ধর্ষণ ও নারীর প্রতি সহিংসতা নিয়ে সাইকোলজি কী বলে
ডা. মাহাবুবা রহমান
নারীর প্রতি সহিংসতা বিশ্বের ইতিহাসে নতুন কিছু নয়। উনিশ শতকের সতীদাহ প্রথা থেকে শুরু করে একবিংশ সমাজের ডমেস্টিক ভায়োলেন্স, যুগে যুগে এভাবেই সহিংসতার রূপ বদলেছে। তবে সব যুগের সব সহিংসতার মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে বর্তমান যুগের ধর্ষণ। হ্যাঁ, ধর্ষণ শব্দটি নতুন কিছু নয়। তারপরও ‘বর্তমান যুগের ধর্ষণ’ বলার কারণ এখন প্রতিনিয়ত যেসব ধর্ষণের খবর পাচ্ছি- এতটা বিকৃত, এতটা পাশবিক যৌনাচারের খবর কি আগে কখনো শুনেছেন?
আগে কয়টা ধর্ষণের খবর এমন শুনতেন, যেখানে স্বামীকে আটকে রেখে স্ত্রীকে পালাক্রমে ধর্ষণ করা হয়? দুলাভাই তার নিজের ভাইদের নিয়ে শালীকে গণধর্ষণ করে? ৭২ বছরের বৃদ্ধা গোসল করতে গিয়ে ধর্ষিত হয়? সন্তানের বয়সী ছেলেরা মায়ের বয়সী নারীকে সম্পূর্ণ নগ্ন করে, উল্লাস করে, আঘাত করতে করতে ধর্ষণ করে?
এমন একটি দিন নেই; যেদিন সোশ্যাল মিডিয়া বা পত্রিকা খুললে একটি ধর্ষণের খবর পাওয়া যায় না। ক্রমবর্ধমান হারের এ অপরাধ সম্পর্কে অনেকের অনেক মত, কেউ বলেন সামাজিক অবক্ষয়, কেউ বলেন ক্ষমতার অপব্যবহার। কিন্তু নিকৃষ্টতম এ আচরণের মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা কী? একটু বোঝার চেষ্টা করি চলুন।
নারীর প্রতি সহিংসতার সাইকোলজি বুঝতে হলে আমাদের প্রথমে বুঝতে হবে ‘সহিংসতা’ বা সাইকোলজিতে আমরা যেটা পড়ে থাকি, ‘Aggression’ তার পেছনের তত্ত্ব ও ব্যাখ্যা। সাইকো অ্যানালাইসিসের জনক সিগমুন্ড ফ্রয়েড একটি সময় পর্যন্ত বিশ্বাস করতেন, মানবচরিত্রে জন্মগতভাবে একটি গুণ বিদ্যমান- যার অর্থ ভালোবাসা। এ ভালোবাসা আছে বলেই মানুষে মানুষে প্রেম হয়, তারা একে অপরের প্রতি আকর্ষণ বোধ করে, একসাথে থাকে, বংশবৃদ্ধি করে। মানবসভ্যতা টিকিয়ে রাখতে যার ভূমিকা অপরিহার্য। কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর যুদ্ধের ভয়াবহতা দেখে ফ্রয়েডের চিন্তাধারায় পরিবর্তন আসে। তিনি তখন দ্বিতীয় আরেকটি ড্রাইভের অবতারণা করেন, যার নাম দেন ‘থানাটস’।
থানাটস শব্দের অর্থ আত্মধ্বংসী মনোভাব। ফ্রয়েডের মতে, প্রতিটি মানুষের মাঝে জন্মগতভাবেই এ দুটি ড্রাইভ পাশাপাশি বিদ্যমান। মানবজাতি একইসাথে ভীষণ রকমের সৃষ্টিশীল এবং বিধ্বংসী। তার মতে, সময়ে সময়ে মানুষের এ বিধ্বংসী মনোভাব প্রকাশ করার প্রয়োজন হয়ে পড়ে। ঠিক যেমনইভাবে প্রয়োজন পড়ে তার ক্ষুধা, তৃষ্ণা এবং যৌন চাহিদা প্রকাশের।
