ব্যর্থতা থেকে জান্নাতের ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প
সাজেদুর আবেদীন শান্ত
ফেসবুকে তিনি ‘অপরাজিতা জান্নাত’ নামেই বেশি পরিচিত। তার উদ্যোগের নাম ‘অপরাজিতা’। দেশি পণ্যকে তুলে ধরার প্রয়াস তার। অপরাজিতা এ নারীর পুরো নাম জান্নাতুল ফিরদাউস। বাবা ব্যবসায়ী আবু জাহির, মা সুলতানা সুফিয়া। জন্ম এবং বেড়ে ওঠা সিলেটের হবিগঞ্জে। পূর্বপুরুষ পারিবারিকভাবে ব্যবসায়ী ছিলেন; তাই ছোটবেলা থেকেই ব্যবসার সাথে পরিচিত তিনি। পাঁচ বোন, এক ভাইয়ের মধ্যে তিনি তৃতীয়।
জান্নাতুল বলেন, ‘আমার ভাই সবার ছোট। আমাদের বড় ভাই ছিল না। তাই বাবাকে সব কিছু একা সামলাতে হতো। দু’জন কর্মচারী থাকা সত্ত্বেও বাবার একজন বিশ্বস্ত লোকের প্রয়োজন ছিল। তখন আমার বয়স মাত্র ৮ বছর। একদিন একা একা বাবার দোকান দেখতে গিয়েছিলাম। বাবা আমাকে দেখে অনেক খুশি হন এবং ক্যাশ কাউন্টারে বসিয়ে দেন। তখন টুকটাক হিসাব জানতাম। বাবার কাছ থেকে কী করে পোশাক ভাঁজ করতে হয়, এগুলো শিখতাম। এভাবেই আমার ব্যবসার হাতেখড়ি।’
তিনি বলেন, ‘এভাবে প্রায় ৮ বছর বাবার সাথে কাজ করি। এমনকি বাবা যখন অসুস্থ; তখন পুরো দোকান সামলেছি। যখন মাধ্যমিকে পড়ি; তখন কাজ করা সম্ভব হচ্ছিল না। কারণ আমি একজন মেয়ে আর সামনে এসএসসি পরীক্ষা। সবদিক চিন্তা করে আমি ব্যবসার কাজ থেকে সরে আসি। এর একবছর পর আমার বাবা দোকানটি ছেড়ে দেন। দোকানের সম্পূর্ণ মালামাল বিক্রি করে ফেলেন।’
জান্নাত বলেন, ‘দীর্ঘ ৩৫ বছর ব্যবসা করার পরও বাবা মাঝে মাঝে আক্ষেপ করে বলতেন, আমার মেয়েটা যদি আজ ছেলে হতো, তবে হয়তো আমার ব্যবসাটা আজ টিকে থাকত। বাবার সেই আক্ষেপ আর ব্যবসার প্রতি ভালোবাসা থেকেই মূলত ব্যবসায় কিছু একটা করার চিন্তা-ভাবনা করি। বাবার ইচ্ছে ছিল, আমি ঢাকায় পড়াশোনা করি। তাই ২০১৬ সালে ঢাকার লালমাটিয়া মহিলা কলেজে ব্যবস্থাপনা বিভাগে ভর্তি হই।’
দাম্পত্য জীবন সম্পর্কে অপরাজিতা জান্নাত বলেন, ‘১ম বর্ষের ফরম ফিলাপের আগের দিন পারিবারিকভাবে আমার বিয়ে হয়। স্বামী এমদাদুল হক রুবেল পেশায় একজন ইঞ্জিনিয়ার। তারপর থেকে মূলত উদ্যমী জীবন শুরু। বিয়ের পর হোস্টেল ছেড়ে নতুন জীবন শুরু। ছোট একটা বাসা নিয়ে সংসার আমাদের। এরই মধ্যে ১ম বর্ষের ফলাফল প্রকাশ হয়, আমি ফার্স্ট ক্লাস পাই।’
তিনি আরও বলেন, ‘ক্যাম্পাস থেকে বাসা দূরে হওয়ায় রেগুলার ক্লাস করা সম্ভব হয়নি। তাই বাসায় বসে না থেকে আমি চিন্তা করি চাকরি করব। স্বামীর মতামত নিয়ে একটি প্রাইভেট অফিসে জয়েন করি। কিন্তু পড়াশোনা, অফিস, সংসার সবকিছু সামলানো চ্যালেঞ্জিং হয়ে যাচ্ছিল। তখন ফ্রি টাইমে আমি বিভিন্ন নারী উদ্যোক্তার গল্প শুনতাম। এরপরই স্বপ্ন দেখতে শুরু করি ব্যবসা করার।’
