ভিডিও EN
  1. Home/
  2. ফিচার

অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন ফারাজ করিম

ফিচার ডেস্ক | প্রকাশিত: ১০:৩২ এএম, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২০

গণমাধ্যমে চোখ রাখলেই যখন নানা রকম অনিয়মের ঘটনা দেখা যায়; ঠিক তখন এসবের বিপরীতে মাটি ও মানুষের জন্য অবিরাম ছুটে চলা এক তরুণ স্বপ্নবাজের নাম ফারাজ করিম চৌধুরী। চট্টগ্রাম-৬ (রাউজান) আসনের এই এমপিপুত্র তার সব ব্যতিক্রমী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে এখন গোটা দেশে তুমুল জনপ্রিয়তা অর্জন করছেন। সম্প্রতি তার সাথে কথা বলে বিস্তারিত জানাচ্ছেন জুনায়েদ হাবীব-

চট্টগ্রামের রাউজানের খান বাহাদুর আব্দুল জব্বার চৌধুরী বংশের ইতিহাস ও ঐতিহ্য গোটা শহরের এক অনন্য অধ্যায়। ব্রিটিশ শাসকের আমলে আব্দুল জব্বার তখনকার সময়ের এক ঘোষিত খান বাহাদুর নামক বীর উপাধি নিয়ে শহরজুড়ে চষে বেড়াতেন। চট্টগ্রাম-৬ আসনের সংসদ সদস্য এবিএম ফজলে করিম চৌধুরীর পিতামহ খান বাহাদুর আব্দুল জব্বার চৌধুরীর মৃত্যুর পর ঐতিহ্যবাহী পরিবারের আধিপত্য ও অসংখ্য মানুষের ভালোবাসার আশ্রয়স্থল যে এখনো কতটা বিদ্যমান, তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ এমপি ফজলে করিম চৌধুরীর জ্যেষ্ঠ সন্তান ফারাজ করিম চৌধুরী।

২০১৩ সালে কিংস কলেজ লন্ডন থেকে আন্ডার গ্রাজুয়েট শেষ করে ২০১৫ সালে লন্ডনের ইউনিভার্সিটি অব ম্যানচেস্টার থেকে উচ্চশিক্ষা (মাস্টার্স) অর্জন করে দেশে আসেন এ তরুণ। তখন থেকেই বিভিন্ন সামাজিক ও মানবিক কর্মকাণ্ডে অংশ নিয়ে বেশ পরিচিতি পান। বাইরের দেশ থেকে উচ্চডিগ্রি সম্পন্ন করার পর দেশের বহুজাতিক শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর উচ্চপর্যায়ে চাকরির সুযোগ থাকলেও সে পথে পা বাড়াননি ফারাজ। বর্তমানে ক্লিন ইমেজের তরুণ রাজনীতিবিদ হিসেবে তুমুল জনপ্রিয়তা পেলেও নিজেকে একজন সাধারণ মানুষ হিসেবেই পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। তার বিভিন্ন মানবিক কার্যক্রমের মাধ্যমে গোটা দেশের অসংখ্য মানুষের হৃদয়ের মণিকোঠায় জায়গা করে নেওয়া এ তরুণের গল্প এখনো অনেকেরই অজানা।

jagonews24

বাবার সাথে একই পথে: প্রতাবশালী সংসদ সদস্য এবিএম ফজলে করিম চৌধুরীর জ্যেষ্ঠপুত্র ফারাজ করিম চৌধুরী সবারই আদরে বেড়ে উঠেছেন। তার জন্ম ঢাকায় হওয়ায় পড়াশোনার শুরুটাও ছিল সেখান থেকে। তবে শুরুর পরপরই চলে আসেন চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলার নিজ বাড়িতে। প্রসিদ্ধ পরিবারের ছেলে হিসেবে সব সময় পেতেন বিশেষ সুযোগ-সুবিধা। যার কারণে তিনি তার বাবার পরিচয় আড়ালেই রাখতেন। পড়াশোনার ফাঁকে মাঝেমধ্যেই বাবার সাথে বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে যেতেন। দেখতেন দেশের জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে নানা রকম প্রচলিত প্রথা। এসব দেখে খানিক বিরক্তও হতেন।