পরবর্তীতে অনেক সাইকোলজিস্ট এবং সোশ্যিওলজিস্ট অ্যাগ্রেশন নিয়ে কিছু থিওরি দেন। উল্লেখযোগ্য থিওরিগুলো নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করছি-
ইন্সটিঙ্কট থিওরি: নাম শুনেই বোঝা যাচ্ছে, জন্মগতভাবে মানুষের মাঝে যে অ্যাগ্রেশন থাকে, সেটাই ইন্সটিঙ্কট থিওরির আলোচ্য বিষয়। সে হিসেবে ফ্রয়েডের থিওরিটির অন্তর্ভুক্ত। পরবর্তীতে ইথিওলজিস্ট কোনার্ড লরেঞ্জ তার বই ‘অন অ্যাগ্রেশনে’ও এ থিওরি নিয়ে আলোচনা করেন।
ফ্রাস্টেশন-অ্যাগ্রেশন হাইপোথিসিস: ফ্রয়েডীয় ইন্সটিঙ্কট থিওরি দিয়ে প্রভাবিত সাইকোলজিস্ট জন ডলার্ড এবং তার কয়েকজন কলিগের সমন্বয়ে প্রকাশিত বই ‘ফ্রাস্টেশন অ্যান্ড অ্যাগ্রেশনে’ সর্বপ্রথম এ থিওরির প্রকাশ। এ থিওরি অনুযায়ী, জন্মগতভাবে মানুষ যে অ্যাগ্রেশন নিয়ে আসে, সেই অ্যাগ্রেশনের প্রকাশ ঘটে কিছু নির্দিষ্ট পরিবেশ বা পরিস্থিতিতে। তেমনই এক পরিস্থিতি হলো ‘হতাশা’। জন ডলার্ডের মতে, ফ্রাস্টেশন সব সময়ই অ্যাগ্রেশনে রূপ নেয়, মতান্তরে অ্যাগ্রেশন হল ফ্রাস্টেশনের একটি ফলাফল।
এ হতাশা বা ফ্রাস্টেশনের উৎস হতে পারে জীবনের মৌলিক চাহিদার অভাব কিংবা অন্য যেকোনো কিছু। তবে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর বিষয়টি হচ্ছে, ফ্রাস্টেশন থেকে উদ্ভুত এ অ্যাগ্রেশন সব সময় ফ্রাস্টেশনের মূল উৎসের প্রতি না হয়ে হতে পারে অন্য কোনো বস্তুর প্রতি। একে বলে, ‘ডিসপ্লেসড অ্যাগ্রেশন’। সমাজে এটিই বরং অহরহ দেখা যায়।
উদাহরণস্বরূপ, অন্যান্য দিনের মত সকালে অফিসে যাওয়ার পর আপনি জানতে পারলেন, আগামী মাস থেকে আপনার চাকরিটা আর থাকছে না। আকস্মিক এ চাকরিচ্যুতির ঘোষণা আপনাকে ভয়াবহ রকমের ফ্রাস্টেশনে ফেলে দিলো। মনে মনে তৈরি হলো বসের প্রতি তীব্র ক্ষোভ। কিন্তু আপনার পক্ষে তো আর সম্ভব না বসের প্রতি ক্ষোভ দেখানো। তাই ক্ষোভটা ডিসপ্লেসড করলেন বাসায় ফিরে আপনার স্ত্রী বা সন্তানের ওপর। অর্থাৎ ফ্রাস্টেশন থেকে সৃষ্ট অ্যাগ্রেশনটি আপনি দেখালেন আপনার জন্য মোটামুটিভাবে নিরাপদ এবং আপনার চেয়ে কম ক্ষমতার অধিকারী একটি জায়গায়।
আরেকটি উদাহরণ দেই, প্রায়ই আমরা শুনি বা অনেকসময় নাটক-সিনেমায়ও দেখি, গ্রামের প্রতাপশালী চেয়ারম্যানের কুলাঙ্গার ছেলে অমুক বাড়ির দরিদ্র বাবার মেয়েকে ধর্ষণ করেছে। খোঁজ নিলে দেখা যাবে, এ ছেলে তার বাবার কাছে উঠতে-বসতে অপমানিত হয় এবং এরকম একটি ছেলে কখনো তার থেকে মোটামুটি ক্ষমতাবান কোনো পরিবারের মেয়েকে অত্যাচার করার সাহস দেখাবে না। তাহলে আপনারাই এখন ভাবুন, ফ্রাস্টেশন-অ্যাগ্রেশন থিওরি অনুযায়ী, এ ঘটনাটাকে ব্যাখ্যা দেওয়া যায় কি না। শিশুদের প্রতি যৌন সহিংসতাকেও আমি এর অন্তর্ভুক্ত করব।
