ভিডিও EN
  1. Home/
  2. ফিচার

করোনাকালে পাঁচ শিক্ষার্থীর মানবতার গল্প

ফিচার ডেস্ক | প্রকাশিত: ০৯:৪৬ এএম, ১৯ অক্টোবর ২০২০

মো. মেহেদী হাসান

আমরা চাই আশেপাশের দুঃখী, অসহায় মানুষকে সাহায্য করতে। তবে ব্যাপারটা কিন্তু এত সহজও নয়। সহজ নয় কথাটি এ জন্য বলা যে, মানুষের সদিচ্ছার অভাব আজকাল। আবার অনেককেই পাওয়া যায়, লোক দেখানো সহযোগিতা করতে। ফেসবুক-ইউটিউবের এ যুগে দুস্থ ও অসহায় মানুষকে দান করা এবং তাদের পাশে সহযোগিতার জন্য দাঁড়ানোর ঘটনা- এসব মাধ্যমে প্রচার করে খুব সহজেই দানবীর ও মানবতার কাণ্ডারি উপাধি পাওয়া যায়! তবে করোনার এ সংকটকালে এরকম মৌসুমী মানবতার কাণ্ডারিদের দেখা মিলছে না।

জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দান আর সহযোগিতার সেলফি তোলার সাহস এরকম মানবতার কাণ্ডারিদের নেই। তবে এর ব্যতিক্রম দেখা গেছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচ তরুণের মাঝে। তারা হলেন- ১২তম ব্যাচের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের কনিক স্বপ্নীল, ১৩তম ব্যাচের ব্যবস্থাপনা বিভাগের মোহন আলী, ১৪তম ব্যাচের ব্যবস্থাপনা বিভাগের রাফসান রাজু, ১৪তম ব্যাচের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের ফারহান আহমেদ রাফি ও ১৫তম ব্যাচের হিসাববিজ্ঞান বিভাগের মো. মেহেদী হাসান। করোনার প্রাদুর্ভাবে বিশ্ববাসীর মতো আমাদের দেশের মানুষও স্বাস্থ্য-অর্থনৈতিক ঝুঁকিতে রয়েছে। বহু মানুষ চাকরি হারিয়েছে। বিপদে পড়েছে মেসে থাকা কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।

এসব শিক্ষার্থীদের অনেকেই টিউশনি করে মেসের ভাড়াসহ নিজের পড়াশোনার খরচ চালাত। একদিকে কোভিড-১৯ আর অন্যদিকে টিউশনি বন্ধ থাকায় এসব শিক্ষার্থীর দুর্ভোগের শেষ নেই। মেসের বকেয়া নিয়ে বেশ কিছু অপ্রীতিকর ঘটনাও ঘটেছে বিচ্ছিন্নভাবে। এ অবস্থায় এসব শিক্ষার্থীর বইপত্রসহ অন্যান্য মালামাল বাড়িতে নিয়ে যাওয়া বেশ কষ্টসাধ্য ছিল। তার ওপর চলছিল লকডাউন। বিপদ আর আতঙ্কে দূরপাল্লার যাতায়াতে অতি গুরুত্বপূর্ণ একাডেমিক কাগজপত্র হারিয়ে যাওয়ারও সংশয় ছিল। আবাসিক হল না থাকায় এ সমস্যা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের যেন একটু বেশিই।

এ অবস্থায় এগিয়ে আসে পাঁচ শিক্ষার্থীর দলটি। আর দলটিকে সুসংগঠিত করেন কনিক স্বপ্নিল। তারপর থেকে শুরু এদের মানবতার গল্প। বিপদে থাকা এসব অসহায় শিক্ষার্থীদের মালামাল রাখার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর নিউটন হাওলাদারের সহযোগিতায় ধোলাইপাড় সংলগ্ন দনিয়া বাজার এলাকায় একটি ফ্ল্যাট ভাড়া করা হয়। এরপর থেকে করোনাভাইরাসের ঝুঁকি মাথায় নিয়ে প্রতিদিন দলটি বেরিয়ে পড়ে বিভিন্ন এলাকায় বিপদে পড়া শিক্ষার্থীদের খোঁজে।

তারপর তাদের মালামাল প্যাকিং করে প্যাকেটের গায়ে ডিপার্টমেন্ট, ব্যাচ আর রোল লিখে নিয়ে রাখা হয় দনিয়া বাজারের সেই ফ্ল্যাটে। শুধু এখানেই থেমে থাকেনি পাঁচ তরুণের দলটি। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠিত সাবেক বড় ভাইদের কাছ থেকে চাঁদা তুলে ছাত্রছাত্রীদের মেসের বকেয়া ভাড়া পরিশোধের ব্যবস্থাও করে। বড় রকমের দুশ্চিন্তা থেকে বেঁচে যায় মেস ভাড়া নিয়ে সংকটে পড়া ছাত্রছাত্রীরা। তাদের বকেয়া মেস ভাড়া মিটিয়ে প্রয়োজনীয় মালামাল সুরক্ষিত জায়গায় রাখার সুযোগ পেয়ে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলছে।

