যেভাবে ‘গয়নার কারিগর’ হলেন কানিজ
বেনজীর আহমেদ সিদ্দিকী
স্কুলের মাঠে সবাই যখন খেলাধুলা করতে কিংবা আইসক্রিম-চটপটি খেতে ব্যস্ত; তখন মাঠের একপাশে ভাবুক মনে বসে থাকতেন কানিজ। তার চোখ-মুখজুড়ে অন্যরকম কিছু করার স্বপ্ন সব সময় খেলা করত। এমন এক স্বপ্ন-বাস্তবতার দোলাচলে ভাসতে ভাসতে কানিজ মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরিয়ে ভর্তি হলেন স্নাতকে।
শুরুতেই মফস্বল থেকে ঢাকায় এসে জীবনের নানা কঠিন বাস্তবতার মুখে পড়তে হলো। কখনো থাকা-খাওয়া, কখনো পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়ানো আবার কখনো অর্থের জোগান; সব মিলিয়ে তার জীবন বেশ কঠিন হয়ে পড়ল। তবে এত সব কাঠিন্যের মাঝেও তিনি বিন্দুমাত্র ভুলে যাননি তার শৈশব-কৈশোরে দেখা স্বপ্নের কথা।
কলেজ গেটের সামনে বসে খালারা কেউ কাপড়, কেউ প্রসাধনী আবার কেউ খাবার বিক্রি করেন। চলতে চলতে এসব প্রতিদিন দেখেন আর নিজের স্বপ্নকে খুঁজতে থাকেন। এর মাঝে একদিন তার চোখে পড়ে যায় বেশ বয়স্ক একজন খালা। যিনি বাঁশ, বেত ও কড়িমাটি দিয়ে তৈরি গলার মালা, কানের দুল বিক্রি করছেন।
একদিন বুকে দুরুদুরু কাঁপুনি আর চোখে স্বপ্নপূরণের হাতছানি নিয়ে কানিজ তার খালাকে জিজ্ঞাসা করেন, এগুলো সে কোথা থেকে সংগ্রহ করেন, দাম কেমন পড়ে, আরও নানাবিধ প্রশ্ন। গয়না বিক্রেতা খালা নতুন প্রতিযোগী ভেবে তেমন কিছুই বললেন না। তবুও কানিজের নতুন উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন, গয়নার খুটিনাটি খুঁজে বের করার আগ্রহ জন্মায়।
এর মাঝে ভালোবেসে পরিবারের সম্মতিতেই একদিন বিয়ে করে ফেলেন কানিজ। নারী হিসেবে জীবনের নতুন আরেক অধ্যায় ও চ্যালেঞ্জের মাঝে এসে পড়েন তিনি। এসবের মাঝেই সে স্বামীর উৎসাহে খুব স্বল্প পুঁজি নিয়ে অনলাইনে গয়নার ব্যবসা শুরু করে দেয়। শুরুটা বেশ কঠিন হলেও পরে বিষয়টি তার জন্য সহজ হয়ে যায়।
কারণ ততদিনে সে পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে বেসরকারি একটা প্রতিষ্ঠানের মানব সম্পদ উন্নয়ন বিভাগে চাকরি শুরু করে দিয়েছে। এর পাশাপাশি সে অনলাইনে গয়নার পেজেও খানিকটা সময় দিতে পারছেন। চাকরি করার সুবাদে সে বিনিয়োগও আগের চেয়ে ভালো করতে পারছে।
শুরুর কিছুদিন অনেকের দেখাদেখি বাজার থেকে প্রচলিত গয়নাগুলো কিনে ছবি তুলে ফেসবুক পেজে আপলোড দিয়ে বা বুস্ট করে মোটামুটি ভালোই বিক্রি করতেন। এভাবেই তার ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্নটা আস্তে আস্তে বড় হচ্ছিল। হঠাৎ একদিন কানিজ বুঝতে পারেন, তিনি মা হতে চলেছেন।
বাচ্চা হওয়ার পর জীবনের বেশ কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে তাকে পড়তে হলো। বাচ্চাকে ঠিকভাবে লালন-পালন করতে গিয়ে একসময় চাকরিটাও ছেড়ে দিতে বাধ্য হলেন কানিজ। এদিকে একেবারেই কম সময় দেয়ায় গয়নার ব্যবসাও ততদিনে থমকে গেছে। তখন মাসে বলতে গেলে অর্ডারই হতো না।
এমন এক কঠিন পরিস্থিতিতে প্রচণ্ড হতাশা তাকে ঘিরে ধরল। বারান্দার গ্রিল ধরে বাচ্চাকে কোলে নিয়ে রাতের নিভু নিভু তারাদের দিকে তাকিয়ে চোখের জল ফেলতেন। এমনই এক রাতে কানিজ নিজেকেই প্রশ্ন করলেন, স্বপ্নকে বাঁচানোর জন্য প্রাণপণে এগিয়ে চলবে না-কি নিজেকে আটকে নেবে জীবনের শৃঙ্খলে।
নিজের সঙ্গে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা নিয়ে আবার তিনি আগের মতোই কাজ শুরু করলেন বাজারের তৈরি প্রচলিত গয়না নিয়ে। কিছুদিন পরই তার মনে হলো, এগুলো তো সব জায়গায় পাওয়া যায়, তাহলে তার গয়না এবং অনলাইন পেজের বিশেষত্ব কি? ভেবে কোনো কূল-কিনারা খুঁজে পেলেন না! এমনকি দেশের বাইরে থেকেও গয়না আনা শুরু করলেন। তাতেও তার মনে ঠিক সেভাবে দাগ কাটল না। তারপরই ঠিক করলেন নিজেই গয়না বানাবেন! বললেই কি হলো? এত সহজেই কি গয়না বানানো যায়?
এরই মাঝে স্বামী, সংসার, বাচ্চা সামলে শুরু করলেন রাত জেগে গয়না নিয়ে সব ধরনের পড়াশোনা এবং গয়না বানানোর পদ্ধতি দেখার কাজ। অভিজ্ঞ গয়না প্রস্তুতকারকদের পাশে গিয়েও বাচ্চাকে কোলে নিয়ে ব্যবহারিক অভিজ্ঞতা নেওয়া শুরু করলেন। কোন উপাদানটা ভালো, কোনটা কার সঙ্গে যায়, কোনটা কেমন টেকসই, রাত-দিন এক করে প্রথম কয়েক মাস এসব জানার চেষ্টা করলেন।
তারপর সাহস নিয়ে দু-একটি করে গয়না বানানো শুরু করলেন কানিজ। ডিজাইনের নতুনত্ব, মানসম্মত ও টেকসই উপাদান এবং গ্রাহকদের নাগালের মধ্যে মূল্য থাকায় নতুন করে সাড়া পেতে শুরু করল কানিজের স্বপ্ন ‘ফাইন ব্লেন্ড বাই কানিজ’। যা শুধু তার হাতে বানানো অভিনব গয়নাগুলোর মাধ্যমে আগ্রহী ক্রেতাদের গয়নার শখ পূরণে দারুণ ভূমিকা রাখছে।
কানিজের স্বপ্ন একদিন সবাই তাকে গয়নার একজন দক্ষ ও মানসম্পন্ন কারিগর হিসেবে চিনবে। পাশাপাশি তিনি এখন স্বপ্ন দেখেন, একটা জুয়েলারি হাউস খোলার এবং সফল একজন উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেকে সমাজে সবার মাঝে তুলে ধরার।
জেএমএস/এসইউ/জেআইএম