অ্যারোস্যাল অ্যান্ড অ্যাগ্রেশন: ডলফ জিলম্যানের এ থিওরি বেশ ইন্টারেস্টিং। এর মূল বক্তব্য হলো, একটি উৎস থেকে সৃষ্ট উদ্দীপনা অন্য একটি বস্তুতে প্রবাহিত করা। উদাহরণস্বরূপ, রাস্তা-ঘাটে আসতে-যেতে দেখবেন চলন্ত অবস্থায় এক রিকশার সাথে আরেক রিকশার সামান্য একটু ধাক্কা লাগতেই রিকশাওয়ালা দুজনের মধ্যে গালাগালের ধুম পড়ে যায়। পারলে একজন আরেকজনকে মেরেই ফেলেন এমন অবস্থা আর কি। অথচ ঘটনা খুবই সামান্য। এর কারণ হলো, অলরেডি শারীরিক পরিশ্রমের দরুণ তারা ফিজিক্যালি অ্যারোসড বা এক্সাইটেড হয়ে আছেন। এমতাবস্থায় ধাক্কা লাগা বিষয়টি তাদের একটি সুযোগ এনে দিলো নিজের ফিজিক্যাল অ্যারোস্যালকে আরেকজনের ওপর চ্যানেলাইজ করার।
অন্যভাবে আরেকটি উদাহরণ দেই, ধরুন, আপনি রেস্টুরেন্টে বসে আপনার প্রিয় মানুষের জন্য অপেক্ষা করছেন। এ অপেক্ষা আপনার জন্য বিরক্তিকর নয়, আনন্দের। অর্থাৎ আপনি অলরেডি খুব রোমান্টিক মুডে আছেন। এমতাবস্থায় রেস্টুরেন্টে বাজতে থাকা একটি রোমান্টিক গান আপনার মাঝে এত বেশি ভালো লাগা তৈরি করবে, যেটি হয়তো এর আগে হাজারবার শুনেও আপনার মধ্যে তৈরি হয়নি। এখানে আপনার রোমান্টিক মুডটা চ্যানেলাইজড হয়ে গেল গানের প্রতি।
ধর্ষণের সাথেও অ্যাগ্রেশনের এ থিওরিকে খুব চমৎকারভাবে রিলেট করা যায়। যেমন ধরুন, যে ছেলে ইতোমধ্যে মাদক সেবন করে অথবা পর্নোগ্রাফিক মুভি দেখে ফিজিক্যালি অ্যারোসড হয়ে আছে, সেই ছেলে সুযোগ পাওয়া মাত্রই তার এই ফিজিক্যাল অ্যারোস্যালটি চ্যানেলাইজড করে দেবে একজন নারীর ওপর। সেক্ষেত্রে সেই নারীর সাথে তার পূর্বপরিচয়, ভালো লাগা, নারীর বয়স, নারীর কাপড় (যেহেতু সমাজের একটি বড় অংশ ধর্ষণ প্রসঙ্গে নারীর কাপড় টেনে আনেন) এসবের কিছুরই প্রয়োজন নেই।
সোশ্যাল লার্নিং অ্যান্ড অ্যাগ্রেশন: অ্যাগ্রেশনের সবগুলো হাইপোথিসিসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্য হাইপোথিসিস এটি। লার্নিং সাইকোলজির একেবারেই বেসিক একটা বিষয়। একটা শিশু বড় হয়ে কেমন মানুষ হবে, তার ব্যক্তিত্ব কেমন হবে, আচরণ কেমন হবে- সেই সবকিছু যতটা তার জেনেটিক মেকাপের ওপর নির্ভর করে, ততটাই নির্ভর করে লার্নিংয়ের ওপর। এ থিওরি অনুযায়ী, অ্যাগ্রেসিভ আচরণ গড়ে ওঠে রিইনফোর্সমেন্ট এবং অ্যাগ্রেসিভ মডেলদের অনুকরণের মাধ্যমে।
এখানে আলোচ্য বিষয় তাহলে দুটি-
