টানা ১০ বছর ঘুমিয়ে রেকর্ড করেছেন তিনি!
স্লিপিং বিউটির রূপকথার গল্পটি সম্পর্কে সবাই কমবেশি জানেন নিশ্চয়ই! যিনি অভিশপ্ত হয়ে বছরের পর ঘুমিয়ে ছিলেন। সত্যিকারের ভালোবাসার রাজকুমার এসে স্লিপিং বিউটির ঘুম ভাঙিয়েছিলেন। তবে রূপকথার স্লিপিং বিউটির চেয়েও বাস্তবের স্লিপিং বিউটির কাহিনী অনেক করুণ!
যুক্তরাজ্যের স্টকপোর্টের বেথ গুডিয়ের ২০১১ সালের নভেম্বরে একদিন হঠাৎ সোফায় ঘুমিয়ে পড়েন। তখন তার বয়স ১৭ বছর। তখন তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের শুরুর দিকে। চোখে তার স্বপ্ন ছিলে শিশু মনোবিজ্ঞানী হওয়ার। তিনি সে বিষয়েই পড়ালেখা করছিলেন। ফাইনাল পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করে উন্নত ক্যারিয়ার গড়ার স্বপ্ন ছিল তার চোখে।
তবে হঠাৎই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েন বেথ। তার পরিবারও ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলেন না, কী হয়েছে তাদের মেয়ের সঙ্গে। একদিন দুইদিন করে কেটে যায় ৬ মাস। তবুও বেথের ঘুম ভাঙছিলো না। বিভিন্ন পরীক্ষা-নীরিক্ষার পর জানা যায়, বেথ গুডিয়েরের ক্লেইন-লেভিন সিনড্রোম (কেএলএস) ধরা পড়েছে।
৬ মাস এরপর এক বছর এমন করে ৫ বছর ঘুমিয়ে কাটান বেথ। দিনের ২২ ঘণ্টা বেথ গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন থাকতেন। আর বাকি ২ ঘণ্টা অন্যের সাহায্য নিয়ে ঘুম ঘুম চোখেই খাওয়া ও বাথরুম সারতেন বেথ। তার মা জেনিন গণনা করেন, বেথ প্রায় ৭৫ শতাংশ সময় ঘুমিয়ে কাটিয়েছে বিগত ৫ বছরে।
চিকিৎসাবিজ্ঞানের তথ্য অনুযায়ী, ক্লিন-লেভিন সিনড্রোম (কেএলএস) বিরল একটি রোগ। বিশ্বের মাত্র ১০০ জনের মধ্যে একজন স্লিপিং বিউটি সিনড্রোমে আক্রান্ত হয়ে থাকেন। এটি ঘুমের ব্যাধি। তবে কীভাবে এটি নিরাময় করা যায় সে সম্পর্কে উল্লেখ নেই চিকিৎসাবিদ্যাতেও!
জানা যায়, কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে হঠাৎ করেই এই ঘুম ব্যাধিটি দেখা দেয়। এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার গড় বয়স হলো ১৬ বছর। যেহেতু রোগটি তরুণ বয়সে হয়; তাই তাদের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার, বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার বা ক্যারিয়ার গড়ার স্বপ্ন নষ্ট করে দেয়। এই ঘুম এতোটাই গভীর হয়ে থাকে যে, ওষুধ, উচ্চ আওয়াজ কিংবা মিনতি করেও আক্রান্তদের জাগিয়ে রাখা যায় না।
বেথের মা জানান, আমাদের জন্য সবচেয়ে কঠিন বছরটি ছিল, যখন তার বন্ধুরা বিশ্ববিদ্যালয় শেষ করে ক্যারিয়ার গড়তে শুরু করে। অথচ আমাদের মেয়ে ঘুমিয়েই ছিল। বেথের মধ্যে এতটাই অবসাদ আর ক্লান্তি কাজ করত যে, তার খিদে বেড়ে যেত, আর মেজাজও চড়ে থাকে।
এই বিরল রোগ বিষয়ক শীর্ষস্থানীয় বিশেষজ্ঞদের একজন হলেন সেন্ট থমাসের এনএইচএস ট্রাস্টের পরামর্শদাতা স্নায়ু বিশেষজ্ঞ ডা. গাই লেশচিনার। তিনি বলেন, এই রোগে আক্রান্তরা ঘুমের মধ্যেই একটি স্বপ্নের জগত তৈরি করে নেয়। যার চারপাশের বিশ্ব থেকে খুব আলাদা। এটি তাদের জীবনে ব্যাপক প্রভাব ফেলে। তাই জেগে উঠলেও তারা কল্পনা ও বাস্তবতার সঙ্গে মিল খুঁজে না পেয়ে দিশেহারা হয়ে পড়ে।
বর্তমানে বেথের বয়স ২৭ বছর। এখনো দিনে ২০-২২ ঘণ্টা ঘুমিয়েই কাটান তিনি। তবে সবচেয়ে দুঃখজনক বিষয় হলো বেথ এখন শুধু কেএলএস সিন্ড্রোমেই ভুগছেন না বরং নতুন আরেকটি রোগেও বিগত ৫ বছর ধরে ভুগছেন তিনি।
হাইপারোমোবাইল ইহলারস ড্যানলস সিন্ড্রোম (ইডিএস) নামক ব্যাধির সঙ্গে লড়ছেন বেথ। এটি একটি টিস্যুর ব্যাধি যা কোলাজেন নামক একটি প্রোটিনের ত্রুটির কারণে হয়ে থাকে। ২০১৬ সালে প্রথম বেথের শরীরে ইডিএস ধরা পড়েছিল।
তার মা জেনিন জানান, তীব্র ব্যথা, গুরুতর হজম সমস্যা, মেরুদণ্ডে অস্থিরতাসহ শাররীরিক বিভিন্ন সমস্যায় ভুগছেন বেথ। তার চিকিৎসায় বিগত বছরগুলোতে পরিবার অনেক অর্থ ব্যয় করেছে। বর্তমানে বেথকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে বড় ধরনের অস্ত্রোপচার প্রয়োজন।
এখনো বেথের পরিবার আশা করেন, তাদের মেয়ে আবারও কিশোরী বয়সের মতো উচ্ছ্বল হয়ে উঠবে। আবারও বেথ ভ্রমণ করতে পারবে, পরিবারের সঙ্গে আনন্দ-হুল্লোড়ে মেতে উঠবে। বেথের মা বলেন, আমি যখন তাকে দেখি; তখন সেই উদ্ধৃতিটি মনে করি ‘তাকে ঘুমাতে দাও, কারণ সে যখন জেগে উঠবে; তখন সে বিশ্বকে কাঁপিয়ে দেবে...’
সূত্র: ডেইলি মেইল
জেএমএস/এএসএম