অত্যাচারী যে রাজা ‘তুঘলকি কাণ্ড’ ঘটাতেন
বাংলায় ‘তুঘলকি কাণ্ড’ নামের প্রবাদ বাক্য অনেকেরই জানা। এর অর্থ হলো বড়সড় কোনো ঘটনা, অন্যায় আর জোর জবরদস্তির কাণ্ড। তবে কীভাবে এর উৎপত্তি ঘটেছিল তা হয়তো অনেকেরই অজানা।
দিল্লির তুঘলক বংশের দ্বিতীয় সুলতান মুহম্মদ বিন তুঘলক (১৩২৫-১৩৩৮)। তিনি ১৩২৫ থেকে ১৩৩৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন। ইতিহাসে পাগলা রাজা নামেও পরিচিত তিনি। যখন যা মনে হত; তখনই তাই করতেন এই রাজা।
মধ্যযুগীয় ভারতের ইতিহাসে তিনিই সম্ভবত সবচেয়ে আকর্ষণীয় ও বিভ্রান্তিকর সুলতান ছিলেন। তার ছিল অসাধারণ প্রতিভা ও অদম্য কর্মশক্তি। মুহম্মদ বিন তুগলকের জ্ঞান ছিল দর্শন, ইতিহাস, চিকিৎসাবিদ্যা, হস্তাক্ষর, গণিত, জোতির্বিদ্যাসহ সব প্রাকৃতিক বিজ্ঞানেও।
কুরআন ও হাদিসে পারদর্শী মুহম্মদ বিন তুগলক ফার্সি ও আরবি ভাষায়ও ব্যুৎপত্তি লাভ করেন। উপমা দেওয়া এবং রূপক-বর্ণনায় তার সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার মতো সাহস বা জ্ঞান কারো ছিল না।
মুলতানে জন্মগ্রহণকারী তুঘলক বংশের এই শাসক সম্ভবত মধ্যযুগের সবচেয়ে শিক্ষিত, যোগ্য ও দক্ষ্য সুলতান ছিলেন। তবে তার পাগলাটে এবং পাশবিক আচরণের কারণেও তার কুখ্যাতি আছে।
চতুর্দশ শতাব্দীর দিল্লীর এ সুলতানের চরিত্র ছিল নানা নাটকীয়তায় ভরপুর। তিনি যেমন ছিলেন মহানুভব-নিষ্ঠুর ঠিক তেমনি বিদ্বান-বোকা। তার দূরদৃষ্টিসম্পন্নতা এবং ব্যর্থ হওয়ারও অনেক উদাহরণ আছে।
রাজার যেসব কর্ম ইতিহাসে তুঘলকি কাণ্ড হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে-
জঙ্গলে শিকার করতে গিয়ে একদিন দরিদ্র এক কৃষকের সন্তানের উপর আঘাত করে বসেন রাজা তুঘলক। এরপর তিনি অনুতপ্ত হয়ে সেখানকার কাজির কাছে তার বিচার করতে বলেন। বিচারের রায়ে ওই কৃষকের সন্তান রাজার শরীরে বেত্রাঘাত করেন। হাসি মুখে বেত্রাঘাত সহ্য করেন রাজা।
ভাবছেন কতটা দয়ালু ছিলেন তিনি! যেমন দয়ালু ছিলেন রাজা; ঠিক তেমনই হিংস্র ছিলেন। তার আড়ালে কেউ যদি বিদ্রোহ করা কথা ভাবত, মুহূর্তেই ষড়যন্ত্রকারীকে হত্যা করে তার মৃতদেহ প্রাসাদের বাইরে ঝুলিয়ে রাখা হত।
কখনো আবার তিনি অভিযুক্তদের হাত-পা বেঁধে ছুঁড়ে দিতেন হিংস্র হাতির পালের সামনে। তারা মুহূর্তেই পিষে মানুষগুলোকে হত্যা করত। জানা যায়, দিল্লিকে তিনি জনমানবহীন করে ফেলেছিলেন। সামান্য অপরাধেই মানুষের প্রাণ নিতেন তিনি।
তার শাসন আমলেই মরোক্কোর বিশ্ববিখ্যাত ভ্রমণকারী ইবন বতুতা তার সম্রাজ্য ভ্রমণ করেন। তিনি এই পাগলা রাজার সম্পর্কে বলেন, ‘দিল্লি নগরী মরুভূমিতে পরিণত হয়েছিল সে সময়। সুলতানের আদেশ পালনে ব্যর্থ হওয়ায় এক পঙ্গু ব্যক্তিকে বেলিস্তার সাহায্যে নিক্ষেপ করা হয় এবং একজন অন্ধ ব্যক্তিকে দিল্লি থেকে দৌলতাবাদে টেনে নিয়ে যাওয়া হয়।’
কথিত আছে, একবার প্রজারা তার নামে কটূ কথা রটাতে শুরু করে। সুলতান তুঘলক ক্ষিপ্ত হয়ে ৩ দিনের মধ্যে দিল্লি থেকে সব প্রজাদেরকে বের করে দেন। সময়সীমা পার হওয়ার পরেও যারা ছিল; তাদেরকে হত্যা করা হয়।
পুরো শহর যখন ফাঁকা; সুলতান প্রাসাদের ছাদে উঠে যখন কোথাও মানুষ কিংবা আগুন জ্বলতে না দেখে বলেন, ‘এখন আমার মন শান্ত হয়েছে, রাগ কমেছে।’ সুলতান মুহম্মদ বিন তুঘলকের রাজত্বকালে এসব ঘটনা ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ও সাধারণ বিষয়। তার এসব খামখেয়ালিপনা একসময় ‘তুঘলকি কাণ্ড’ বলে প্রকাশ পেতে থাকে জনমুখে।
মুহাম্মদ বিন তুগলক ১৩৫১ সালে বর্তমান পাকিস্তানের সিন্ধু রাজ্যের ঠাট্টা অঞ্চলে সুমরু গোষ্ঠির সঙ্গে যুদ্ধকালে মৃত্যুবরণ করেন। তার জীবিত থাকা অবস্থাতেই তার রাজ্যে ভাঙনের সূত্রপাত ঘটে।
জেএমএস/এমএস