স্পিডবোট : পদ্মা পারাপারের জলদানব
সুরাইয়া পারভীন
স্পিডবোটে পদ্মা পারি দিতে ভয় লাগে। মনে হয় এখনই উল্টে গেল। গ্রামের রাস্তায় যারা অটো চালান, কোনোরকম ট্রেনিং নেই। স্পিডবোটের চালকরা সেই একই ধারার। তার উপরে বিশাল নদীতে পুরো রাজত্ব তাদের। এখানে দেখার কেউ নেই। কাউকে তোয়াক্কা করতে হয় না। বোট উল্টে মরে গেলে হদিস থাকবে না। অসম্ভব নয়, কেউ জানতেও পারবে না।
দেশে লকডাউন চলছে। যাকে বের হতেই হবে, যাকে ছুটতেই হবে; নানামুখী ঝুঁকি নিয়ে তিনি চলছেন। খুলনার মীমের পরিবার যাচ্ছিল মৃত্যুর খবর শুনে। এখন তারাই মৃত্যুর সংবাদ। জীবন-মৃত্যুর সীমারেখা ক্ষীণ, যে কেউ যেকোনো সময়েই মারা যেতে পারেন। তারপরও মানুষ বাঁচার তাগিদেই ছুটে চলে। এটা শুধু লোভ নয়, দায়িত্ব-কর্তব্য। মানুষের বেঁচে থাকার শক্তি। সব কাজ শেষ হয়ে গেছে। তার যা দায়িত্ব পালন হয়ে গেছে। এখন তার অফুরন্ত অবসর। এমন সময় মানুষের বোধ করি আসে না। আর যদি সে সময় এসেই যায়, তিনি হয়ে পড়েন জীবন্মৃত। তার থাকে অপেক্ষা, ক্লান্তিকর অপেক্ষা।
খুব দ্রুত সময়ে নদী পার হতে স্পিডবোট জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। ব্যবসায়ীরা প্রায় প্রতিনিয়ত যাতায়াত করেন। সময়ের তাড়া থাকে। তাদের জন্য স্পিডবোটই সঙ্গী। জুলুম করে ভাড়া আদায়, কোনো রকমের জীবনের নিরাপত্তা নেই। উঠলে ওঠেন, না পোষালে নামেন। আনাঢ়ি চালকের যাচ্ছেতাই আচরণ। পারাপারের জন্য এত মানুষ লাইন দিয়ে থাকে। লাইফ জ্যাকেটের প্রশ্ন তুললে তার আর বোটে জায়গা হয় না। জীবন হাতে নিয়ে নদী পার হতে হয়।
মায়ের মৃত্যুর সময় স্পিডবোটে পার হয়েছি। প্রচণ্ড তাড়ায়, ভালো-মন্দ বিশ্লেষণের সুযোগ থাকে না। নিরুপায় সে তো বটেই। একটু আগে যদি পৌঁছানো যায়। যদি মৃত মাকে দেখতে পারি! না, আমার বেলায় সম্ভব হয়নি! দাফনের পরেই পৌঁছেছি। এর আগে একবার গিয়েছি বোনের স্বামীর মৃত্যুতে। সেই প্রথম স্পিডবোটে পার হওয়া। সাধারণ সময়ে লঞ্চ বা ফেরিতেই যাতায়াত করি।
যে মানুষগুলো (২৬ জন) লাশ হলো। তাদের হয়তো ঠিক এমনই প্রচণ্ড তাড়া ছিল। সাথে লকডাউনের উপায়হীনতা। যান চলাচল বন্ধ। আমাদের দেশে কোনো কিছুই বন্ধ থাকে না। সুযোগটা লুফে নেয় ধুরন্ধরেরা। ফিটনেস থাকুক না থাকুক, নদীতে চলতে পারুক কি-না পারুক। যাত্রী তুলে স্টার্ট দিয়ে দিতে পারলেই হয়।
এদের দেখার কি কেউ নেই? দৌরাত্ম্য থামবে কি কোনোভাবে? লাইফ জ্যাকেট ছাড়া স্পিডবোট কোনোভাবেই অ্যালাও হওয়ার কথা নয়। বোটটি ডুবলো খামখেয়ালিতে। এরা থেমে থাকা কার্গো-স্টিমারে ধাক্কা দেবে। দুরন্ত গতিতে পাশের যানের সাথে প্রতিযোগিতায় নামবে। মন চাইলে সেখানে মজার ছলেও ধাক্কা দেবে। যাত্রীরা তো জিম্মি!
বিশ হাজার টাকা করে মৃতের পরিবার প্রতি ঘোষণা দেখছি। এই পরিমাণ টাকা করোনাকালীন বিপর্যস্তরা এমনিতেই দাবি করতে পারে। আর লাশ বাবদ বিশ হাজার টাকা। লঞ্চডুবিতে লাশের স্বজনের টাকা দেওয়ার বিষয়টা কিভাবে এবং কেন এসেছে? এর কোনো প্রতিকার কি কোনো কালেই হবে না? জীবন হাতে নিয়েই মানুষ ঘর থেকে বের হবে?
পদ্মা সেতু হচ্ছে, সেটা আমিও জানি। তাই সেতু হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে বলার কিছু নেই। ঢাকা শহরে সব ওভারব্রিজের নিচ দিয়ে মানুষ যাতায়াত করে। স্বভাবের আছে, আবার বাধ্যও আছে। প্রচুর মানুষের হাঁটুতে, গোড়ালিতে ব্যথা। সিঁড়ি বাইতে সমস্যা হয়। পদ্মা সেতু হলেও নদী পাড়ি দিতে বোট লাগবে। নদীর ওপারে থাকা সবার বাড়ি-ঘর সেতুর রাস্তায় নয়।
আমরা মরতেই এসেছি পৃথিবীতে। আমাদের জীবন প্রতিনিয়তই মৃত্যুর দিকে যায়। চারিদিকে করোনার ছোবল। মানুষ অন্তত সাহস করে বাঁচতে চাইতো। অথচ দুঃসাহস করে মরতে যায়।
লেখক: কলামিস্ট।
এসইউ/এমএস