লার্নিং থ্র রিইনফোর্সমেন্ট: রিইনফোর্সমেন্ট মানে সোজা বাংলায় যে জিনিস আপনার একটি আচরণকে বৃদ্ধি করে। উদাহরণস্বরূপ, কিছু কিছু বাচ্চা আপনি দেখবেন যে কোনো কিছু চাইতে হলে চিৎকার-চেচামেচি করে চায়। এর কারণ হলো সে স্বাভাবিকভাবে হয়তো কখনো একটি জিনিস চেয়েছে, পায়নি। কিন্তু যখন সে চিৎকার করে মাটিতে গড়াগড়ি করেছে, তখন বাবা বা মা তাড়াতাড়ি তাকে থামানোর জন্য ওই জিনিসটি কিনে দিয়েছে। এখানে তার অভিভাবক যে তাকে ওই জিনিসটি কিনে দিলো, এটা হলো রিইনফোর্সমেন্ট। বাচ্চা যে চিৎকার করছিল, এটা বাচ্চার আচরণ এবং বাচ্চার লার্নিংটি হলো এরপর থেকে কিছু পেতে হলে অবশ্যই চিৎকার করতে হবে।
এবার আসি ধর্ষণের ক্ষেত্রে ব্যাপারটি কিভাবে কাজ করে। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটেই বলি। প্রথমত, আমাদের দেশে ম্যাক্সিমাম মেয়েরা সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্টের কথা প্রকাশ করে না, ধর্ষণও না। নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের কেসটার কথাই ধরুন। ধর্ষণের ৩২ দিন পর ঘটনাটি প্রকাশিত হয়। তাও প্রকাশিত হয় সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে, কয়েকজনের লেখালেখির মাধ্যমে।
তার আগ পর্যন্ত কিন্তু ধর্ষিতা বা ধর্ষিতার পরিবার কোনো মামলা করেনি। এখানে ধর্ষিতাকে আমি দোষ দেব না। আমাদের সমাজব্যবস্থাই এমন। এখানে মেয়েরা ধর্ষিতা হলে তাদের সম্মানহানি(!) হয়, মামলা করতে গেলে থাকে ক্ষমতাশীলদের হাতে প্রাণ হারানোর ভয়। সে যাই হোক, আমি আমার সাইকোলজিতে ফিরে আসি। এই যে চুপ থাকা, ব্যাপারটা ধর্ষকদের ক্ষেত্রে রিইনফোর্সমেন্ট হিসেবে কাজ করে। তাদের জানা হয় যে, এরকম কাজ বারবার করাই যায়, কেউ তো আর মুখ খুলবে না। দ্বিতীয়ত, বিচারহীনতা বা বিচার হলেও সুষ্ঠু বিচার না হওয়া এটাও ধর্ষকদের জন্য রিইনফোর্সমেন্ট। এতেও তাদের বারবার ধর্ষণ করার শিক্ষা হচ্ছে।
লার্নিং থ্র দ্য ইমিটেশন অব অ্যাগ্রেসিভ মডেলস: এটি আরেকটি ভয়ানক এবং আমি মনে করি, ধর্ষণের প্রথমসারির কারণগুলোর একটি। আমাদের দেশে ছোটবেলা থেকে একটা ছেলে এটা দেখে দেখে বড় হয় যে, তার বাবা তার মাকে উঠতে-বসতে গায়ে হাত তোলে, অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে। পাড়ার সো কল্ড বড় ভাই পাড়ার মেয়েদের দেখলেই শিষ দেয়, ওড়না ধরে টান দেয়, অশালীন অঙ্গভঙ্গি করে। এখানে যে ফাদার ফিগারের কথা বললাম, তিনি এবং এলাকার সেই বড় ভাই হচ্ছেন মূলত অ্যাগ্রেসিভ মডেলস।
