বিষাক্ত সাদা ব্যাঙের বিষে তৈরি হবে ওষুধ
পৃথিবীতে সাদা রঙের এমন কিছু প্রাণি আছে, যেগুলো দৃষ্টিনন্দন। দেখতে সাদা ধবধবে হলেও বাস্তবে এরা যে কতটা বিষাক্ত, তার প্রমাণ আলবিনোর বুলফ্রগ। সুইডেনের বরফাচ্ছন্ন পর্বত আলবিনোয় দেখা যায় ধবধবে সাদা রঙের এই বিষাক্ত ব্যাঙ।
বিজ্ঞানীরা এর নাম রেখেছেন ডেনড্রোবেটস ভেনট্রিমেকিউলাটাস। এ ব্যাঙের গায়ে মেলানিন না থাকায় বরফাচ্ছন্ন পরিবেশের সঙ্গে মিলে যায়। শিকারি প্রাণির কবল থেকে আত্মরক্ষার জন্য সহজেই ছদ্মবেশ নিতে পারে। বুলফ্রগের চোখ জুড়ানো সাদা সৌন্দর্যের মাঝেই লুকিয়ে রয়েছে ভয়ঙ্কর বিষ। এ বিষে আছে প্রচণ্ড জ্বালা। আছে অবশ করে ফেলার ক্ষমতা আর প্রাণ কেড়ে নেওয়ার মত শক্তি।
সাধারণত সাপ বা গিরগিটি জাতীয় প্রাণি যদি একে পায়, তখন চোখ বুঝে ঘপাৎ করে গিলে ফেলে। কিন্তু কোনো শিকারি প্রাণি যদি বুলফ্রগ শিকার করতে যায়, তাহলে উল্টো সেটাই বিষের যন্ত্রণায় কুপোকাৎ হয়ে যায়। যেসব শিকারি প্রাণি এ সাদা ব্যাঙ সম্পর্কে জানে, ভুলেও তারা এর ধারে কাছে ঘেঁষবে না।
সাদা ব্যাঙ লুকিয়ে রাতের বেলা শিকার করতে নামে। এরপরও কিন্তু শিকারি প্রাণি দ্বারা আক্রান্ত হয় সাদা ব্যাঙ। যে শিকারি প্রাণি জানে না, এদের চামড়ায় মারাত্মক বিষ আছে; তারা অবলীলায় হামলা চালিয়ে বসে। এতে কখনো কখনো আহত হয় এ ব্যাঙ। অপরদিকে শিকারি প্রাণিরও চরম ভাগ্য বিপর্যয় ঘটে। বিষের প্রচণ্ড জ্বালা এবং মারাত্মক প্রতিক্রিয়া থেকে যদি কোনোমতে পার পেয়েও যায়, বাকি জীবনে আর নাম নেবে না বুলফ্রগের।
আলবিনো প্রজাতীয় মানুষরা শিকার ধরার কাজে বুলফ্রগ ধরে চামড়ার ওপরে তীর বা বর্শা ঘঁষে নেয়। আর তাতেই তীরের আগায়, বর্ষার ফলায় মেখে যায় ব্যাঙের ভয়ানক বিষ। কখনো কখনো ব্যাঙ ধরে আগুনের তাপে ঝুলিয়ে রাখে। আর তখন টপটপ করে ঝরে পড়তে থাকে ত্বকের ওপর থলেতে জমে থাকা বিষ।
কোনো কোনো বিজ্ঞানী বলেন, ‘বুলফ্রগ ইচ্ছাকৃতভাবেই নিজের শরীরে বিষ সঞ্চয় করে রাখে। অন্য কোনো প্রাণী আক্রমণ করলে তার দিকে ছুঁড়ে দেয় থলির ভেতর সঞ্চিত এ বিষ।’
মার্কিন গবেষক ডা. কান্ডওয়েল গবেষণায় পেয়েছেন, প্রতিরক্ষার তাড়নায় এদের শরীরে আপনা-আপনি বিষ তৈরি হয় না। খাবার-দাবার থেকে বিভিন্ন রাসায়নিক প্রক্রিয়ার পর তৈরি হচ্ছে এ বিষ। তিনি লক্ষ্য করেন, এ ব্যাঙ প্রচুর পিঁপড়া খায়। পিপড়ার শরীরেই আসলে অ্যালকালয়েডে ভরা। এভাবে বিষাক্ত পিপড়ার শরীর থেকে ব্যাঙের শরীরে ঢুকে পড়ে অ্যালকালয়েডের মত ভয়ানক বিষ। বিভিন্ন শারীরিক প্রক্রিয়ার পর তা জমা হতে থাকে ব্যাঙের চামড়ার ওপরের থলিগুলোয়।
এতো রক্ত হিম করা কাণ্ড ঘটালেও বিষাক্ত সাদা ব্যাঙ একদিক দিয়ে কিন্তু বেশ উপকারী। বিশেষ করে মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য। গবেষকরা লক্ষ্য করেন, বিষাক্ত সাদা ব্যাঙের বিষের অ্যালকালয়েডে আছে এক ধরনের ওষুধি উপাদান। যা রক্ত জমাট বাঁধার ক্ষেত্রে প্রবলভাবে বাঁধা দিয়ে থাকে।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, আমাদের চিকিৎসা বিজ্ঞানে ওষুধ হিসেবে এ অ্যালকালয়েড প্রেসক্রাইব করা হয় হরহামেশাই। সাধারণত শরীরের মাংস শিথিল করার কাজে ব্যবহৃত হয় এ ওষুধ। রক্তনালীতে রক্তের এ জমাট বাঁধার জন্য আধুনিক যুগেও মানুষের হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোকের মতো ভয়াবহ শারীরিক বিপর্যয় দেখা দিচ্ছে।
এবার বিজ্ঞানীরা আশা করছেন, সাদা ব্যাঙের বিষ অচিরেই ব্যবহার উপযোগী করে মানুষের হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতে ব্যাপকভাবে কাজে লাগানো সম্ভব হতে পারে। সম্প্রতি মার্কিন গবেষক ডা. জ্যাসলোফ এ ব্যাঙের সাদা চামড়ায় শনাক্ত করেছেন একধরনের শক্তিশালী আ্যন্টিবায়োটিক। তার মতে, এটি সহজেই মানবদেহে অবস্থিত জীবাণু ধ্বংস করতে সক্ষম। এ উপাদান দিয়ে তিনি বিশেষ ধরনের একটি ক্রিম আবিষ্কার করেছেন। যা ডায়াবেটিস ফুড আলসার নিরাময়ে বিশেষ ভূমিকা রাখবে। সেই সঙ্গে চেষ্টা চলছে করোনার ওষুধ তৈরির।
হয়তো আগামী দিনে করোনা, হৃদরোগ, ক্যান্সারের মতো জটিল রোগে আর কষ্ট করতে হবে না। সাদা ব্যাঙের বিষ দিয়ে তৈরি হবে জীবনদায়ী ওষুধ, এ কথা বলাই যায়।
লেখক: বিজ্ঞান লেখক ও গবেষক, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
এসইউ/এমএস