এরকম সমস্যায় পড়া ম্যানেজমেন্ট বিভাগের ১৫তম ব্যাচের শিক্ষার্থী মাহিরা খান মিতা বলেন, ‘তারা আমাদের মেসের নয় হাজার টাকা বাড়িওয়ালার সাথে কথা বলে কনসিডার করার ব্যবস্থা করেছে। তাদের এরকম সাহায্য পেয়ে আমরা খুব খুশি। তারা ছাড়া ঢাকা শহরে আমাদের হেল্প করার মতো আর কেউ ছিল না। তাদের ধন্যবাদ দিয়ে শেষ করা যাবে না।’ শুধু মিতা নয়, খোঁজ নিয়ে এরকম অসংখ্য শিক্ষার্থী পাওয়া গেছে। যাদের এরকম সাহায্য করেছে দলটি।

এ সম্পর্কে কনিক স্বপ্নিল বলেন, ‘করোনার মধ্যে মেসে থাকা আর টিউশনি করে চলা শিক্ষার্থীরা চরম বিপদের মধ্যে রয়েছে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী হিসাবে এসব শিক্ষার্থীর পাশে দাঁড়ানো আমাদের নৈতিক দায়িত্ব ও কর্তব্য। একজন ছাত্রলীগ কর্মী হয়ে এ সময় সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের সমস্যাগুলো সমাধান করার চেষ্টা করা সাংগঠনিক কর্তব্যও।’

বর্তমান প্রেক্ষাপটে ছাত্রলীগকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করার খারাপ অনুশীলনের সময় কনিকের এমন কথায় আশার আলো দেখা যাচ্ছে। এমন ব্রতই যে কাম্য প্রত্যেক ছাত্রলীগ কর্মীর। কনিক স্বপ্নীল, আলমগীর হৃদয়, রাফসান রাজু, মোহন আলীর মত ছাত্রলীগ কর্মীই যে আমাদের দেশে দরকার। কারণ তারা এখন পর্যন্ত মোট ১১২ জন ছাত্রছাত্রীর মেস ভাড়া সংকট নিরসন করে তাদের মালামাল রাখার ব্যবস্থা করেছে পাঁচ শিক্ষার্থীর দল।

এ পাঁচ তরুণের মতো সেবার ব্রত ছড়িয়ে পড়ুক প্রতিটি ছাত্রসংগঠনের কর্মীদের মাঝে, এটাই আমাদের কামনা। তারা বুঝিয়ে দিয়েছেন, ছাত্রলীগ মানেই স্লোগান আর মহড়া নয় বরং সময়ের প্রয়োজনে সাধারণ অসহায় মানুষের পাশে নিস্বার্থভাবে দাঁড়ানো। ভুলে গেলে চলবে না, দেশের সবচেয়ে পুরোনো ঐতিহ্যবাহী এ ছাত্রসংগঠনের জন্ম হয়েছিল এ দেশের মানুষের রাজনৈতিক অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে, বাঙালির মুক্তির সনদ আদায়ের জন্য। ইতিহাসেই এর প্রমাণ মেলে। ছাত্রাবস্থায় মানবসেবার এরকম ব্রত লালন করে রাখা ছাত্রলীগ কর্মীই এদেশে দরকার। তারাই হবেন ভবিষ্যতের লোভ-লালসা বিহীন আদর্শ নেতা।

ছাত্রলীগের সেইসব গৌরবময় ইতিহাসের পথে জবিয়ান এ পঞ্চপাণ্ডবের বিচরণে শুভ ভাবনার উদয় হচ্ছে জনমনে। বিশ্ববিদ্যালয় জীবন জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়। সব কিছুকে জয় করার সময়। জাগ্রত হোক শুদ্ধ মানবতার, উদ্রেক হোক স্বদিচ্ছার। ছাত্রসংগঠনের সাথে জড়িত থাকা আর না থাকা সব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর হৃদয়ে প্রবলভাবে বেজে উঠুক বিখ্যাত সংগীতশিল্পী ভুপেন হাজারিকার কালজয়ী সেই গান, ‘মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য, একটু সহানুভূতি কি মানুষ পেতে পারে না ও বন্ধু।’

লেখক: সায়েন্টিফিক অফিসার, বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন।

এসইউ/এএ/জেআইএম

আরও পড়ুন