ফারাজ করিম বললেন, ‘আমাদের দেশে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যখন কোনো বিশিষ্টজনকে অতিথি হিসেবে আমন্ত্রণ করা হয়; তখন সেই আয়োজনে তাদের বড় বড় ছবি দিয়ে ব্যানার সাঁটিয়ে স্বাগত জানানো, ফুল দিয়ে বরণ করার ব্যাপারগুলো আমার বাবার সাথেও ঘটতো।’ এসব দেখে ফারাজ করিম বিরক্তও হতেন এবং এসবের পরিবর্তন কিভাবে আনা যায় তা নিয়ে চিন্তা করতেন। তিনি বলেন, ‘ছবি দিয়ে পোস্টার নয় বরং কাজের মাধ্যমে মানুষের মনের পোস্টার হয়ে থাকাটাই হলো আসল।’ একদিন রাউজান কলেজের একটি অনুষ্ঠানে তিনি তার বাবার ও নিজের ছবি সম্বলিত ব্যানার-ফেস্টুন নামিয়ে ফেলেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ব্যানার-ফেস্টুন লাগিয়ে পড়ালেখার পরিবেশ নষ্ট করায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন। জানা যায়, সেদিনের পর থেকে যেকোনো অনুষ্ঠানে তাদের আমন্ত্রণ করা হলে ব্যানার দিয়ে স্বাগত জানানো, ফুল ও ক্রেস্ট দিয়ে শুভেচ্ছার প্রদানের নিয়ম-রীতির পরিবর্তন রাউজানে স্থায়ী হয়ে যায়।

ফারাজ করিম ছোটবেলা থেকেই মানবিক ছিলেন। একদিন নিজের অসংখ্য নতুন কাপড় বাসার ওয়ারড্রবে পড়ে থাকতে দেখে সেসব কাপড় নিয়ে ছিন্নমূল শিশুদের মাঝে বিতরণ করে আসেন। এভাবেই ছোট থেকে দারিদ্র্যের প্রতি তার অকৃত্রিম ভালোবাসার জন্ম হয়। ছেলের এসব মানবিক কার্যক্রম দেখে বাবাও মুগ্ধ হয়ে ফারাজ করিমকে এসব কাজে আর্থিক জোগান দিতেন। এমপি ফজলে করিমের সাথে একদিন ১৪ বছর বয়সী এ কিশোর বক্তব্য রাখেন দেশের বাইরে আবুধাবির এক অনুষ্ঠানে। ফারাজ করিমের চিন্তাধারা ছিল অনেকটা ব্যতিক্রম। তবুও সুযোগ হয়ে উঠতো না সেসব কাজে লাগানোর। অবশেষে ২০১৫ সালে যুক্তরাজ্য থেকে উচ্চশিক্ষা (মাস্টার্স) সম্পন্ন করার পর দেশে এসে এ তরুণের স্বপ্নের আকাশে উঁকি দেয় সেসব ভাবনা। এরপর নেমে পড়েন বাস্তবায়নে। তার এসব কর্মকাণ্ডে অংশ নেয় ‘সেন্ট্রাল বয়েজ অব রাউজান’ নামের একটি সেচ্ছাসেবী সংগঠন। বৃহত্তর পুরো নগরীকে পরিচ্ছন্ন করতে ‘ক্লিন রাউজান ক্যাম্পেইন’ নামে একটি কর্মসূচির মাধ্যমে শুরু হয় তার কার্যক্রম। এরপর অসংখ্য অসহায়ের জন্য কর্মসংস্থানের উদ্যোগ নেওয়া, প্রতিবন্ধীদের সহায়তাসহ সমাজে চলতে থাকা নানা ধরনের অপরাধ ঠেকাতেও সমানতালে পদক্ষেপ গ্রহণ করে সর্বমহলে আলোচনার শীর্ষে আসেন। এসব কার্যক্রমের প্রসঙ্গে ফারাজ করিম বলেন, ‘গত ৪ বছরে আমি অসংখ্য উদ্যোগ নেওয়ার চেষ্টা করেছি। দেশের মানুষ আমাকে দোয়া করলেও আমি চাই, আল্লাহর অনুগ্রহে আমার নিজের মতো করে কাজ করতে। আমার বাবাও আমাকে সব ভালো কাজগুলোর অংশীদারিত্বে থাকতেন, যার জন্য এসব সম্ভব হয়েছে।