যাদের ছোটবেলা থেকেই দেখে দেখে ছেলেটি শিখে নেয়, সমাজে মেয়েদের সাথে যা ইচ্ছা করা যায়, চাইলেই তার বুকে হাত দেওয়া যায় কিংবা তার সাথে যৌনক্রিয়া সম্পাদন করা যায়। এতে কোনো অসুবিধা নেই। এটাই নিয়ম।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অ্যাগ্রেসিভ মডেল হচ্ছে পর্নোগ্রাফি। পর্নোগ্রাফিতে যে রোলগুলো দেখানো হয়, সেখানে কী হয়? মেইল রোলগুলো থাকে প্রচণ্ড রকমের ডমিনেটিং এবং ভায়োলেন্ট। যারা তাদের ফিমেল পার্টনারের সাথে ইচ্ছামত বিকৃত যৌনাচার চালিয়ে যায়। আর ফিমেল পার্টনারটিও যেন সেসব বিকৃতি বেশ উপভোগ করছে এমনটিই দেখানো হয়। বয়ঃসন্ধিকাল থেকে একজন ছেলে যখন তার জীবনের প্রথম সেক্স এডুকেশনই পায় এধরনের পর্নোফিল্ম দেখে, তখন তার এটাই লার্নিং হয় যে, এখানে এ মডেলরা যা করছে, এটাই স্বাভাবিক। যৌনসঙ্গম ব্যাপারটা এমনই। মেয়েদের সাথে এটাই করতে হয়। এমনকি একটি শিশুর সাথেও এগুলো করা যায়। এতে মেয়েদের কোনো কষ্ট হয় না বরং তারাও ব্যাপারটা এনজয় করে (যেটা একদমই সঠিক না)। মেয়েদের ক্ষেত্রে সেক্স ব্যাপারটা যতটা না ফিজিক্যাল তার থেকে অনেক অনেক বেশি মেন্টাল।
আমি যে শুরুতে বলেছিলাম, বর্তমান যুগের ধর্ষণ; যেখানে বিকৃত যৌনাচারের হার অনেকগুণ বেশি, তার পেছনে পর্নোগ্রাফি বা চটি বইয়ের বিকৃত যৌনাচারই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দায়ী বলে আমি মনে করি।
এতক্ষণ তো বললাম শুধু অ্যাগ্রেশন হাইপোথিসিসের কথা। কিন্তু শুধু অ্যাগ্রেশন দিয়েই ধর্ষণকে পুরোপুরি ব্যাখ্যা করা যায় না। যেকোনো অপরাধের পেছনে একজন মানুষের পার্সোনালিটির বিরাট গুরুত্ববহন করে। আর পার্সোনালিটি বা ব্যক্তিত্বের কথা বলতে গেলেই চলে আসে মেন্টাল স্ট্রাকচার নিয়ে ফ্রয়েডের সেই চমৎকার কনফিগারেশনের কথা-
ইড: ইড হচ্ছে সোজা বাংলায় মানুষের আদিম প্রবৃত্তি। যেখানে কোনো সামাজিক মূল্যবোধ, বিবেকবোধ এসবের বালাই নেই। যেমন আপনার প্রচণ্ড খিদা পেয়েছে এবং আপনার কাছে কোনো খাবার নেই, খাবার কেনার মত টাকাও নেই। কিন্তু আপনি দেখলেন একটু সামনেই একটা খাবারের দোকান। আপনি সেই দোকানে ঢুকলেন, দোকানিকে কিছু না বলেই একটা খাবারের প্যাকেট তুলে নিয়ে হাঁটা দিলেন। কাজটা ঠিক না বেঠিক সেসব চিন্তা আপনার মাথায় আসবে না। আপনার খিদা পেয়েছে, সেটা নিবারণ করাই এখন আপনার কাছে মুখ্য।
ইগো: ইগো হচ্ছে ইড এবং সুপার ইগো এ দুয়ের মধ্যে ব্যালেন্স। ইগো আমাদের বাস্তবধর্মী সিদ্ধান্ত নিতে শেখায়। বস্তুত, যে মানুষের ইগো যত ভালো; সে সামাজিকভাবে তত বেশি খাপ খাইয়ে নিতে সক্ষম। ইগো আমাদের শেখায় খিদা পেলে যদি আমার খাবার কেনার সামর্থ না থাকে, সেক্ষেত্রে আমরা কী কী করতে পারি। আমরা কোনো বন্ধুর থেকে ধার নিয়ে খাবার কিনতে পারি, কিংবা দোকানি পরিচিত হলে অনুরোধ করতে পারি, আমাকে এক প্যাকেট খাবার আপাতত বাকিতে দিতে, আমি পরে পরিশোধ করে দেব।
