ভিডিও EN
  1. Home/
  2. ফিচার

গ্রামীণ সাংবাদিকতায় ইকরাম চৌধুরীর অবদান

কাদের পলাশ | প্রকাশিত: ১১:৪৯ এএম, ০৩ অক্টোবর ২০২০

ঊনিশ শতকের শেষ আর বিশ শতকের শুরু, দুইয়ে দুইয়ে চার দশকের এক প্রামাণ্য দলিল যেন একটি নাম। অসংখ্য ভক্ত-শুভাকাঙ্ক্ষী, দুই ডজন শিষ্য আর কয়েকশ সহকর্মীর কাছ থেকে নীরবে-নিভৃতে চলে গেলেন অচিন দেশে। পরম সত্যকে (মৃত্যু) আলিঙ্গন করে শারীরিক প্রস্থান হয়েছে হয়তো কিন্তু অসংখ্য হৃদমাজারে শ্রদ্ধার আসনে স্বগৌরবে অবস্থান করবেন তিনি। বলছি চাঁদপুরের সাংবাদিকতার পথিকৃৎ ইকরাম চৌধুরীর কথা।

প্রখর রোদে বুক চিতিয়ে রাখা বটবৃক্ষের নাম ইকরাম চৌধুরী। চাঁদপুরের সাংবাদিকতা জগতে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র, চাঁদপুর প্রেসক্লাবের সভাপতি, চ্যানেল আইয়ের স্টাফ রিপোর্টার, যুগান্তর ও জাগো নিউজের জেলা প্রতিনিধি, দৈনিক চাঁদপুর দর্পণ পত্রিকার সম্পাদক-প্রকাশক ইকরাম চৌধুরী চলে গেছেন পরপারে। শনিবার (৮ আগস্ট ২০২০) ভোর সাড়ে ৪টায় ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। মাত্র পঞ্চান্ন বছরের সংক্ষিপ্ত জীবনের চল্লিশ বছর অর্থাৎ মৃত্যুর শেষদিন অবধি জড়িত ছিলেন মহান পেশা সাংবাদিকতায়। শুধু সাংবাদিকতার কারণে ন্যূনতম যত্ন নিতে পারেননি নিজের। যে কারণে শরীরে ডায়াবেটিস, ধীরে ধীরে কিডনি হলো ড্যামেজ। তারপর মৃত্যুকে আলিঙ্গন। প্রান্তিক পর্যায়ের তুখোড় গণমাধ্যমকর্মী ইকরাম চৌধুরী মফস্বল পর্যায়ের আইডল সাংবাদিক। তর্ক-বিতর্ক থাকলেও ‘মফস্বল’ শব্দটি আমার হৃদয়ে কোমল আবহ সৃষ্টি করে।

সম্প্রতি চাঁদপুরের তিন সাংবাদিক চিরনিদ্রায় শায়িত হয়েছেন। স্বভাবতই আমার লেখার প্রাসঙ্গিকতাও সাংবাদিক বা সাংবাদিকতা। ‘মফস্বল বা গ্রামীণ সাংবাদিক’ শব্দ দুটি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা হয় অথবা হচ্ছে। এ নিয়ে আমার কিছু প্রশ্ন-
এক. সাংবাদিকের গণ্ডি কতটুকু?
দুই. মাঠ আর অফিস পর্যায়ের সাংবাদিকতা মানে কী?
তিন. জেলা বা উপজেলা পর্যায়ে সাংবাদিকদের আলাদা পরিচয় কী?
চার. মফস্বল বা গ্রামীণ সাংবাদিকের তারতম্য কী?
আমি সবগুলো প্রশ্ন নিয়ে বলতে চাই না। শুধু গ্রামীণ বা মফস্বল সাংবাদিক প্রসঙ্গে সামান্য আলোকপাত করতে চাই। যেহেতু আমি জেলা পর্যায়ে কাজ করি; সেহেতু আমার অভিমত প্রকাশের ক্ষীণচেষ্টা করছি।