jagonews24

অনিয়মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ: ঘটনাটি ২০১৮ সালের আগস্টে। রাউজান উপজেলা পরিষদের সামনে বেপরোয়া এক ট্রাক চালকের দুর্ঘটনার শিকার হয়ে নিহত হয় এক স্কুলশিক্ষার্থী। এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় মুহূর্তেই তোলপাড় হয়ে পড়ে পুরো রাউজানজুড়ে। সেসময়ে সংসদ সদস্য ফজলে করিম ও তার সন্তান ফারাজ করিম অবস্থান করছিলেন ঢাকায়। সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে স্কুলশিক্ষার্থীর নিহত হওয়ার ঘটনাটি ধামাচাপা দেওয়ার জন্য সেখানকার একটি প্রভাবশালী মহল পাঁয়তারা করছিল। যাতে নিহতের স্বজনদের ২০ হাজার টাকায় জিম্মি করে বিষয়গুলোকে যেন শেষ করা হয়। এ ঘটনার জের নিয়ে আরও উত্তপ্ত হতে থাকে পরিস্থিতি। প্রভাবশালী সেই মহল ঢাকায় অবস্থানরত সংসদ সদস্যকে নয়ছয় বোঝালেও এমপিপুত্র ফারাজ করিমের কানে এসে পৌঁছায় মূল খবর। এসব জেনেই তাৎক্ষণিক ঢাকা থেকে রাউজানে ছুটে এসে দেখতে পান পরিস্থিতি অনেকটা থমথমে। পরে তিনি জানেন, মোটা অঙ্কের লোভ দেখিয়ে নিহতদের আইনি প্রক্রিয়া থেকে বঞ্চিত করে সংশ্লিষ্ট থানাকেও দমিয়ে রাখা হয়। তবে ফারাজ করিম সেদিন চ্যালেঞ্জ নিয়েই নিহতের স্বজনদের সাথে থানায় গিয়ে পুলিশ কর্মকর্তাদের মামলা নিতে বাধ্য করেন। এভাবেই নিহত শিক্ষার্থীর ন্যায় বিচার আদায়ের জন্য নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছিলেন তিনি।

এর আগে রাউজানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে বখাটেদের উৎপাত বেড়ে যায়। এজন্য কলেজগামী অসংখ্য তরুণীর নিয়মিত বিভিন্ন অপ্রীতিকর পরিস্থিতিতে পড়তে হতো। এ বিষয়গুলো ফারাজ করিমের ফেসবুক পেজে এক তরুণী অভিযোগ জানালে তিনি পুরো রাউজানে ভবঘুরে বখাটে ছেলেদের নির্মূলে স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তায় মাঠে নামেন। শুধু তাই নয়, এ ধরনের অভিযোগের ভিত্তিতে অপরাধ মুহূর্তেই দমন করতে তার একান্ত প্রচেষ্টায় রাউজানে একটি হেল্প ডেস্ক সার্ভিস চালু করে সর্বত্র সহায়তা প্রদানের জন্য নম্বরটি ছড়িয়ে দেওয়া হয়। তারপর থেকেই ধর্ষণ, মাদক, চাঁদাবাজি, দখলদারীসহ নারী নির্যাতন কিংবা ভয়ঙ্কর অপরাধের গল্পও উঠে আসতে থাকে সেই হেল্প ডেস্কের মাধ্যমে। তাই সেইসাথে হেল্প ডেস্কের ব্যাপক চাহিদার তুলনায় এর পরিধিও বাড়ানো হয়। ফারাজ করিমের এ কার্যক্রম রীতিমত দেশের মাঝে আকাশচুম্বী প্রশংসাসূচক আলোচনার মাধ্যম হয়। এসব কার্যক্রম সচল রাখতে গিয়ে কেমন চ্যালেঞ্জ নিতে হয়েছে তা জানতে চাইলে ফারাজ করিম বলেন, ‘দেশের দুর্নীতি-অনিয়ম সব জায়গায় যেমন আছে তা আমার মাটির শহর রাউজানেও ছিল। বাবার যে স্বপ্ন ছিল নিজ এলাকাকে পরিচ্ছন্ন করার, তাতে চেয়েছি আমিও অংশ নিতে। জানি না শতভাগ সফল হতে পারবো কি না। তবুও আমি আল্লাহর ইচ্ছায় কিছু সংখ্যক অপরাধ-অনিয়ম বন্ধ করার জন্য চেষ্টা করেছি। আমাদের সব হেল্প ডেস্ক সার্ভিসের সেবা চালু করার পর অপরাধীদের অনেকটাই লাঘবে আনতে পারছি। এ হেল্প ডেস্কে ২৪ ঘণ্টায় এমন এমন অভিযোগের ভিত্তিতে সংশ্লিষ্ট থানার মাধ্যমে অভিযান করেছি এরমধ্যে অনেকগুলোই মর্মস্পর্শী ছিল। যেমন কিছুদিন আগে এক মাকে তারই সন্তান নির্যাতন করার খবর পেয়ে সেই গ্রামে ছুঁটে গিয়ে নির্যাতনে লোমহর্ষক বর্ণনা শুনে অশ্রুসিক্ত হয়েছিলাম। সাথে সাথে তার সব দায়িত্বও আমরা নিয়েছি। এমন অনেক ঘটনাই উল্লেখ করার মত ছিল।’

