নারীদের ভরসার জায়গা এখন অলোকাপুরি
দিগন্তজোড়া সবুজ-শ্যামল বিস্তীর্ণ বিল। বিলের একপ্রান্তে কয়েকটি কুঁড়েঘর। এ কুঁড়েঘর নিয়ে গড়ে উঠেছে অলোকাপুরি। অলোকাপুরি একটি স্বেচ্ছাসেবী মহিলা সমিতি। সব বাধা-বিপত্তি এড়িয়ে গ্রামীণ জনপদে নারীদের আত্মনির্ভরশীল হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষে অবিরাম কাজ করছে সংগঠনটি।
নড়াইল ও যশোর জেলার সীমান্তবর্তী ১১টি গ্রাম নিয়ে এগারখান। হিন্দু অধ্যুষিত এলাকার সংগঠনটি শনিবার দিনব্যাপী সমবায়ী আড্ডার আয়োজন করে। সমবায়ী আড্ডার নামে দেওয়া হয় নারীদের প্রশিক্ষণ। প্রায় ৫০ জন নারী সদস্য এ আড্ডায় অংশগ্রহণ করেন। প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণকারীদের মনোসংযোগসহ উজ্জীবিত রাখতে প্রশিক্ষক মাঝেমধ্যে মজার মজার শিক্ষণীয় ম্যাজিক, উন্নয়নের গল্প, কবিতা শোনান।
প্রশিক্ষক অংশগ্রহণকারী ৫০ জন নারীর মধ্যে মাটির ব্যাংক (প্লাস্টিকের) দেন। যে ব্যাংকে নারীরা প্রতিদিন তাদের সামর্থ অনুযায়ী সংসার খরচের একটি অংশ জমা রাখবেন। সমিতিকে বড় করে গড়ে তুলতে বছর শেষে ৫০ জনের সঞ্চয়ী অংশটি এক জায়গায় জড়ো করে উন্নয়নমূলক কাজে ব্যয় করবেন। এতে সমিতির সদস্যদের উন্নতি হবে।
বাংলাদেশ সমবায় একাডেমি কুমিল্লার যুগ্ম নিবন্ধক অধ্যক্ষ হরিদাস ঠাকুর নারীদের প্রশিক্ষণ দেন। অলোকাপুরির প্রতিষ্ঠাতা বনানী বিশ্বাস এ আড্ডায় সভাপতিত্ব করেন। দুপুরে ৩৮ প্রকারের রান্না করা ভেষজ খাবার পরিবেশন করা হয়। সমিতির সদস্যদের নিজ নিজ বাড়ি থেকে একেক প্রকারের খাবার রান্না করে আনতে হয়।
শেষে আয়োজন করা হয় মতুয়া অনুষ্ঠান। বিভিন্ন এলাকা থেকে নারী-পুরুষের দল জয় ঢাক বাজিয়ে নেচে-গেয়ে ‘হরিবল হরিবল’ ধ্বনিতে জড়ো হতে থাকেন অনুষ্ঠানস্থলে। একপর্যায়ে অলোকাপুরি হয়ে ওঠে আনন্দপুরি।
জানতে চাইলে বনানী বিশ্বাস বলেন, ‘অবহেলিত এবং অনুন্নত এ জনপদের নারীরা ভোর থেকে রাত পর্যন্ত সংসার জীবনের ঘানি টানতে টানতে নিজেদের বিলিয়ে দিচ্ছেন। পরিশ্রমের কারণে অনেক সময় শারীরিক এবং মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলছেন। মায়ের সঙ্গে মেয়েরাও লেখাপড়ার পাশাপাশি সংসারের কাজ করে চলেছেন। অথচ এদের মধ্যে বিনোদনমূলক কোনো কর্মকাণ্ড নেই। নেই সঞ্চয়ী মনোভাব।’
তিনি বলেন, ‘একঘেয়েমিকে দূর করতে এলাকার মেয়ে এবং নারীদের সংগঠিত করে গড়ে তোলা হয়েছে অলোকাপুরি। এখানে সমাজ উন্নয়নের পাশাপাশি আত্মনির্ভরশীল হিসেবে গড়ে তুলতে নানা ধরনের আড্ডাসহ প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। মেয়েদের নিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে ‘ইয়োলো গ্যাং’ নামে একটি সংগঠন। এ সংগঠনের মেয়েদের বিভিন্ন খেলাধুলার চর্চা, সংগীত, কবিতা আবৃত্তি, নাচ, উপস্থিত বক্তব্য, অনুষ্ঠান পরিচালনা, সামাজিক বনায়নের ওপর দক্ষতা সৃষ্টির প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।’
ইয়োলো গ্যাংয়ের সদস্য সন্ধ্যা রানী ও শ্রুতি রানী বলেন, ‘এতদিন আমরা শুধু লেখাপড়ার পাশাপাশি সংসারের কাজ-কর্ম করে এসেছি। বনানী দিদি পাশে এসে না দাঁড়ালে আমরা বুঝতে পারতাম না, শুধু সংসারের কাজ-কর্ম আর লেখাপড়াই নয়; এর বাইরেও আরেকটি জগৎ আছে।’
তারা বলেন, ‘আমরা গ্রামের রাস্তার দু’পাশে তালগাছ লাগিয়েছি। তখন অন্য মেয়েরা নেচে-গেয়ে আমাদের উৎসাহ জুগিয়েছে। অনেকে রাস্তায় সাইকেল চালিয়ে সাহস জুগিয়েছে। যে সাইকেল চালাতে জানে না, তাকে চালানো শিখিয়েছে। নাচ, গান, কবিতা আবৃত্তি, বক্তব্য দেওয়ার সাহসসহ কত কিছুই না শিখতে পেরেছি। খুবই মজা করছি এখন।’
খুলনা শেখ আবু নাসের বিশেষায়িত হাসপাতালের পরিচালক বিধান গোস্বামী বলেন, ‘এগারখান এলাকায় নারী জাগরণে বনানী বিশ্বাস বিশেষ ভূমিকা রেখে চলেছেন। তার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় এলাকার নারী-পুরুষ উজ্জীবিত হচ্ছে। অবহেলিত এ জনপদের মানুষ অলোকাপুরির নানাবিধ কর্মকাণ্ডে যুক্ত হয়ে নিজেদের স্বাবলম্বী হিসেবে গড়ে তুলতে সক্ষম হচ্ছে। এগিয়ে চলেছে এগারখানের অলোকাপুরি।’
হাফিজুল নিলু/এসইউ/পিআর