ব্যবসা শুরুর গল্প জানাতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘স্বামীর উৎসাহে বাবা, স্বামী ও নিজের কিছু জমানো টাকা নিয়ে বাসার কাছে একটি দোকান ভাড়া করেন। ডেকোরেশনের কাজ শেষে সেখানে তিনি মেয়েদের ড্রেসসহ অন্যান্য আইটেমের পোশাক তোলেন। যেহেতু এটি মেয়েদের দোকান ছিল এবং সুন্দর সুন্দর কালেকশন ছিল; তাই খুব অল্প সময়ের মধ্যেই এলাকায় ভালো পরিচিতি পাই।’
জান্নাত বলেন, ‘এভাবে যখন একটু একটু করে দোকানটি বড় হচ্ছিল; তখনই বেবি কনসিভ হয়। আমাদের প্রথম সন্তান যেহেতু; তার প্রতি আমাদের অন্যরকম একটা ভালোলাগা কাজ করছিল। কিন্তু অন্যদিকে আমার স্বপ্ন কেবলমাত্র যাত্রা শুরু করেছে। সেই মূহূর্তে সিদ্ধান্ত নেওয়াটা আমার পক্ষে খুবই কষ্টকর ছিল। স্বামীর কথা ভেবে, সন্তানের কথা চিন্তা করে ব্যবসার পরিকল্পনা স্থগিত করি।’
প্রতিবন্ধকতা সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আসলে প্রতিটি মানুষের জীবনেই কিছু স্বপ্ন থাকে। সেই স্বপ্ন যদি চোখের সামনে ভেঙে যায়; তখন সেই পরিস্থিতিটা যে কতটা কষ্টের, সেটা আমি প্রথমবার উপলব্ধি করি। ডেকোরেশন ও মালামাল মিলিয়ে আমার লস হয়েছিল প্রায় লক্ষাধিক টাকা। মানসিকভাবে যে ক্ষতি হয়েছিল, তা ছিল অনেক বেশি। নিজেকে তখন শুধু ব্যর্থ মনে হতো। ডিসেম্বরের ৬ তারিখে আমার ছেলের জন্ম হয়। ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে একটি কথা মনে হতো, একজন উদ্যোক্তা হিসেবে আমি ব্যর্থ হলেও একজন মা হিসেবে আমি সফল।’
ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প বলতে গিয়ে জান্নাত বলেন, ‘ফ্রেব্রুয়ারিতে আমার ফাইনাল পরীক্ষা শুরু হয়। মার্চ মাসে যখন করোনার প্রকোপ বেড়ে যায়, তখন চারটি পরীক্ষা স্থগিত রেখে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। অন্যদিকে স্বামীর অফিস কার্যক্রমও বন্ধ ছিল। ওই সময়ে আমার স্বামী বলতেন, তুমি ঘরে বসে কাজ করা যায় এমন কিছু একটা চিন্তা করো। কিন্তু সেই সময়ে আমার মন-মানসিকতা এতটাই দুর্বল ছিল যে, আমি কিছু ভাবতে পারছিলাম না। তখন আমার একজন শিক্ষকের কথা মনে পড়ে যায়, তিনি ইকবাল বাহার জাহিদ স্যার। যিনি সব সময় বলতেন, স্বপ্ন দেখুন, লেগে থাকুন, সফল হবেন। স্যারের এ উক্তি আমার মনোবলকে জাগিয়ে তোলে।’
তিনি বলেন, ‘কিন্তু অনলাইনে কিভাবে শুরু করবো বুঝতে পারছিলাম না। সেই মূহূর্তে আরও একজন শিক্ষকের দেখা পাই। তিনি রাজীব আহমেদ স্যার। যিনি বলেন, পার্সোনাল ব্রান্ডিংয়ের দিকে গুরুত্ব দিতে। স্যারের কথা অনুযায়ী আমার মনে হলো, আমার আগে নিজেকে ব্রান্ডিং করতে হবে। আমার ফেসবুক ফ্রেন্ডরা সবাই যেহেতু আমার পরিচিত ছিলেন; সেক্ষেত্রে আমি নতুন করে আবার সবার সাথে পরিচিত হওয়া শুরু করলাম। আমার আত্মীয়-স্বজন এবং বন্ধু-বান্ধবদের সাথে যোগাযোগ বাড়িয়ে দিলাম।’