jagonews24

করোনাকালে যার দৃষ্টান্ত অনন্য: করোনায় স্থবিরতার প্রকোপ দেশে যখন বাড়তে থাকে; তখন সামনে আসে পবিত্র রমজান মাস। এ সময়ে লকডাউনে বন্দি কোটি মানুষের জীবনযাত্রা থেমে যায়; তখন থেকেই ফারাজ করিম করোনায় সম্মুখ সমরে থাকা চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী, দায়িত্বরত পুলিশসহ বিভিন্ন সড়কে ঘুরে বেড়ানো অসহায়দের নিয়ে চিন্তা শুরু করেন। কারণ সন্ধ্যার পর সব রেস্তোরাঁ বন্ধ হয়ে যায়। ফলে চাইলেও অসহায়রা টাকা দিয়ে খাবার কিনে খেতে পারতেন না। আর সাহরি তো তাদের স্বপ্নের কথা। তাই বাবার সাথে আলোচনা করে বিভিন্ন মহল থেকে আর্থিক সহায়তা ও নিজের অসীম প্রচেষ্টায় এ তরুণ পুরো রমজান মাসে প্রায় ৬০ হাজার মানুষের খাবার সরবরাহ করেন। মধ্যরাতে তার সেচ্ছাসেবী দল নিয়ে কয়েকভাগে বিভক্ত হয়ে রাউজানসহ পুরো চট্টগ্রাম শহরে এ খাবার সরবরাহ করেছেন। এরইমধ্যে চিকিৎসকদের নিয়ে সমন্বিত সিদ্ধান্তে তিনি চালু করেছেন টেলিমেডিসিন সেবা। মধ্যবিত্তদের ঘরে ঘরে গোপনীয়তা বজায় রেখে ত্রাণ পাঠানোসহ প্রতিদিন নিয়মিত সবজি বাজারের আয়োজনও করেছিলেন। যেখান থেকে গ্রাহকরা ফ্রিতে নির্দিষ্ট পরিমাণ সবজি গ্রহণ করতেন। এ ছাড়াও তিনি বিশেষ মাস্ক, গগলস, হ্যান্ড স্যানিটাইজারসহ প্রয়োজনীয় সুরক্ষাসামগ্রীও বিতরণ করেছেন। করোনায় আক্রান্ত মৃতদের দাফন বা সৎকার নিশ্চিত করতে গড়েছেন একটি টিম। সবশেষ তার উদ্যোগে সাধারণ মানুষের আর্থিক সহায়তা নিয়ে রাউজানে স্থাপন করেছেন করোনা আইসোলেশন সেন্টার। বৈশ্বিক এ ক্রান্তিলগ্নে অদম্য সাহসিকতা নিয়ে এমন অসংখ্য সমসাময়িক পদক্ষেপ নিতে গিয়ে রাত-বিরাতে শহরের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে ছুটে গিয়েছেন। এভাবে নিজেকে নিবেদিত করতে গিয়ে করোনারভাইরাসেও আক্রান্ত হতে হয় তাকে।

এসইউ/এএ/জেআইএম

আরও পড়ুন