অফিসের প্রয়োজন বা অবস্থানগত কারণে প্রতিটি জেলা-উপজেলায় অনেকেই গণমাধ্যমে কাজ করেন। তাদের মফস্বল বা গ্রামীণ সাংবাদিক বলতে আমার বিন্দুমাত্র দ্বিধা নেই। শব্দ দুটিকে আমি ব্যক্তিগতভাবে খুব গুরুত্ব বা তাৎপর্যপূর্ণ বলেই মনে করি। কারণ স্থানীয় সাংবাদিকদের আলাদা কোনো বিট নেই। তারা প্রতিটি ক্ষেত্রেই দক্ষ হন। বিশেষ করে, যারা একসাথে টিভি ও প্রিন্ট মিডিয়ায় কাজ করেন। আমরা জানি, শুধু প্রাণের টানে এ পেশায় অনেকেই সম্পৃক্ত হন। কিন্তু বিনিময় কি পান? পাওয়া-না পাওয়ার গল্প আমরা যারা স্থানীয় পর্যায়ে কাজ করি, সবাই জানি। কর্মরত গণমাধ্যমের ঊর্ধ্বতনরাও জানেন। তবুও প্রান্তিক পর্যায়ের সাংবাদিকরা স্থানীয়, গ্রামীণ বা মফস্বল সাংবাদিক শব্দগুলো নিয়ে আপত্তি করেন। অথচ যতই আপত্তি করা হোক না কেন, মূল স্রোতের সাংবাদিকতার সঙ্গে স্থানীয় সাংবাদিকতার বিস্তর ফারাক রয়েছে। এর প্রধান কারণ আর্থিক বা টেকনিক্যাল সুযোগ-সুবিধা? যথাযথ আর্থিক এবং টেকনিক্যাল সুবিধা না পেয়ে শুধু শ্রদ্ধা আর ভালোবাসার টানেই এ পেশায় আমরা টিকে থাকি। কাটিয়ে দেই মহান পেশায়। সাংবাদিক আর মফস্বল সাংবাদিকের মধ্যে পার্থক্য নেই। এভাবে যতই বলা হোক, মূল বা মৌলিক পার্থক্যগুলো কি, তা স্থানীয় সাংবাদিক এবং রাজধানীতে কর্মরত সাংবাদিকমাত্রই জানার কথা।

২০১১ সালে যখন স্থানীয় একটি পত্রিকা থেকে আমি অব্যহতি নেই। পরে তাঁর পরামর্শ নিতে গিয়েছি চাঁদপুর শহরস্থ নাজিরপাড়ায় দৈনিক চাঁদপুর দর্পণ পত্রিকা অফিসে। আমাকে সাথে রাখার প্রতিশ্রুতি দিলেন। ‘সহকারী বার্তা সম্পাদক’ হিসেবে দায়িত্ব দিয়ে সাহস জুগিয়েছেন। কাজ করতে গিয়ে অনেক প্রসংশা পেয়েছি। তবে একসাথে বেশিদিন থাকা হয়নি। ছয় কি সাত মাস পরে অপর একটি স্থানীয় দৈনিকের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পাই। ইকরাম ভাই আমার চলে আসা মেনে নিতে পারেননি। ভালোবাসার ছলে একটি হুমকি দিয়েছিলেন। আমি জানি, তিনি আমায় হৃদয়ের গহীন থেকে দোয়া করেছিলেন। ইকরাম ভাই আজ প্রয়াত। বুকের ভেতর অভাববোধ গড়াগড়ি খাচ্ছে। অশ্রুফোঁটা চোখের কোণে জড়ো হচ্ছে, অতিশোকে বরফ হচ্ছে হয়তো। তারপর উড়ে যাবে হাওয়ায়। বুকের ভেতর যে ব্যথা অনুভূত হচ্ছে- তাও পাথর হতে দলা পাকাচ্ছে। চলতি বছরের ০৭ জুলাই ভাইয়ের সাথে শেষ কথা হয়েছিল। অনেক কথা বলার ছিল কিন্তু সুযোগ হয়ে ওঠেনি। আর উঠবেও না, ভাবতেই গলা শুকিয়ে আসে। ভাষাগুলো হারিয়ে গেছে অচিন পথে। যে পথে হারিয়ে গেলেন প্রিয় ইকরাম ভাই।

ইকরাম চৌধুরী ১৫ অক্টোবর ১৯৬৫ সালে ফরিদগঞ্জ উপজেলার ২নং বালিথুবা ইউনিয়নের শোশাইরচর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ালেখা করেও শুধু প্রাণের টানে মিশে যান সাংবাদিকতার মতো মহান পেশায়। দৈনিক চাঁদপুর দর্পণ পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশক একাধারে চ্যানেল আইয়ের স্টাফ রিপোর্টার হিসেবে দীর্ঘ ২১ বছর নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করেছেন। প্রতিষ্ঠার পর থেকে প্রায় দেড় দশক কাজ করেছেন দেশের প্রথম সারির পত্রিকা দৈনিক যুগান্তরে। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে কাজ করছেন অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে। চাঁদপুরের প্রতিটি উপজেলা, ইউনিয়ন এমনকি ওয়ার্ড, হয়তো গ্রাম পর্যায়ের মানুষও ইকরাম ভাইকে চেনেন। শুধু তাঁর নাতিদীর্ঘ কর্মযজ্ঞের কারণে।