স্বপ্নের হাতছানি সম্পর্কে জান্নাত বলেন, ‘তারপর একদিন আমার একজন ফেসবুক ফ্রেন্ড আমাকে নক করলেন কিছু ড্রেস কেনার জন্য। কারণ তিনি জানতেন আমার নিজের একটা শপ আছে। আমার কাছে যেহেতু ড্রেস কালেকশন ছিল না, তাই আমি আমার একজন ফ্রেন্ডের কিছু ড্রেস কালেকশন তাকে দেখাই। তিনি সেখান থেকে ২ হাজার টাকার ব্লক এবং স্ক্রিন প্রিন্ট ড্রেস অর্ডার করেন। অর্ডারটা আমার ফ্রেন্ডকে কনফার্ম করার পর, সে এগুলো পাঠিয়ে দেয়। ড্রেস হাতে পেয়ে আমার সেই কাস্টমার ফ্রেন্ড অনেক খুশি হন। সেই অর্ডারে আমার লাভ ছিল মাত্র ৮০ টাকা। কিন্তু আনন্দ ছিল এত বেশি যে, আমার মনে হয়েছিল আমি কোটি টাকা হাতে পেয়েছি। কারণ তিনি আমার প্রথম অনলাইন কাস্টমার ছিলেন।
তিনি আরও বলেন, ‘তখন যেহেতু আমি ঘুরে দাঁড়ানোর পথ খুঁজছিলাম। তার পরের দিন আমার একজন প্রিয় বান্ধবীর সাথে বিষয়টি শেয়ার করি। সে তখন আমার কথা শুনে কালেকশনগুলোর ছবি দেখার আগ্রহ প্রকাশ করেন। আমি তাকে ছবিগুলো দিলে সে সেখান থেকে ৫ হাজার টাকার পণ্য অর্ডার করে। আমি প্রডাক্ট কনফার্ম করে আমার সেই সেলার ফ্রেন্ডকে অর্ডার দিলে, তিনি সবগুলো প্রডাক্ট তার কাছ থেকে নেন। আমার যেহেতু নতুন ব্যবসা আর ব্যবসায় প্রতিশ্রুতি রক্ষা যেহেতু বড় বিষয়, তাই আমি প্রথমবার অল্প কিছু টাকার প্রডাক্ট স্টক করি এবং সেই বান্ধবীর চাহিদা অনুযায়ী তার ড্রেসগুলো পাঠিয়ে দেই। সেই বান্ধবী ড্রেসগুলো পেয়ে অনেক খুশি হন এবং তিনি আমাকে পরামর্শ দেন অনলাইনে একটা গ্রুপ খোলার জন্য।’
এরপর তিনি তার বান্ধবীর পরামর্শ অনুযায়ী একটি পার্সোনাল গ্রুপ খোলেন তার শপের নাম অনুযায়ী। গ্রুপের নাম দেন ‘অপরাজিতা’। একই নামে একটি পেইজও খোলেন তিনি। পেজ এবং গ্রুপ খোলার পর পরিচিতদের থেকে ভালো সাড়া পান। গ্রুপ খোলার পর দুই মাসে তার পোশাক বিক্রি হয় ১ লাখ টাকা। অথচ তখন গ্রুপের সদস্য ছিল মাত্র ২৫০ জনের কাছাকাছি। এভাবে গত ৪ মাসে শুধু গ্রুপ এবং পেজ থেকে জান্নাতুলের পণ্য বিক্রি হয় আড়াই লাখ টাকারও বেশি। এর মধ্যে ব্লক এবং স্ক্রিন প্রিন্টের ড্রেস বিক্রি হয়েছে ২ লাখ টাকা। তাই তিনি সিগনেচার প্রোডাক্ট হিসেবে ব্লকের শাড়ি তৈরি করেছেন।
এ ছাড়াও তার উদ্যোগে সামিল হয়েছেন প্রতিবশী থেকে শুরু করে আত্মীয়-স্বজন এবং বিভিন্ন সময়ের বন্ধু-বান্ধব। তার এ সফলতার সবচেয়ে বড় অংশীদার তার স্বামী। বাবা-মায়ের দোয়া এবং ভালোবাসা সব সময় জান্নাতুলকে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। তিনি এমন দু’জন শিক্ষকের সান্নিধ্য পেয়েছেন; যাদের প্রতিটি কথা এবং কাজ তার ব্যক্তিগত জীবন ও ব্যবসায়িক জীবনের চিন্তা-ভাবনাকে বদলে দিয়েছে।
লেখক: শিক্ষার্থী, বঙ্গবন্ধু কলেজ, ঢাকা।
এসইউ/এমএস