সুপার ইগো: এটি হচ্ছে আমাদের নীতিবোধ বা বিবেকবোধ। এ বিবেকবোধ সামাজিক অথবা ধর্মীয় মূল্যবোধ যেকোনোটি থেকেই আসতে পারে। সুপার ইগো আমাদের শেখায় খিদা পেলেই একটি দোকানে ঢুকে নিজের ইচ্ছামত খাবার তুলে নিয়ে চলে যাওয়া যায় না। এটি নীতিগতভাবে সঠিক নয়।
ধর্ষকদের মাঝে এই ইগো বা সুপার ইগো কোনটিই কাজ করে না। তাদের সব কিছুকে ছাড়িয়ে যায় তাদের ইড। একজন নারীর শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রণার চেয়ে তার নিজের সেক্সুয়াল প্লেজার পাওয়ার বিষয়টিই তার কাছে মুখ্য।
সবশেষ আরেকটি ভিন্ন বিষয় নিয়ে একটু বলি। হিউম্যান সেক্সুয়াল রেসপন্স সাইকেলের অনেকগুলো সেক্সুয়াল মডেলের মধ্যে একটি হলো জন ব্যানক্রফটের ডুয়াল কন্ট্রল মডেল। মডেলের বিস্তারিত আলোচনায় আমি যাব না। এখানে যেটি মূলকথা সেটি হচ্ছে, সেক্সুয়াল অ্যাক্টিভিটি আমাদের নার্ভাস সিস্টেমের এক্সিটেটরি এবং ইনহিবিটরি দুই মেকানিজমের ব্যালেন্সের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হয়। এখন যাদের ক্ষেত্রে ‘Low excitation’ এবং ‘High inhibition’ থাকে, তাদের ক্ষেত্রে সেক্সুয়াল ডিসফাঙ্কশন হওয়ার একটি সম্ভাবনা থাকে। অন্যদিকে যাদের ‘High excitation’ এবং ‘low inhibition’ থাকে, তাদের ক্ষেত্রে রিস্কি সেক্সুয়াল বিহেভিয়র’ (ধর্ষণ) হওয়ার সম্ভাবনা প্রচুর।
পরিশেষে একটি কথা না বললেই নয়। ধর্ষণের মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ নিয়ে আমার লেখাটির পেছনে মূল উদ্দেশ্য ছিল ধর্ষণ প্রতিরোধে ঠিক কোন কোন জায়গায় কাজ করা উচিত, কেন করা উচিত- সে বিষয়ে একটি বিজ্ঞানসম্মত ধারণা দেওয়া, ধর্ষণকে নরমালাইজ করা নয়। কারণ আমি জানি, আমাদের আশেপাশেই অনেক রেপিস্ট বা পটেনশিয়াল রেপিস্ট ভালো মানুষের চেহারা নিয়ে ঘুরে বেড়ায়।
তারা কেউ কেউ হয়তো এটা বলবে, সবই যখন সাইকোলজিকাল কারণে হয়, তাহলে মানুষের কী দোষ! দোষ অবশ্যই আছে। আপনি চাইলেই মাদকাসক্ত না হতে পারেন, চাইলেই পর্নোগ্রাফিক মুভি থেকে নিজেকে দূরে রাখতে পারেন, চাইলেই ধর্মীয়, পারিবারিক, সামাজিক অনুশাসন মেনে আপনার ইগো, সুপার ইগোকে উন্নত করতে পারেন। তা না করে, সব দোষ সাইকোলজি আর মেয়েদের পোশাকের- এসব কথা বলে বলে নিজেকে পটেনশিয়াল রেপিস্ট থেকে রেপিস্টে উন্নীত করার দায়ভার অবশ্যই আপনার।
এসইউ/এএ/এমএস