তিনি তৃতীয় দফায় চাঁদপুর প্রেসক্লাবের সভাপতির দায়িত্ব নিষ্ঠার সাথে পালন করেছেন। এরআগে ৮ বছর সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। এ কীর্তিমান সাংবাদিকের হাত ধরেই চাঁদপুরের প্রায় দুই ডজন প্রতিষ্ঠিত সাংবাদিকের হাতেখড়ি হয়েছে। সাংবাদিক ইকরাম চৌধুীর প্রস্থানে চাঁদপুরের সাংবাদিক জগতে নেমে আসে শোক। গত ৮ আগস্ট বিকেলে চাঁদপুর প্রেসক্লাব মাঠে তার প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। বিকেল ৩টা ৪৫ মিনিটে মরহুম ইকরাম চৌধুরীকে বহনকারী লাশবাহী গাড়ি প্রেসক্লাব ফটক অতিক্রমকালে অপেক্ষমান সাংবাদিক নেতৃবৃন্দ প্রিয় নেতার শোকে কান্নায় ভেঙে পড়েন। প্রেসক্লাব ময়দানে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের উপস্থাপনে প্রকৃতিও যেন ঝিম ধরে থাকে। মাঠকে ঘিরে থাকা ফুলের বাগানও যেন গুমরে কেঁদে ওঠে ইকরাম চৌধুরীর শূন্যতায়।

উপস্থিত সাংবাদিকদের মনে বেজে ওঠে এক করুণ সুর। যে সুর গান ধরে না। সুর ধরে বেহালার ব্যথাকাতর সুঁতো। কারণ একসময় এ প্রেসক্লাব ছিল একটি চক্রের হাতে বন্দি। কবি নজরুল রোডস্থ সে প্রেসক্লাবের দিকে কোনো সাংবাদিক তাকানোর সাহসও করতো না। ইকরাম চৌধুরী বেশ কয়েকজন সিনিয়র সাংবাদিকের মুষ্ঠি থেকে মুক্ত করেছিলেন চাঁদপুর প্রেসক্লাবকে। এরপর প্রেসক্লাবের দায়িত্ব পাওয়ার পর ক্লাবের নিজস্ব জমিতে চারতলা ভবন তৈরিতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। প্রতিষ্ঠানটিকে প্রকৃত সাংবাদিকের আস্তানা হিসেবে সবার কাছে স্বীকৃতি দিয়েছেন তিনি। এখন চাঁদপুর প্রেসক্লাব সাংবাদিকের প্রাণ। অবশ্য নিজে নিবেদিত প্রাণ হওয়াতেই চাঁদপুর প্রেসক্লাব একটি স্বাবলম্বী প্রতিষ্ঠানে রূপ নিতে পেরেছে।

প্রয়াত ইকরাম চৌধুরী ১৯৮৭ সালে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ডিপ্লোমা পাস করে বাংলাদেশ কুটির শিল্প সংস্থায় (বিসিক) টেকনিক্যাল অফিসার হিসেবে যোগদান করেন। তাঁর কর্মক্ষেত্র ছিলো লক্ষ্মীপুর, ফেনী, কক্সবাজার ও চাঁদপুর। এসএসসি পাসের পর পড়ালেখার পাশাপাশি সাংবাদিকতাকে নেশা হিসেবে গ্রহণের পরিণতিতে ১৯৯৯ সালের শুরুতে তিনি টেকনিক্যাল অফিসারের চাকরিতে ইস্তফা দেন এবং দৈনিক চাঁদপুর দর্পণ প্রকাশের প্রক্রিয়া শুরু করেন। তারপর তাঁর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি।

ইকরাম চৌধুরী চাঁদপুরের সিনিয়র সাংবাদিকদের অন্যতম প্রধান একজন। ২০১৩ সালের একদিন ফরিদগঞ্জ ছাত্রলীগের কর্মসূচির নিউজ করতে সঙ্গী হই। খুব ভোরে উঠে গেছি। কী যেন ছাত্রলীগের বা ছাত্রদলের কমিটি ঘোষণাকে কেন্দ্র করে পদবঞ্চিতরা রাস্তা অবরোধ করেছিল। ভোর চারটায় ইকরাম ভাইসহ আমার মোটরবাইকে করে ফরিদগঞ্জে যাই। দ্রুত নিউজ করে পাঠাই। আমার নয়টার খবরেও খুব ভালো কাভার দিয়েছিল নিউজটি। এর আগে একটা নিউজে হাজীগঞ্জে গিয়েছিলাম। তারপর দলধরে সাংবদিকতা করলেও আলাদাভাবে আর দুজন মিলে মাঠপর্যায়ে সাংবাদিকতা করা হয়নি। ওই দুই দিনই ভাইয়ের মধ্যে রসবোধ খুঁজে পেয়েছি। অর্থাৎ দূর থেকে ইকরাম ভাইকে যতটা রুক্ষ্ম মনে হয়, তার চেয়ে কোমল হৃদয়ের মানুষ তিনি। চাঁদপুরের সাংবাদিকতায় ইকরাম ভাইয়ের অভাব অপূরণীয়। তিনি ওপারে ভালো থাকুন। আল্লাহ তার জন্য ফুলের গালিচায় চিরস্থায়ী আসন দিন। ভালো থাকুক শ্রদ্ধার মানুষ। সুপ্রিয় মানুষ ইকরাম ভাই।

লেখক: গল্পকার ও সাংবাদিক।

এসইউ/এএ/এমএস

আরও পড়ুন