আবর্জনা সরিয়ে করা হলো ফুলের বাগান!
মামুন সোহাগ
তিতুমীর কলেজের সীমানা প্রাচীর ঘেঁষে থাকা ফুটওভার ব্রিজের নিচে মল-মূত্রের উৎকট গন্ধ। সারাদিন পথচারীরা মূত্রত্যাগ করে। প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেওয়াটাই যেখানে মুখ্য। হাঁটতে গেলে দম বন্ধ হয়ে আসে। এজন্য নাক সিটকে প্রতিদিন ক্লাসে যেতে হয় শিক্ষার্থীদের। নগরীর বিভিন্ন স্থানে যত্রতত্র মুত্রত্যাগ পথচারীদের রোজকার অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর যেকোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সামনে এসব দৃশ্য দৃষ্টিকটু।
এখানে মল-মূত্র ত্যাগকারীদের অধিকাংশই রিকশাচালক, সিএনজিচালক বা ভ্যানচালক। অনেকে গাড়ি থামিয়ে প্রস্রাব করেন এসব স্থানে। এত বেশিসংখ্যক লোক এখানে মূত্রত্যাগ করেন, তা ড্রেন গড়িয়ে রাস্তায় চলে আসে। এতে পথচারী কিংবা শিক্ষার্থীদের ব্যাপক দুর্ভোগ পোহাতে হয়।
ফুটওভার ব্রিজের নিচে মূত্রত্যাগ বন্ধ করার জন্য তিতুমীর কলেজের সাধারণ শিক্ষার্থীরা নানা পরিকল্পনা হাতে নিয়েছিল। সব বাধা টপকে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। তবে ব্যক্তি উদ্যোগে আব্দুর রাজ্জাক নামে এক শিক্ষার্থী মূত্রত্যাগের স্থানে ফুলের বাগান করেছেন। সন্ধ্যার পরও যাতে কেউ প্রস্রাব করতে না পারে, সেজন্য সেখানে তিনি বৈদ্যুতিক তারের সংযোগ দিয়ে লাইটিংয়ের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন।
আব্দুর রাজ্জাক তিতুমীর কলেজের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। তিনি পড়াশোনার পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করে থাকেন। কিছু ব্যাপার মানুষের মনে নাড়া দেয়। ব্যথিত করে। নীরবে অনেকের খারাপ লাগে। সম্মিলিত উদ্যোগের অভাবে সফলতা আসে না। তবে তিতুমীর কলেজের এ শিক্ষার্থী একাই কাজ করে দেখিয়েছেন চেষ্টা করলেই সম্ভব।
আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘এ শহর আমার, এ দেশ আমার, পরিচ্ছন্ন রাখার দায়িত্বটাও আমার। পরিচ্ছন্নতা শুরু হোক আমার থেকেই। কোনভাবে যেন পরিবেশ নষ্ট না হয়, সেদিকে অবশ্যই খেয়াল করবেন। যেখানে-সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলবেন না। নির্দিষ্ট জায়গায় ভালোভাবে রাখুন। যাতে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। পথচারীরা রাস্তার আশেপাশে যেখানে-সেখানে প্রস্রাব করবেন না। কারণ রাস্তার পাশ দিয়ে ঠিকমতো হাঁটা যায় না।’
তিনি বলেন, ‘আমি খুবই আনন্দিত যে, খুব অল্প সময়ের মধ্যে এমন একটা কাজ করতে পেরেছি। বোঝাতে সক্ষম হয়েছি যে, যেখানে-সেখানে প্রস্রাব করা ঠিক না। মানুষের কাছে জায়গাটির সৌন্দর্য তুলে ধরতে চেষ্টা করেছি। গতবছর ডিসেম্বরের ১৭ তারিখে কাজ করার জন্য অনেককে বলেছি। সেদিন তেমন কাউকে পাশে পাইনি। শুধু রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ২য় বর্ষের নূর মোহাম্মদ সুমন আমার সাথে কাজ করেছে। অনেকেই বলেছিল, ‘যেও না, পারবা না করতে’। অথচ আমি করে দেখিয়েছি। আমরা পেরেছি।’
সরেজমিনে জানা যায়, তিতুমীর কলেজ সংলগ্ন ফুটওভার ব্রিজের দুধারে এখন সর্বসাকুল্যে ১৫০টিরও বেশি ফুলগাছ, পাতাবাহারসহ নানা রকম গাছে সমৃদ্ধ। সন্ধ্যার পরপরই জ্বলে ওঠে আলো। একদিকে বেড়েছে সৌন্দর্য, থেমেছে মূত্রত্যাগ। ফেসবুকের বিভিন্ন গ্রুপে গাছগাছালি প্রয়োজন শিরোনামে স্ট্যাটাস দিয়ে গাছ, টব, ব্যানারের অর্থ সংগ্রহ করেছেন আব্দুর রাজ্জাক। নিজেও যতটুকু পেরেছেন, দিয়েছেন। গাছ সংগ্রহ করতে বৃথা রায় দিপা এক গাছপ্রেমীর কাছে গিয়েছিলেন রাজ্জাক।
বৃথা রায় দিপা ফেসবুকে লেখেন, ‘তিতুমীর কলেজের সামনে ফুটওভার ব্রিজের নিচে অনেকটা জায়গা ভীষণরকম নোংরা হয়ে পড়েছিল। বৃক্ষপ্রেমী দুই উদ্যোমী তরুণ জায়গাটা পরিষ্কার করে সুন্দর বাগান করতে ব্রতী হয়েছে। ওরা গ্রীন বাংলাদেশে এ নিয়ে পোস্ট দিয়েছিল। সেখান থেকেই ওদের সম্পর্কে জানতে পারি। ওদের উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে আমি কিছু গাছ উপহার দেওয়ার কথা ওদের জানাই। আজ ওরা আমার বাগানে এসেছিল। ওদের কিছু গাছ উপহার দিয়েছি। যেন ওরা সুন্দর করে ওদের সড়ক-বাগানটি সাজাতে পারে।’
আব্দুর রাজ্জাকের এমন উদ্যোগে তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীদের কাছে প্রশংসিত হয়েছেন। ভবিষ্যতে তিতুমীর কলেজের পরিবেশ আরও সৌন্দর্যময় হবে, এমন প্রত্যাশা সবার। করোনাকালেও থেমে নেই এ বৃক্ষপ্রেমিক। লকডাউনের ছুটি পার করে ঢাকা ফিরেই আবার লেগে পড়েছেন গাছের পরিচর্যায়। ক্যাম্পাস বন্ধ। তাতে কি! কাজের প্রতি ভালোবাসা আর একাগ্রতাই যেন সব।
লেখক: শিক্ষার্থী, সরকারি তিতুমীর কলেজ ও গণমাধ্যমকর্মী।
এসইউ/এএ/পিআর