পনার বাস্তবতা। এরই মধ্যে এদেশের বিজ্ঞাপন শিল্পে অভাবনীয় ডিজিটাল নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে।
পথ-ঘাট, স্টেশন, বন্দরের বিজ্ঞাপনে ব্যাপকভাবে যুক্ত হয়েছে ডিজিটাল এলইডি ডিসপ্লে মনিটর। যাতে প্রদর্শিত হয় নানান পণ্যের বিজ্ঞাপন চলচ্চিত্র। বিজ্ঞাপনে এই ভার্চুয়াল রিয়্যালিটি বা হলোগ্রাফি প্রযুক্তি বাংলাদেশের রাস্তাঘাটে সবখানে ব্যবহৃত হতে আর বেশিদিন বাকি নেই।
ঈদ কেনাকাটায়, শপিং মলে ক্রেতাদের সামনে এগিয়ে এসে ‘এক্সকিউজ মি’ ‘হ্যালো’ ‘ওয়েলকাম’ বলা মার্কেটিংয়ের স্মার্ট তরুণ-তরুণীদের চাকুরি আর থাকবে না। তার বদলে বিভিন্ন কোম্পানির পণ্যের প্রচারে আপনার প্রিয় মডেল, প্রিয় তারকা ভার্চুয়াল রিয়্যালিটি হয়ে সামনে হাজির হবে। দু’জনে সামনা-সামনি কথা হবে। আগামীতে ম্যাজিকের মতো এমন ভার্চুয়াল ডিজিটাল পরিবেশ দেখে মোটেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
লেখক: বিজ্ঞান লেখক ও গবেষক, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
জেএমএস/জেআইএম